সাইকেল নিয়ে এই নিঃসঙ্গ পথেই নেমেছিলাম
সাইকেল নিয়ে এই নিঃসঙ্গ পথেই নেমেছিলাম

সাইকেলে চেপে আর্জেন্টিনায় ১২ দিনে যা দেখলাম

আর্জেন্টিনায় পা রাখার আগে কল্পনায় ছিল ফুটবল, আন্দিজ পর্বত কিংবা বুয়েনস এইরেসের দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকার কথা। ভাবতাম, লোকালয় বা জনপদে দেখব, সকাল-বিকেল-রাত সবাই ফুটবল খেলছে। আমি দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে দেখতে হয়তো বলব—নিউমের উন আর্জেন্টিনা। কিন্তু না, এসব কিছুই হয়নি।

বরং আমি ছিলাম পাতাগোনিয়ার নির্জন উপত্যকায়, আন্দিজের গা বেয়ে নীরবতায় ঘেরা কাঁটা কম্পাস ধরে আঁকা সরলরেখার মতো সোজা এক রাস্তায়। সামনে-পেছনে কিছুই নেই, শুধু পাথুরে ধুলার ভাসমান রেখা আর গা ছমছমে বাতাস। মাঝেমধ্যে গর্জে ওঠা বিশাল ট্রাক আর দু–একটা গাড়ি চোখে পড়ে। নিমেষেই আবার হারিয়ে ফেলি। তবুও এগিয়ে যাওয়া, শুধু মানুষ দেখব বলে।

আন্দিজ পর্বতের কোলে বসে থাকা পাতাগোনিয়া যেন পৃথিবীর এক নিঃসঙ্গ কবিতা।

বারিলোচের পূর্ণ নাম হলো সান কার্লোস দে বারিলোচে। বুয়েনস এইরেস থেকে দুই ঘণ্টার বিমানযাত্রা। এটি আর্জেন্টিনার রিও নেগ্রো প্রদেশের পশ্চিমে অবস্থিত একটি পাহাড়ি শহর, আন্দিজ পর্বতমালার পাদদেশে এবং নাহুয়েল হুয়াপি ন্যাশনাল পার্কের ভেতরে অবস্থিত। লেক, পাহাড়, সুইস ঘরানার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য প্রসিদ্ধ বারিলোচে পাতাগোনিয়ার অন্যতম প্রবেশদ্বার। আদর করে যাকে ডাকা হয় সুইজারল্যান্ড অব আর্জেন্টিনা। ট্রেকিং, সাইকেল চালানো, স্কিইং কিংবা লেক সাফারি—প্রকৃতির এক অপার বিস্ময় হয়ে ধরা দেয় এই শহর।

পথে দেখা ঘোড়সওয়ারের সঙ্গে

বারিলোচে থেকে পূর্বের শহরের নাম ভিয়েদমা। এ শহরেই আমাদের জামাল ভুঁইয়া খেলতে এসেছিলেন সোল দে মায়ো নামের এক ক্লাবে। এ শহরে আসতে আসতে সাইকেল চালাতে চালাতে যে ভূদৃশ্য পার হই, তা যেন এক বিশাল পাথুরে ক্যানভাস, ধুলামাখা হাতে বেলা রুটির মতো এবড়োখেবড়ো; যেখানে ঠান্ডা হাওয়া আর বিস্তৃত ফাঁকা আকাশের রং লেগেছে।

এখানকার সকালগুলো এতটাই শান্ত, মনে হয় যেন সময় থমকে আছে। দিনের আলো আসতে দেরি করে—আমার অভ্যস্ত ভোর পাঁচটায় নয়; বরং তখনো চাদের আলোয় ডুবে থাকে চারপাশ, অদূরের পাহাড় আর কুয়াশার লুকিয়ে থাকে ঘুমন্ত জনপদ।

যতদূর চোখ যায়, বিস্তীর্ণ শূন্যতা। কোথাও কোথাও দু-একটা গবাদিপশু, কখনো এক-আধটা ট্রাক; আর মাঝেমধ্যে অনেক দূরে দূরে খর্বাকৃত গাছের থোক। এই হলো সব। এখানে জনসংখ্যা এতই কম যে দিনের পর দিন সাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে মনে হতো, আমি যেন এই পৃথিবীর একমাত্র অভিযাত্রী।

সকালের রুটিন অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিল কুকুরের ডাক। জোরালো, গভীর, যেন সবাইকে আমার আগমন জানিয়ে দিচ্ছে তারা। আগন্তুকের আবির্ভাব তারা হয়তো ভালো মনে করত না। আলো ফোটার আগে রাস্তায় নেমে যেতাম। গ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎই কুকুরের তীব্র ঘেউ ঘেউ, আর সেই আওয়াজ পাহাড় ঘুরে ফিরে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসত আমার কাছে। আমি ভীরু মনে দম বন্ধ করে পা চালাতাম যত না ঠান্ডার কাতরতায়, তার থেকে কুকুরের ভয়ে।

বারিলোচে শহরের দর্শনীয় স্থান

এই যাত্রায় বেশ কিছু খুদে শহর, এরা যাকে বলে গ্রাম, দেখা এবং থাকা হয়েছে। তারই একটির নাম কুমালকাম। সেখানে এখনো পুরোনো স্টিম ট্রেন চলে পর্যটনের অংশ হিসেবে। তার কালো ধোঁয়া আর সিটি কল্পনাকে বাস্তবের এক সিনেমার দৃশ্যের মতো মনে হতো। লোহার একটা ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ট্রেনের কাঠামো দেখে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে। যেন ইতিহাস উঠে এসেছে অতীত থেকে।

পাতাগোনিয়ার রূপ বদলে যায় ধীরে। একসময়ের ধূসর, ধুলামাখা, শুকনা মরুভূমির মতো; আবার একসময় ঘাসে ঢাকা সবুজ তৃণভূমির মতো। এর মধ্যে দূরে ‘লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরি’র মতো। কিন্তু আকাশ সর্বদা সুবিশাল বিস্তৃত, মেঘে ঢাকা; অথবা একেবারে নির্মল নীল। আর হাওয়া? কখনো সামনে থেকে, কখনো পাশ থেকে আর কখনো পেছন থেকে। একবার আঁকড়ে রাখে তো আবার ছেড়ে দেয়। এই টানাটানি পাতাগোনিয়ার চরিত্র।

ক্লেমেন্তে অর্নেলি নামের এক জায়গায় থাকতে হয়েছে। এখানে ছিল না কোনো থাকার জায়গা। পরের গন্তব্য আরও ৮০ কিলোমিটার। তাই এখানেই থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষ যেহেতু আছে, হয়ে যাবে। একটা স্কুল আছে। আমার স্থানীয় সহযাত্রী আমাদের পরিচয় দেওয়ার পর বেশ খাতির পাওয়া গেল। ক্লাসরুমে ক্যামেরা, মুঠোফোন চার্জের ব্যবস্থা হলো। জনা ১৫ শিশুর কাছে বাংলাদেশের গল্পও বলতে হলো। আর এই স্কুলেই প্রথমবারের মতো একজন আদিবাসীর সঙ্গে দেখা হলো। যার হাতে আরবি আর হিব্রু হরফে লেখা উল্কি ছিল। ভ্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে আমি ছাড়া অন্যজনকে দেখলাম, যার গাত্রবর্ণ অশ্বেত। এই দেশ তার ইউরোপীয় পরিচয়ে গর্বিত; কিন্তু এ ধরনের মানুষই যেন তার নিঃশব্দ বৈচিত্র্যের নিদর্শন হয়ে থাকেন। এই মিশ্রতাই যেন বলে দেয়, আর্জেন্টিনা শুধু ইউরোপের উত্তরাধিকার নয়, তার গভীরে অনেক স্তরের ইতিহাস আছে, সব সময় যা চোখে পড়ে না।

শান্ত শহরে

সাইকেলের পেছনে বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে রেখেছিলাম। ভাবতাম, কেউ থামিয়ে জিজ্ঞেস করবে এই পতাকা কোথাকার? কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। কিছু বাইকার, কিছু ট্রাকচালক চোখ মেলেছেন ঠিকই, কেউ কেউ হাত নাড়িয়েছেন। একমাত্র যে গাড়িটি দাঁড়িয়ে কথা বলল, তিনি ছিলেন কানাডিয়ান পর্যটক।

বাংলাদেশে যদি কোনো বিদেশি দেখা যায়, হোক সে সাইকেলে, হোক হেঁটে—অবধারিতভাবে কেউ জিজ্ঞেস করবেন, ‘আপনি কোথা থেকে?’ আর হাতে এক কাপ চা ধরিয়ে দেবেন। আর্জেন্টিনায় মানুষ ঠিক ততটাই অতিথিপরায়ণ; কিন্তু সেটা অনেকটাই সংযত, কম প্রকাশ্য। খোলা মুখে কথা কম; কিন্তু দরকারে পাশে দাঁড়ান মানুষ।

যেমন সান আন্তেনিও ওয়েস্তে থেকে ভিয়েদমা যাওয়ার সময় আমার সাইকেল বাসে উঠতে না দেওয়ায় তিনজন স্থানীয় এগিয়ে এলেন। তাঁরা বাইকসহ আমাকে নিজে গাড়িতে তুলে ভিয়েদমা পৌঁছে দিলেন। শুধু তা–ই নয়, তাঁরা বাংলাদেশের নাম জানতেন, আর বিদায়ের সময় উপহার দিলেন আর্জেন্টিনার পতাকা। সেই মুহূর্তে মনে হলো, পতাকা বদল হয় কিন্তু মানবিকতা হয়তো একই থাকে। মানুষ বলে কথা। যার জন্য আসা এত দূর!

আর্জেন্টিনায় মানুষ অতিথিপরায়ণ, কিন্তু সেটা অনেকটাই সংযত, কম প্রকাশ্য

পাতাগোনিয়ার রাস্তাগুলো ভয়ংকর নিঃসঙ্গ। দিনের পর দিন শুধু বালু, পাথর আর গর্জন করা বাতাস। কোনো খাবারের দোকান নেই, পানির উৎস নেই, এমনকি ছায়া নেই। চেহারায় একধরনের পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপ্টিক সৌন্দর্য আছে যেন—যেখানে শুধু টিকে থাকার লড়াই। বাংলাদেশের গ্রামীণ রাস্তায় যেখানে প্রতি আধা কিলোমিটারে একটা চায়ের দোকান পাওয়া যায়, এখানে তা যেন স্বপ্ন। আর সে জন্যই হয়তো প্রতে৵ক মানুষের মুখ আরও গভীর, আরও ভেতরে গড়া।

অবশেষে ১২ দিন পর ভিয়েদমা শহরে পৌঁছলাম। ভাবলাম, এখানে বোধ হয় বাংলাদেশ নিয়ে আদিখ্যেতা হবে। হলো না। হয়তো তাঁরা কিছুটা আলাদা। হতেই পারে। তবে পরিবর্তন আসছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, ফুটবল ফোরামে, এমনকি কূটনৈতিক স্তরেও—আর্জেন্টিনা বাংলাদেশকে লক্ষ্য করতে শুরু করেছে। ঢাকায় খুলেছে আর্জেন্টিনার দূতাবাস। একটা বিশাল পদক্ষেপ, ফুটবলের বদৌলতে তৈরি হওয়া এক মহাদেশান্তর সংযোগের প্রথম প্রমাণ।

এই ভিন্নতাকে বোঝা আর স্বীকার করাই ছিল আমার আর্জেন্টিনা সফরের সবচেয়ে বড় উপহার। কখনো যদি মনে হয়, ভালোবাসা একপক্ষীয়, তখন মনে রাখতে হবে—সংযোগের জন্য সব সময়ই দুই পক্ষের সময় লাগে। আমরা হয়তো আগে এগিয়ে গেছি; কিন্তু হয়তো তারাও আসবে একটু সময় নিয়ে।