
বেলা তখন ১১টার কাছাকাছি। মাত্রই আমরা মিরিঞ্জা বাজারে পৌঁছেছি। ওই দূরে দেখা যাচ্ছে মিরিঞ্জা ভ্যালি। সূর্য তেতে আছে। ব্যক্তিগত পরিবহনে, চান্দের গাড়িতে, বাসে, অটোরিকশায়, এমনকি মোটরসাইকেলে করেও পর্যটক আসছে একের পর এক। গাড়ির হর্ন কাঁপিয়ে দিচ্ছে পাহাড়ের নীরবতা।
লামার কোয়ান্টাম অতিথি নিবাস থেকে সকাল আটটার দিকে রওনা হয়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল সকাল ছয়টায় বেরিয়ে পড়ব। কিন্তু শীতের সকাল ছয়টায়ও যেন আবছা আঁধার। তা ছাড়া সকালবেলা কোয়ান্টামের বিশেষ সবজি-খিচুড়ির স্বাদ নিতে জাহিদ ভাইয়ের অনুরোধ উপেক্ষা করা গেল না। সত্যি, খিচুড়ি আর ডিমের ঝোল একটু বেশি পরিমাণে খেয়ে মনে হলো, না খেলে বড্ড মিস হতো।
সেখান থেকে কেয়াজুপাড়া হয়ে লামা সদরে পৌঁছানো গেল ৪০ মিনিটে। উঁচু-নিচু, ঢেউখেলানো পাহাড়ি সড়ক। দুই পাশে গভীর খাদ। পাহাড়ি নারীরা কাজে বেরিয়েছেন। গরুর পাল নিয়ে ছুটছে কিশোর। সড়কের পাশে ছোট্ট দোকানের পাটাতনে বসে হয়তো স্মৃতি রোমন্থন করছেন বয়সী দম্পতি। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সড়কে এসে পড়ছে রোদ। একটা-দুটো ব্যক্তিগত গাড়ি আর মোটরসাইকেল ছাড়া কোনো বাহন চোখে পড়ল না।
দেখতে দেখতে চলে এলাম পাহাড়ি নদী মাতামুহুরীর কাছে। সেতুতে দাঁড়িয়ে একটা-দুটো ছবি তোলা হলো। দুপাশে তামাকখেত। সামান্য দূরেই লামা সদর। উপজেলা সদর যেমন হয়, তেমনই। পার্থক্য বলতে এখানে পাহাড়ি-বাঙালির মিলিত স্রোত। রং চা ও বিশেষ ধরনের মিষ্টি খেয়ে রওনা হলাম মিলিঞ্জা ভ্যালির দিকে। এখান থেকে আরও সাত কিলোমিটার। অনেকটা একই রকম পথ। অবশেষে স্বস্তিতেই পৌঁছানো গেল মিরিঞ্জা বাজারে। এটা লামা-আলীকদম সড়কের একটি অংশ।
লামার বন্ধু খগেশপতি চন্দ্র আগেই বলে দিয়েছিলেন, মিরিঞ্জা ভ্যালির প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে পৌঁছাতে হবে ভোর সাড়ে পাঁচটায়। তবেই হাত দিয়ে ছোঁয়া যাবে ভাসমান মেঘ। মনে হবে, হাতের নাগালেই আকাশ। পাহাড়ের চূড়ায় বসে দেখা যাবে সূর্যোদয়। কিন্তু সে ট্রেন আমরা মিস করেছি।
এখন আমরা এই ভ্যালিতে উঠব। এটি ভূপৃষ্ঠ থেকে দুই হাজার ফুট ওপরে। নানা সূত্রে জানা গেল, এখানে ওঠার কাঁচা সড়কটি ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল। এই পাহাড়ে দীর্ঘকাল শুধুু স্থানীয় পাহাড়িদের বাস ছিল। ২০২১-২২ সাল থেকে ব্যাপক সংখ্যায় পর্যটক আসা-যাওয়া শুরু হয়েছে বলা যায়।
অনেকেই মোটরসাইকেলে তীব্র গর্জন তুলে ধুমধাম উঠে যাচ্ছেন। আমাদের এত তাড়া নেই। স্ত্রী, স্কুল ও কলেজে পড়া দুই পুত্রকে নিয়ে আমরা হেঁটেই উঠছি। দলে বন্ধু খগেশও রয়েছেন। উঠছি, মাঝেমধ্যে বিরতি নিচ্ছি। প্রচুর পর্যটক। একে ডিসেম্বর মাস, স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ, আর পৌষের এই সময়টা বেড়ানোর জন্যও দারুণ।
ক্লান্ত পর্যটকদের জন্য একটু পরপর কলা, পেঁপেসহ মৌসুমি ফলের দোকান। আছে লেবু-চিনির শরবতের ব্যবস্থা। দোকানিরা প্রায় সবাই পার্শ্ববর্তী চকরিয়া উপজেলার মানুষ। ডাব-পেঁপের দাম ঢাকার মতোই।
বৃক্ষ আচ্ছাদিত এই পাহাড়ি সড়কে ধুলার কমতি নেই। খগেশের ভাষায়, এত বেশি পর্যটক আসে যে বিকেলের দিকে সড়কটি ঢাকার গুলিস্তানের চেহারা নেয়।
অবশেষে পৌঁছানো গেল দুই হাজার ফুট ওপরের মিরিঞ্জা ভ্যালির চূড়ায়। ওই দূরে চকরিয়া, মহেশখালী। দু-তিন বছরেই এখানে গড়ে উঠেছে অন্তত ৭০টি রিসোর্ট। কিছু রিসোর্ট জুমঘরের মতো। বিশেষ কায়দায় তৈরি ছোট ছোট কক্ষ। ভাড়া ২ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব কক্ষই নাকি বুকড। তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থাও আছে। খরচ হাজারের মধ্যে। কিছু কিছু রিসোর্টে রাতে বারবিকিউর ব্যবস্থাও আছে।
মিরিঞ্জা পাহাড়ে বিদ্যুৎ নেই। সৌরবিদ্যুতে চলে সব কাজ। খাওয়ার ব্যবস্থা এরাই করে থাকে। চাইলে পর্যটকেরা নিজেরাও কিছু পদ রান্না করে খেতে পারেন।
আমরা একটি রিসোর্টের সামনে হেলানো বেঞ্চে বসলাম। বেশ একটা শীতল বাতাস আমাদের ক্লান্তি দূর করে দিল। খানিক দূরে অল্প বয়সী ছেলেরা গলা ছেড়ে গাইছে, ‘তুমি স্বপ্নতে কেন আসোনি!’ ওরা এসেছে কুমিল্লার বুড়িচং থেকে।
মনে হলো, বিদ্যুৎহীন এই পাহাড়ে একটা রাত থাকতে পারলে মন্দ হতো না। রাতে শিশিরের শব্দ শোনা যেত আর ভোরে দেখা যেত মিরিঞ্জার নিরাভরণ রূপ।
পাহাড় আর বনপ্রান্তর ঘুরে আমার নিজেকে বিভূতিভূষণের আরণ্যক উপন্যাসের সত্যচরণ মনে হচ্ছিল, বনের ভেতরে থেকেও যে বনের একজন হতে পারে না। একদিন তাকে ফিরে যেতে হয় শহরে।