রবীন্দ্রনাথ একা নন, অনেক কিংবদন্তিতুল্য মানুষের শেষযাত্রার সাক্ষী এই শ্মশান

কলকাতার নিমতলা শ্মশানঘাট এলাকা
ছবি: লেখক

‘...ওপারে দূরের ওই নীলাকাশে অস্তগামী সূর্য শেষ বিদায়ের ক্ষণে পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে দিল অগ্নিবর্ণ রক্তিম আভা, আর এপারে এই পৃথিবীর বুকে বহ্নিমান চিতার লেলিহান অগ্নিশিখায় পঞ্চভূতে বিলীন হলো এক মহাপ্রাণের পূত-পবিত্র শরীর। রবি গেল অস্তাচলে...’, আকাশবাণীতে কবিগুরুর অন্তিমযাত্রার ধারাবিবরণীতে জনপ্রিয় বেতার সম্প্রচারক, নাট্যকার ও অভিনেতা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের শেষ আবেগ। ইতিহাস থেকে জানা এ কাব্যকথাই মনে জাগে, যখন শেষ বিদায়ের সেই ঐতিহাসিক স্থানে বিশ্বকবির স্মৃতিস্মারকের সামনে শ্রদ্ধানতে দাঁড়িয়ে আমি।
নিমতলা মহাশ্মশান। হুগলি নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা কলকাতায় বড় শ্মশানঘাট। জোড়াবাগান অঞ্চলের বিডন স্ট্রিট এলাকার এ শ্মশানেই শেষকৃত্য হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের! ৮২ বছর আগে কবির নশ্বর দেহ দাহ করা শ্মশানের ঐতিহাসিক জায়গাটি এখন সমাধিসৌধ, দর্শনীয় স্থান—যেখানে রক্ষিত তাঁর দেহস্মৃতি। স্মৃতির টানে কবির মহাপ্রয়াণের এত বছর পরও ভক্ত-অনুরাগীরা এখানে এসে নীরবে দাঁড়ান। বাইশে শ্রাবণ ও পঁচিশে বৈশাখে তো শ্রদ্ধা-স্মরণে সৃষ্টি হয় জনস্রোত। পরিবার নিয়ে আমারও উপস্থিতি সেই আবেগে।

কলকাতার নিমতলা শ্মশানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সমাধিসৌধ

গিয়েছিলাম এ বছরের জানুয়ারিতে, উপলক্ষ শান্তিনিকেতনে চিত্রকর সহধর্মিনীর প্রদর্শনী। সেখান থেকে কলকাতায় ফিরে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি হয়ে নিমতলা শ্মশান। সবার শেষ বা শুরুটা জোড়াসাঁকো হলেও আমার সিদ্ধান্ত ছিল, কবিগুরুর অন্তিমযাত্রার ইতিহাসের কাছে যাওয়ার। বেশি দূর তো নয়, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার পথ, হেঁটেও যাওয়া যায়। জন্ম, বেড়ে ওঠা, প্রেম, ভালোবাসা, বিরহ, সংসার, খ্যাতি, শেষনিশ্বাস—ঠাকুরবাড়িতে কবিগুরুর স্মৃতির সান্নিধ্যে কাটিয়ে মধ্যাহ্নে রওনা দিই নিমতলা শ্মশানে। বাড়ির মূল ফটক থেকে বেবিট্যাক্সি, রিজার্ভ ভাড়া ১০০ রুপি। সঙ্গী স্ত্রী জেসমিন, কলেজপড়ুয়া মেয়ে সোনালী ও স্কুলপড়ুয়া ছেলে ইহান। দিনটি ছিল ১২ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার।

টেরাকোটায় অলংকৃত পেছনের দেয়ালে জন্ম-মৃত্যুর দিনলিপির মাঝখানে খোদাই করা এপিটাফ

জোড়াবাগান চৌরাস্তা পেরিয়ে নিমতলামুখী সড়কে ঢোকার পর বেবিট্যাক্সির পাশ ঘেঁষে সাইরেনের কর্কশ আর্তনাদে পার হয় ফুলে সাজানো শববাহী গাড়ি—একটার পর একটা, জীবনের শেষযাত্রার পথে। ফিরে গেলাম ইতিহাসে, বাইশে শ্রাবণ, বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভার মহাপ্রস্থানের দিনটিতে, ৭ আগস্ট ১৯৪১ (বাইশে শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)। ঠাকুরবাড়ি থেকে নিমতলা শ্মশানের দিকে রবিঠাকুরের শেষযাত্রা। শহরের নানা জায়গা ঘুরে এ পথেই নিমতলা মহাশ্মশানে গিয়েছিল কবিগুরুর শববহর, লাখো জনতার মিছিল ছিল পেছনে। ভক্ত-অনুরাগীর কাঁধের ওপর ভেসেছিলেন গুরুদেব—ফুলবৃষ্টি আর চোখের জলে। সোনালি বুটি দেওয়া চাদরে মোড়ানো কাঠের পালঙ্কে শোয়া শেষ সাজে বিশ্বকবি।
ভারতীয় চিত্রশল্পী ও লেখক রানী চন্দ তাঁর ‘গুরুদেব’ বইয়ে লিখেছিলেন, ‘...পরনে সাদা বেনারসি জোড়-কোঁচানো ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি। গলার নিচ থেকে পা পর্যন্ত ঝোলানো পাট কড়া চাদর। কপালে চন্দন, গলায় গোড়ে মালা। দুপাশে রাশি রাশি শ্বেতকমল, রজনীগন্ধা। বুকের ওপরে রাখা হাতে একটি পদ্মকোরক। রাজবেশে রাজা ঘুমাচ্ছেন রাজশয্যায়...’।
বিদায়বেলায় প্রিয় বর্ষার উপভোগটা জুটেছিল কবির, মেছুয়াবাজারে পৌঁছুতেই শুরু হয়েছিল অঝোর বৃষ্টি। এসব ভাবতে ভাবতে ১০ মিনিটেই পৌঁছে যাই বিডন স্ট্রিটের রেললাইনের কাছে। হেঁটে রেললাইন পেরোতেই নিমতলা শ্মশান এলাকা শুরু। নদীর গা ঘেঁষা শ্মশান, পরপর অনেক বৈদ্যুতিক চুল্লি। চিমনির ধোঁয়ায় আকাশে বিলীন হচ্ছে অজানা–অচেনা কত না মানুষের নশ্বর দেহ। অনেক বড় ও ব্যস্ত শ্মশানঘাট, জেগে থাকে দিন-রাত। হরিধ্বনিমুখর বিমর্ষ শ্মশানযাত্রীদের ভিড়। ডানদিকে রেললাইন লাগোয়া দোকানের সারি। চন্দন, আতর, মোমবাতি, আগরবাতি, ফুলসহ শেষকৃত্যের নানা উপকরণ। কেনাকাটায় ব্যস্ত শেষযাত্রীর স্বজনেরা। শেষ প্রান্তে এসে চোখে পড়ল, ছোট গেটের ওপর নামফলক ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাধি প্রাঙ্গণ’। পাশেই বাবা ভূতনাথ ধাম, বাংলার প্রাচীন মন্দিরগুলোর একটি। শ্মশানের দক্ষিণে বহু প্রাচীন আনন্দময়ী কালীমন্দিরও আছে।

পাথরের কালো স্তম্ভে সংরক্ষিত কবিগুরুর দেহস্মৃতি

খোলা ফটক। বিনা বাধায় ঢুকে গেলাম ভেতরে। খোলা আকাশের নিচে হুগলির পাড় থেকে অনেকটা ওপরে সাদা মার্বেল পাথরের বাঁধানো চত্বর। মাঝারি আকার, তিনদিক ঘেরা আধা দেয়াল। চোখ কাড়ে দূরের বিখ্যাত হাওড়া ব্রিজ (সরকারি নাম রবীন্দ্র সেতু), কলকাতা-হাওড়া শহরের অন্যতম সংযোগ। চত্বরজুড়ে ফুলবাগানের মধ্যে ডানদিকে কাঠগোলাপগাছের ছায়াতলে রবিঠাকুরের সমাধিসৌধ। তিনদিক খোলা আটচালা মন্দির স্থাপত্যের শৈলী, ওপরের দিকে ক্ষুদ্রাকৃতির ছাদের গঠন জোড়া দিয়ে উচ্চতা বাড়ানো। ভেতরে–বাইরে কালো ও মেরুন রঙের পুষ্পশোভিত টেরাকোটায় অলংকৃত। মাঝখানে কালো পাথরের স্তম্ভে রাখা কবির দেহস্মৃতি। পেছনের দেয়ালে দুপাশে জন্ম-মৃত্যুর দিনলিপির মাঝখানে খোদাই করা এপিটাফে গানের দুই ছত্র, ‘সম্মুখে শান্তি পারাবার/ভাসাও তরণী হে কর্ণধার’। গানটি কবির ইচ্ছায় কখনো গাওয়া হয়নি তাঁর জীবিতকালে। প্রয়াণদিনেই প্রথম গাওয়া হয় শান্তিনিকেতনে মন্দিরের উপাসনায়, তিন ছাত্রীকে নিয়ে চোখের জলে ভেসেছিলেন সংগীতশিক্ষক শৈলজারঞ্জন মজুমদার।
অন্তর্জালে ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে ভারতের ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার এক প্রতিবেদন থেকে জেনেছি, মৃত্যুর ১৬ বছর পর বানানো হয়েছিল এই রবীন্দ্রস্মারক। নকশা করেছিলেন বাঙালি চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু ও ভাস্কর সুনীল পাল। ১৯৫৬ সালের ৭ আগস্ট ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত ও সাহিত্যিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে ভিত্তি স্থাপন, এক বছর পর উদ্বোধন করেন প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে কলকাতা পৌরসভা থাকা সত্ত্বেও অনেক বছর অবহেলায় থাকে সমাধিসৌধটি। মাতাল-ভবঘুরেদের আড্ডায় কুখ্যাতি ছড়ায়, শ্রদ্ধা জানাতে আসা ভক্তরা পড়ে নোংরা পরিবেশে। একপর্যায়ে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে কাঠামো। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে সংস্কার করে পশ্চিমবঙ্গ গণপূর্ত বিভাগ। তখনই মার্বেল স্ল্যাবে পাকা হয় চত্বর এবং টেরাকোটা টাইলসে অলংকৃত হয়। চারপাশে বেষ্টনীও দেওয়া হয়। আগের সাদা রঙের জায়গায় ঘিয়ে রঙে আঁকা হয় সৌধকাঠামো আর ফুলের মোটিফগুলো উজ্জ্বল লাল রঙে ফুটিয়ে তোলা হয়। আরও পরে আবারও রং বদলানো হয়, কড়া হলুদে কাঠামো আর সমুদ্রসবুজে ফুলের মোটিফ। ২০১০ সালে ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উদ্‌যাপনের সময় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পে সমাধিসৌধের সৌন্দর্যায়নের কাজ শুরু হয়। ওই বছরের ২৫ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। দুই বছরের মধ্যে কাজ শেষে আজকের রূপে দাঁড়ায় রবিস্মারক। এ সময়ই করা হয় চত্বরজুড়ে ফুলের বাগান। বর্তমানে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের নজরদারিতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমাধিসৌধের দেখভাল করছে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্মৃতিস্তম্ভে পরিবারসহ লেখক

চত্বরজুড়ে ছোট ছোট দলে গোল করে বসে দুই–তিন জনের আড্ডা। বেঞ্চিতে শুয়ে আয়েসি বিশ্রামেও আছেন কয়েকজন। নদীকে ব্যাকড্রপ রেখে সেলফিতে ব্যস্ত দম্পতি, তরুণীর দল। খেয়ালে বোঝা গেল, এদের বেশির ভাগই দর্শনার্থী নন, স্রেফ সময় কাটাচ্ছেন। হই–হুল্লোড়ময় পরিবেশের এমন চিত্র সম্মানের প্রশ্নে বাঙালির উদাসীনতাই জানান দেয়। কোথায় যেন পড়েছিলাম, যত আবেগ, উন্মাদনা, বিষাদপ্রবণতাই থাকুক না কেন, রবীন্দ্রসমাধি এখন ঘুম-আড্ডার সংস্কৃতি! প্রমাণ চোখের সামনেই। এরই মধ্যে স্কুলশিক্ষার্থীদের ছোট একটি দলকে দেখলাম, কবির সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে নীরবে শ্রদ্ধা জানাতে। মনটা ভরে গেল। তারা সরে যেতেই আমরা গিয়ে দাঁড়ালাম কবির সামনে। নীরবে স্মরণ করলাম, ‘হে মহাকবি, লহ মোর সশ্রদ্ধ প্রণাম’। জীবনসঙ্গী আর উত্তরসূরিদের নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পেরে ভালো লাগার অনুভূতি তখন অন্য রকম।
বাইশে শ্রাবণ দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে মারা যান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বয়স তখন ৮০ বছর ৩ মাস। বেলা তিনটায় বের হয় শবযাত্রা। রাত আটটার পর নিমতলা শ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। মুখাগ্নি করেন কবির মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি সুবীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। লাখো মানুষের ভিড়ের চাপে শ্মশানে পৌঁছতেই পারেননি কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পথেই আটকে ছিলেন। সুবীরেন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন নদীপথে। সে সময় নিমতলার চারপাশে ছিল লোকে লোকারণ্য—ঘাটের সীমানা ধরে রেলওয়ে ভ্যান, মোটরগাড়ি, পেছনের বড় বড় গাছ, দূরের বাড়ির ছাদ, নদীর পাড়ে সারি সারি নৌকায় মানুষ আর মানুষ, আবেগ-উন্মাদনা-বিষাদ বিদায় জানায় প্রিয় মরণবিজয়ী কবিকে। ভাবলে অবাক হই, এমন ভালোবাসার মধ্যেও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় কলঙ্কের আঁচড়ও পড়ে গুরুদেবের অন্তিমযাত্রায়। স্মৃতিকথায় বলে গেছেন প্রত্যক্ষদর্শীসহ রবীন্দ্রঘনিষ্ঠ অনেকেই। সেদিন সবকিছু ছিল ঠাকুরবাড়ির আয়ত্তের বাইরে, ‘অভিসন্ধিপরায়ণ’ আর ‘অতি আবেগপ্রবণ’ একদল মানুষের কবজায়! কবির নিথর দেহ নিয়ে নিমতলা শ্মশানে ঝড়ের গতিতে যাঁরা রওনা দিয়েছিলেন, তাঁরা কেউই ঠাকুরবাড়ির পরিচিত ছিলেন না। উন্মাদনার অনিয়ন্ত্রিত জনজোয়ারে ‘বিশ্বকবির জয়’, ‘জয় রবীন্দ্রনাথের জয়’, ‘বন্দে মাতরম’ মুহুর্মুহু ধ্বনিতে উপেক্ষিত হয় কবির শেষ ইচ্ছা। জনচাপে সিনেট হলে শ্রদ্ধা জানাতে পারেননি বিশিষ্টজনেরা। সবচেয়ে নির্মম ছিল, সংগ্রহে রাখতে কবির মরদেহ থেকে চুল ও দাড়ি ছিঁড়ে নেওয়ার ঘটনা। আর আজও সবাইকে ভাবায়, ছেলের হাতের আগুন পাননি রবীন্দ্রনাথ!

কবিগুরুর সমাধিসৌধের ডান পাশে কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিফলক

১৮৫৭ সালে গড়া নিমতলা মহাশ্মশান। নোবেলজয়ী কবির স্মৃতিসৌধে আলোকিত হয়ে ওঠে জায়গাটা। যদিও কলকাতার দর্শনীয় স্থানের কোনো তালিকায় নেই রবীন্দ্র সমাধিসৌধ। ভালোবাসার টানে আমার মতোই ভক্তরা খুঁজে নেন। তবে রবিঠাকুর একা নন, বহু কিংবদন্তির শেষযাত্রার সাক্ষী এই শ্মশান। কবিগুরুর সমাধিচত্বরেই রয়েছে কয়েকজনের স্মৃতিফলক। কবির ঠিক উল্টোদিকে চত্বরের অন্য প্রান্তে বেষ্টনীঘেঁষা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (মৃত্যু ২৯ জুলাই ১৮৯১) কালো মার্বেলের ছোট আকারের স্মৃতিস্তম্ভ। দুঃখজনক হলেও সত্য, মৃত্যুর ১২৯ বছর পর (৩০ জুলাই ২০২০) বসানো হয় ভারতীয় নবজাগরণের অন্যতম পুরোধার স্মৃতিফলকটি। উদ্যোগটা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের (ভারত সভা), যার সদস্য ছিলেন বিদ্যাসাগর মশাই। কবিগুরুর ডান পাশে ভূতনাথ মন্দিরের পেছনের দেয়ালঘেঁষা বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (মৃত্যু ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১) স্মৃতিফলক। মৃত্যুর ২৭ বছর পর (২৩ জুলাই ১৯৯৮) একাডেমি অব ইন্ডিয়ান কয়েনস্ অ্যান্ড হিস্ট্রির উদ্যোগে বসানো ফলকের উন্মোচন করেন কলকাতার তৎকালীন মেয়র প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুই পাশে আরও দুজনের স্মৃতিফলক পেলাম—কলকাতার নবম মেয়র স্যার হরিশংকর পাল (মেয়াদ ২৯ এপ্রিল ১৯৩৬-২৮ এপ্রিল ১৯৩৭) ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী সুশীল দাশগুপ্ত (মৃত্যু ২৫ ভাদ্র ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ)। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে নেতা হরিশংকর পালের বিস্তারিত ইতিহাস নেই। অধুনা বাংলাদেশের বরিশালে জন্ম নেওয়া বিপ্লবী সুশীল দাশগুপ্ত ১৯৪৭ সালে কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হন।
বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, রসায়নচর্চার পথিকৃত স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও এই শ্মশানে দাহ করা হয় বলে বিভিন্ন প্রবন্ধে উল্লেখ আছে। তাঁদের কোনো স্মৃতিফলক চোখে পড়েনি, শ্মশানের অন্য কোথাও আছে কি না, নিশ্চিত হতে পারিনি। বিদ্যাসাগরের মতো দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকাটাও বিচিত্র নয়! সবশেষ, শক্তিমান কবি ও সাহিত্য সমালোচক শঙ্খ ঘোষ (মৃত্যু ২১ এপ্রিল ২০২১) ও বাচিক শিল্পী পার্থ ঘোষকে (মৃত্যু ৭ মে ২০২২) নিমতলায় দাহ করা হয়। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় (মৃত্যু ২৩ মার্চ ১৯৯৫) আর ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’খ্যাত মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের (মৃত্যু ৫ এপ্রিল ১৯৯৭) নাকি খুবই প্রিয় ছিল নিমতলা ঘাট। এখানে তাঁরা সাধু, সন্ন্যাসীসহ নানা মানুষের সঙ্গে অনেক রাত কাটিয়েছেন। তবে তাঁরা কখনো রবিসৌধে রাত কাটিয়েছিলেন কি না, জানা নেই।
মধুর স্মৃতি নিয়ে বেরিয়ে এসেছি ঠিকই, সত্যি বলতে, মহাশ্মশানের চরম কোলাহল আর বিশৃঙ্খল পরিবেশে কবিগুরুর শেষ বিশ্রামটা মন মানতে পারেনি। কবি নিজেও তো কলকাতার উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে সমাপ্তি না ঘটার ইচ্ছাটা জানিয়েছিলেন বারবার। চেয়েছিলেন, শান্তিনিকেতনের উদার মাঠে উন্মুক্ত আকাশের তলায় আশ্রম বালক–বালিকাদের ভেতর থাকতে, ‘সেখানে জয়ধ্বনি থাকবে না, উন্মত্ততা থাকবে না। থাকবে শান্ত, স্তব্ধ প্রকৃতির সমাবেশ। প্রকৃতিতে মানুষে মিলে দেবে আমাকে শান্তির পাথেয়।’
শেষ ইচ্ছাটা পূরণ হলে শান্তিনিকেতনের নির্মল পরিবেশের সমাধিতে দাঁড়িয়ে কবি নজরুলের হৃদয়স্পর্শী পঙ্‌ক্তিতে আমরাও সুর তুলতে পারতাম, ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে, জাগায়ো না জাগায়ো না/সারা জীবন যে আলো দিল ডেকে, তার ঘুম ভাঙায়ো না।’

এজাজ মাহমুদ : লেখক ও সাংবাদিক