
কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের প্রতি আগ্রহ বা এ নিয়ে গবেষণার ইচ্ছাটা ক্যাম্পাসের গুটিকয় শিক্ষার্থীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) কয়েক বছর আগেও এ নিয়ে কোনো দলগত প্রচেষ্টা চোখে পড়েনি। কীভাবে এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার জন্য একটা পুরোদস্তুর ক্লাব গড়ে উঠল?
২০২১ সালের কথা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের অ্যালামনাইদের একটি গ্রুপে এক সিনিয়রের পোস্ট দেখে কৌতূহলী হন শাকিবুল ইসলাম। তিনিও একই বিভাগের শিক্ষার্থী। সহপাঠী ইসতিয়াক রহমান, মুবাসসিরা তাসনিম, রাহুল দেব শর্মা ও এম এইচ তানভীরকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাব গঠন করেন তিনি। নাম দেন ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটিং সাস্ট’। এই ক্লাবের মাধ্যমে তাঁরা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বিষয়ে পাঠদান, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমষ্টিগতভাবে এ বিষয়ে আগ্রহ ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একযোগে কাজ শুরু করেন।
ব্যাখ্যাটা শাকিবুল ইসলামের মুখেই শোনা যাক। ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটিং হলো এমন এক প্রযুক্তি, যেখানে কম্পিউটেশন করার জন্য কোয়ান্টাম মেকানিকসের নিয়মগুলো ব্যবহার করা হয়। আমাদের প্রচলিত কম্পিউটার যেখানে তথ্য ধারণ করে ০ বা ১ আকারে (বিট), সেখানে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করে কিউবিট, যা একই সঙ্গে ০ ও ১—উভয় অবস্থায় থাকতে পারে (এটিকে বলে সুপারপজিশন)। ফলে কোয়ান্টাম কম্পিউটার একসঙ্গে অনেক সম্ভাব্য সমাধান পরীক্ষা করতে পারে, যা ক্ল্যাসিক্যাল কম্পিউটারে একটা একটা করে করতে হয়। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এনট্যাঙ্গলমেন্ট (সংযুক্ত), যেখানে একাধিক কিউবিট এমনভাবে জড়িয়ে থাকে যে একটির অবস্থা জানলে অন্যটির অবস্থাও জানা যায়।’ শিক্ষার্থীরা বলছেন, কোয়ান্টাম কম্পিউটার কিছু নির্দিষ্ট সমস্যায় (যেমন বড় সংখ্যার ফ্যাক্টর বের করা, বিশাল ডেটাবেজে খোঁজ করা, জটিল কোয়ান্টাম সিস্টেম সিমুলেট করা) অনেক দ্রুত কাজ করতে পারে। সহজভাবে বললে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার হলো এমন এক যন্ত্র, যা সমস্যাকে অনেকগুলো দৃষ্টিকোণ থেকে একসঙ্গে দেখতে পারে।
বিভিন্ন ছুটিতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও শাকিবুল বাড়ি ফিরে যাননি। এ সময়টাই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন। শাকিবুল ইসলাম বলছিলেন, ‘এই পথচলা সহজ ছিল না। একপর্যায়ে শুধু কোয়ান্টাম কম্পিউটেশন শেখার জন্যই এক বছর পড়াশোনায় বিরতি নিই।’ ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা সহকারী হিসেবে চাকরি শুরু করেন। আন্তর্জাতিক অধ্যাপকদের সঙ্গে গবেষণায় যুক্ত হন। একাডেমিক পড়াশোনাও চালিয়ে গেছেন এই সময়ে। পাশাপাশি কাজ করেছেন কোয়ান্টাম এরর কারেকশন, কোয়ান্টাম ডট ও সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইস ডিজাইন নিয়ে।
২০২২ সালের শেষ দিকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং সাস্টের যাত্রা শুরু হয়। ক্লাবের অন্যতম উদ্যোক্তা গণিত বিভাগের এম এইচ তানভীর বলছিলেন, ‘শুরুটা ছিল একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত। আমরা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে ক্লাস ও সেশন পরিচালনা করি। পরে ধীরে ধীরে সামার প্রোগ্রাম, হ্যাকাথনসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ শুরু করি। এই অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের জন্য নতুন নতুন সহযোগিতার দরজা খুলে দেয়, যা গবেষণায় সার্থক অবদান রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে আমরা “কোয়ান্টাম এরর কারেকশন”–বিষয়ক কিছু গবেষণায় যুক্ত আছি। স্টেট-অব-দ্য-আর্ট কোয়ান্টাম কম্পিউটিং গবেষণায় বাংলাদেশ থেকেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা সম্ভব হবে, এই প্রত্যাশা সামনে রেখেই আমাদের পথচলা।’
শাবিপ্রবির তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মহসিনুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে, বিশেষ করে শাবিপ্রবির প্রেক্ষাপটে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য সম্পদ খুবই সীমিত। এই সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের যতটা সম্ভব সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই মানুষগুলোর নিষ্ঠা, শ্রম আর আগ্রহ দেখেছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সীমিত সম্পদের মধ্যেও এরা একদিন সত্যিকারের সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছাবে।’
২০২২ সালে ভারতের একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন ক্লাবের সদস্যরা। একই বছরে কিউব্রেইড আই ও এমআইটি আইকিউহ্যাক–এ যথাক্রমে ১৩তম ও ১৭তম স্থান লাভ করে শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের একটি দল। এ ছাড়া ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ইসতিয়াক রহমান ফিনল্যান্ডে কোয়ান্টাম টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনার জন্য বৃত্তি পেয়েছেন। ক্লাবের অন্য সদস্যরাও কোয়ান্টাম এররের সংশোধন, মেজারমেন্ট–বেজড কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও কোয়ান্টাম ডটের মতো স্টেট-অব-দ্য-আর্ট গবেষণায় সক্রিয় রয়েছেন। এ বছর ২৫ থেকে ২৭ এপ্রিল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা শাকিবুল ইসলাম আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত ১৩তম আন্তর্জাতিক হ্যাকাথনে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত হন তিনি। হ্যাকাথনের থিম ছিল ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটিং অ্যান্ড আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ফর অ্যাডভান্সিং দ্য ইউনাইটেড ন্যাশনস সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি)’। ১৭টি আন্তর্জাতিক দলের মধ্যে তৃতীয় হয় শাকিবুল ও তাঁর দল।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং সাস্টের সঙ্গে যুক্ত সদস্যদের উদ্যমের কমতি নেই। তবে শিক্ষকেরা সহযোগিতা করলেও অবকাঠামো শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট নয়। শাকিবুল ইসলাম বলছিলেন, ‘আমার সব গবেষণা প্রকল্পই নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত।’ ক্লাবের সংগঠকেরা বলছেন, তাঁরা কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের সম্ভাবনার কথা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চান।