
আমি মা–বাবার একমাত্র সন্তান। আমার আট বছর বয়সে বাবা মারা যান, তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। মা গৃহিণী। আমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিল না। একলা মা আমাকে নিয়ে বড় সমস্যায় পড়ে যান। তাঁর পক্ষে আমার স্কুলের খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছিল না।
আমি তখন ঢাকার সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ি। আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন হামিদা আলী ম্যাডাম। মা একদিন তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। ম্যাডাম সব শুনে মাকে ওই স্কুলে চাকরি দেন আর আমাকে দেন এক বছরের বৃত্তি। মা চাকরির পাশাপাশি বেশ কয়েকটা টিউশনও করতেন। মা টিউশনে গেলে একা বাসায় আমার ভালো লাগত না। চতুর্থ শ্রেণিতে যখন উঠি, তখন মা কাকলী নামের এক নারীর খোঁজ পান, যিনি ছোটদের পড়াতেন। মা তাঁর সঙ্গে কথা বললে তিনি অর্ধেক বেতনে আমাকে পড়াতে রাজি হন। তাঁরা ছিলেন তিন বোন—রুমা, লিজা ও কাকলী আন্টি। তিনজনই আমার খেয়াল রাখতেন, পড়াতেন এবং অনেক সময় খেতেও দিতেন।
সে সময় আপন কাউকে পাইনি, এই তিন আন্টি আমাকে আপন করে নিয়েছিলেন। কাকলী আন্টি আমাকে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, সেখানে আমি দ্বিতীয় হই। পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পাই। তাই সাউথ পয়েন্ট স্কুল আমার ভালো ফলাফলের জন্য প্রতিবছর বৃত্তি দিতে থাকে।
স্কুলে নতুন বাংলা স্যার যোগ দেন—রমেন স্যার। আমি বাংলায় খারাপ করছিলাম। মা আমার জন্য আলাদা করে শিক্ষক দিতে পারছিলেন না বলে রমেন স্যারকে সব বুঝিয়ে বলেন। স্যার জেএসসি পরীক্ষার আগের তিন মাস আমাকে পড়ান; আমি গোল্ডেন এ প্লাস পাই।
নবম শ্রেণিতে ওঠার পরও রমেন স্যার পড়ানো চালিয়ে যান। পাশাপাশি আমি পদার্থবিজ্ঞানে পড়তাম সুফিয়া মিসের কাছে, রসায়ন পড়তাম মোসলেউদ্দিন স্যারের কাছে, ইংরেজি পড়তাম সুজিত স্যারের কাছে, জীববিজ্ঞান পড়াতেন তাসনিন মিস ও সাবেরা মিস। এই শিক্ষকদের কেউই কোনো টাকাপয়সা নেননি। তাঁদের জন্যই আমি এসএসসিতে ভালো ফল করি, গোল্ডেন এ প্লাস পাই।
এ সময় আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০১৫ সালে মায়ের অপারেশন হয়, ঠিক এসএসসি পরীক্ষার তিন দিন পর। চিকিৎসার সব খরচ আমার স্কুলের বন্ধুদের অভিভাবকেরা দেন, বিশেষ করে মিথিলার মা লিমা আন্টি। তিনি আমার ও মায়ের খোঁজখবর রাখতেন এবং সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের পাশে ছিলেন।
আমি কলেজে উঠলে প্রথম আলো ট্রাস্ট থেকে মেধাবৃত্তি পাই। বিএসসি পর্যন্ত এই বৃত্তি পেতে থাকি। এমনকি করোনার সময়ও প্রথম আলোর বৃত্তি বন্ধ হয়নি। তখন এটি ছিল আমার একমাত্র সহায়তা। পুরো মাস আমি এই টাকা দিয়ে যাতায়াত ও টিফিনের খরচ চালাতাম।
আমার সব শিক্ষক আমাকে পড়ানোর পাশাপাশি উৎসাহ দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন। রমেন স্যার, সুফিয়া মিসের অবদান সীমাহীন। কলেজে অসুস্থতার কারণে ক্লাসে পিছিয়ে পড়েছিলাম। কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাইনি। খুব চেয়েছিলাম বুয়েটে ভর্তি হতে, কিন্তু সে সুযোগ না পেয়ে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু মা আশা হারাননি, তিনি আমাকে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগে ভর্তি করিয়ে দেন।
বিভাগের চেয়ারপারসন ড. আহমেদ ওয়াসিফ রেজা স্যার আমাকে বোর্ড অব ট্রাস্টি স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে বলেন এবং বিষয়টি রাজিয়া সামাদ ম্যাডামকে জানান। রাজিয়া সামাদ ম্যাডাম মেয়েদের পড়াশোনা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে খুব আন্তরিক ছিলেন। তিনি আমার সব শুনে এবং ফলাফল দেখে আমাকে শতভাগ বৃত্তি দেন। ২০১৯ সালে ম্যাডামের মৃত্যুর পর থেকে তাঁর ছেলে ড. জয় সামাদ স্যার বৃত্তি চালু রাখার ব্যবস্থা করেন।
আমার বিএসসি করার সময় আরও অনেক শিক্ষকের সাহায্য, অনুপ্রেরণা ও স্নেহ পেয়েছি। তাঁদের অন্যতম আমার সুপারভাইজার ড. আহমেদ ওয়াসিফ রেজা স্যার।
বিএসসি শেষ করার পর ড. জয় সামাদ স্যার আমাকে এমএসসি করার জন্যও পূর্ণ বৃত্তি দেন। এমএসসি করার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. মোজাম্মেল হক স্যারের গ্র্যাজুয়েট টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট (জিটিএ) হিসেবে যোগ দিই। সে সময়ই স্বপ্ন দেখতে শুরু করি—শিক্ষক হব।
সেই স্বপ্নের কথা ভেবে নিজেকে প্রস্তুত করি। অবশেষে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই। আমার আজকের এই অবস্থানের পেছনে আছে আমার মায়ের ভালোবাসা, কাকলী আন্টি, রমেন স্যারসহ আমার সব শিক্ষকের স্নেহ, সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা।
অবশ্য এমন কথাও আমাকে শুনতে হয়েছে, ‘মেয়ে মানুষ, কত দূরই–বা এগোতে পারবে’, ‘বাবা নেই, পারবে না’, ‘টাকা না থাকলে বড় স্বপ্ন দেখতে হয় না’, ‘শূন্য হাতে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখলে সামনে কষ্ট ছাড়া কিছুই নেই’ ইত্যাদি।
কিন্তু কোনো কিছুই আমাকে আটকাতে পারেনি। সাময়িক কষ্ট লেগেছে, কিন্তু বুঝতে পেরেছি, জীবনের চলার পথে এসব আসবেই; হাসিমুখে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে শিখতে হয়। খারাপ লাগলে হয়তো কাঁদব, বন্ধুর কাছে বা মায়ের কাছে মনের কথা বলব, কিন্তু সব ছেড়ে বসে থাকার মতো বিলাসিতা আমার নেই।
জীবনে যে যত বড় অবস্থানে থাকুক না কেন, কোনো না কোনো বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয়। যারা বৈষম্যের মধ্য দিয়েও এগিয়ে যায়, তারাই একসময় নিজের পায়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারে। মনোবল থাকলে এবং চেষ্টা অব্যাহত রাখলে সব বাধাই অতিক্রম করা যায়।
আজ আমার কাছে যখন কোনো ছাত্রছাত্রী কোনো সমস্যা নিয়ে আসে, তাদের কথা মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করি। সব সময় হয়তো সাহায্য করতে পারি না, কিন্তু সময় দিয়ে তাদের কথা শুনি, যেন তাদের মনটা হালকা হয়। চেষ্টা করি উপদেশ, পরামর্শ ও সাহস দিয়ে তাদের মন ভালো করতে। একসময় আমার জন্যও অনেকেই এমন করেছেন, তাই আমিও চেষ্টা করি একইভাবে সমাজে অবদান রাখতে।
এখনকার ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আমার অনুরোধ, কোনো সমস্যার মুখোমুখি হলে যেন তারা সেটা কারও সঙ্গে ভাগ করে নেয়। কোনো বন্ধু, শিক্ষক বা মা-বাবা, ভাইবোনের সঙ্গে। একা একা কিছুই সমাধান করা যায় না; এতে হতাশা, উদ্বেগ বাড়তে পারে। নিজে যা জানি না, কারও সঙ্গে কথা বলে যদি তা জানতে পারি, তাহলে কথা বলে জেনে এগিয়ে যাওয়াই ভালো।
পৃথিবীতে আজও অনেক ভালো মানুষ আছেন, যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে অন্যের পাশে দাঁড়ান। আমার জীবনই তার প্রমাণ। মা ও আমার পাশে এমন অনেকেই দাঁড়িয়েছিলেন বলে আজ আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি। আমার অর্জন শুধু আমার একার নয়, এটা আমার মায়ের, আমার সব শিক্ষকের, আমার বন্ধুদের এবং প্রথম আলোর মতো প্রতিষ্ঠানসহ যাঁরা আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের সবার।
খাইরুম ইসলাম, প্রভাষক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি