মেডিকেলের চার পরীক্ষাতেই প্রথম চট্টগ্রামের আফিফ

চট্টগ্রামের ছেলে আফিফ
ছবি: আফিফের সৌজন্যে

শিক্ষার্থীরা ভাবেন, মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা এক মহাযুদ্ধ; কিন্তু অনেকেই জানেন না, আসল যুদ্ধ শুরু হয় এই ‘মহাযুদ্ধের’ পর। চিকিৎসক হয়ে উঠতে চারটি পেশাগত পরীক্ষায় (প্রফ) উত্তীর্ণ হতে হয়। একেকটি পরীক্ষা পার হয়ে আসাই বড় চ্যালেঞ্জ। এমন চারটি পরীক্ষার প্রতিটিতেই প্রথম হওয়া কি চাট্টিখানি কথা! এই অসামান্য কীর্তিই গড়েছেন উমাইর আফিফ। কেমন ছিল তাঁর এই যাত্রা?

চট্টগ্রামের ছেলে আফিফ, তিন ভাই–বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। জাতীয় মেধাতালিকায় ৫২তম হয়ে ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ব্যাচ কে-৭৭।

তাঁর বড় বোন মারজান জামিলা তখন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। নিজের শিক্ষকদের পাশাপাশি বড় বোনের সহযোগিতায় মেডিকেল কলেজের পড়ালেখা অনেকটাই সহজ হয়ে ওঠে। তবে ক্লাস আর পরীক্ষার চাপের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কষ্ট কিছুটা ছিলই।

ঘড়ি ধরে পড়া নয়

বরাবরই বুঝে পড়ার প্রতি আগ্রহ। মানবদেহের জটিল সব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং সেসবের কার্যকারণ বুঝতে সিলেবাসের বাইরেও বিচরণ করতেন আফিফ। কতক্ষণ পড়লেন খেয়াল করতেন না; বরং বিষয়টা বুঝতে পারলেন কি না, সেটিই ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিটি পেশাগত পরীক্ষার আগে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ধাপে ধাপে আইটেম, কার্ড আর টার্ম পরীক্ষার ধাক্কা সামলাতে হয়। বুঝে পড়ার কারণে যেকোনো পরীক্ষা পার হওয়া অনেকটাই সহজ হয়ে দাঁড়ায় তাঁর কাছে।

মেডিকেল কলেজে ঢোকার পর থেকেই একাডেমিক পড়ালেখার বাইরে নন-ফিকশন বই পড়েন আফিফ। ক্যাডেট কলেজে থাকতে পড়তেন ফিকশন। করোনা অতিমারির সময় শিখেছেন ভিডিও সম্পাদনার কাজও।

বিভিন্ন সময় করেছেন ইসলামি কোর্স। দেশ-বিদেশে ঘোরেন সময়-সুযোগ পেলেই। কখনোই কেবল একাডেমিক বইয়ের পাতায় আটকে রাখেননি নিজেকে।

একাডেমিক বইয়ের পাতায় আটকে রাখেননি নিজেকে

শেষ বর্ষে জীবন বদল

জুলাই আন্দোলনের অংশীজন হয়ে ওঠার পর নিজ ক্যাম্পাস আর দেশ নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেন। বিভিন্ন ক্লাব, বন্যাদুর্গত মানুষদের জন্য ক্যাম্প, সীরাহ কনফারেন্সসহ ক্যাম্পাসের নানা আয়োজনে যুক্ত হন।

এর মধ্যে নভেম্বরের এক সকালে নতুন এক দিকে মোড় নেয় তার জীবন। জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে গড়ে তোলা স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনে কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে ডাক পান আফিফ। তিনি তখন শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। কমিশনের কাজের ব্যস্ততার কারণে আফিফের প্রতিদিনের পড়ালেখার নিয়ম গেল বদলে।

কমিশনের কাজের প্রয়োজনে জেলায়-উপজেলায় যাতায়াত করতে হতো নিয়মিত। এরই ফাঁকে খানিকটা পড়তেন। মার্চ পর্যন্ত সেই কাজে ব্যস্ত থেকে তারপর পুরোদমে শুরু করলেন চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষার প্রস্তুতি। মাঝখানে অবশ্য কমিশন থেকে এক মাসের ছুটি নিয়ে পড়ালেখা করেছেন। আর আগের পড়াও কাজে এসেছে।

পরীক্ষায় ফলও হয়েছে দারুণ। তবে কমিশনের কাজ করতে গিয়েই অনুধাবন করেছেন, চিকিৎসক হিসেবে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে করার মতো অনেক কাজ আছে। তাই এখন কেবল নিজের ক্যারিয়ারের পথে হাঁটাই স্বপ্ন নয় আফিফের; বরং দেশের মানুষের কল্যাণে আলাদা কিছু করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।

ইতিবাচকতার বার্তা নিয়ে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনুষ্ঠিত পেশাগত পরীক্ষার সব কটিতে প্রথম হওয়া আফিফ বললেন, ‘কখনো কল্পনাও করিনি এমন কিছু অর্জন করতে পারব। আমার সহপাঠীদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা আমার চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী। আমি বিশ্বাস করি, একজন শিক্ষার্থীর জন্য পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো সহযোগিতার চর্চা।’

মেডিকেল কলেজে পড়তে এসে বহু মেধাবী শিক্ষার্থীকে হতাশার অন্ধকারে ডুবে যেতে দেখেছেন তিনি। উপলব্ধি করেছেন, একে অন্যের প্রতি সহমর্মী হয়ে ওঠাটা খুব জরুরি। চারটি পেশাগত পরীক্ষার ১১টি বিষয়ের ৯টিতেই অনার্স নম্বর পাওয়া আফিফের কাছে আদতে মানবতার মূল্য অনেক।

অনুপ্রেরণা ‘বড় আম্মি’

আফিফের পরিবারের অনেকেই চিকিৎসক। কাছের মানুষেরাই ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণা। তবে বিশেষভাবে বললেন তাঁর বড় আম্মির কথা। আফিফের বড় আম্মি, অর্থাৎ বড় চাচিকে একসময় তাঁর বন্ধুরা বলেছিলেন, তিনি আর যা-ই করেন না কেন, স্ত্রীরোগের চিকিৎসা করা নাকি তাঁর কম্ম নয়!

অথচ তিনিই পরে হয়েছিলেন দেশের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি চিকিৎসার অন্যতম পথিকৃৎ। আফিফের বড় চাচি একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. সায়েবা আখতার। আজীবন আফিফের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন এ মানুষটি।

আফিফের অনুপ্রেরণা তাঁর বড় চাচি—একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. সায়েবা আখতার

ভবিষ্যতের ভাবনায়

আফিফের বাবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন তালুকদার। মা ইমামজাদী শিফায়ে মিল্লাত। আফিফ ও তাঁর বড় বোনের মতো ছোট ভাই জারির আইনানও চিকিৎসক হোক, এমনটাই মায়ের ইচ্ছা। আফিফের এখন শিক্ষানবিশির পালা। স্নায়ুতন্ত্রবিষয়ক পড়ালেখা তাঁকে বেশ টানে।

এখনো অবশ্য সিদ্ধান্ত নেননি, নিউরোমেডিসিন, নিউরোসার্জারি নাকি অন্য কোনো বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়বেন। শিক্ষানবিশির সময়টাকে সফলভাবে কাজে লাগাতে চান আফিফ। দেশের মেডিকেল কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য আরও ইতিবাচক একাডেমিক পরিবেশ সৃষ্টির পথে কাজ করার ইচ্ছাও রাখেন তিনি।