কাজী আনোয়ার হোসেনের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

আমার পাগল হতে সময় লাগে না, ছাড়তেও সময় লাগে না

এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল কাজী আনোয়ার হোসেনের সেগুনবাগিচার বাসা–কাম-অফিসে, ২০১৯ সালের আগস্ট মাসের এক সকালবেলা। লেখক–অনুবাদক রওশন জামিলের সঙ্গে কাজীদার বাড়িতে যেদিন যাওয়া হলো, সেদিন দারুণভাবে কথা বলার মুডে ছিলেন তিনি। বললেন সেসব কথা, যা তিনি বলেন না সচরাচর—বাবা, ভাইবোন, নিজের সংগীতজীবন, দাবা খেলার প্রসঙ্গসহ উঠে এল নানা কিছু। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শিবব্রত বর্মন

সেগুনবাগিচায় নিজের বাসায় বসে কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন তাঁর জীবনের অনেক অজানা গল্প
 ছবি: অন্য আলো

শিবব্রত বর্মন: কাজীদা, এসি ব্যবহার করেন না?

কাজী আনোয়ার হোসেন: আজ ব্যবহার করি নাই। না করে পস্তাচ্ছি। কী যে গরম পড়েছে!

শিবব্রত: রাতে পাশের ওই ঘরটাতেই ঘুমান?

কাজী আনোয়ার হোসেন: এখানে ঘুমাই। কাজ করি। স্ত্রী ও মেয়ে মারা গেছে। দুই ছেলে। আমি ছোট ছেলের ওখানে আছি। সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠি। সকাল ৯টায় উঠি। উঠে নাশতাটাশতা করে ১০টায় লিখতে বসি। টানা কাজ চলে। আজ যেমন আগাথা ক্রিস্টির একটা বই শেষ করলাম।

শিবব্রত: আপনি গান গাইতেন। পরিবারে গানের আবহাওয়া ছিল। সিনেমার গানেও প্লে–ব্যাক করলেন। এটা কীভাবে হলো?

কাজী আনোয়ার হোসেন: তালাশ ছবির (১৯৬৩) ওই গানটা করেছিলাম, ‘ম্যায় রিকশাওয়ালা বেচারা’। উর্দু গান, সুরকার রবিন ঘোষ। সুতরাং ছায়াছবিতে (১৯৬৪) গান করেছিলাম। একদিন রেডিওতে রিহার্সাল করছিলাম। ওই সময় একজন এসে বললেন যে সত্য সাহা আপনাকে খুঁজছে। তো, দুদিন পরে সত্য সাহা এলেন। আমার খুব ভক্তি হয়নি ওনার চেহারা দেখে। কিন্তু চমৎকার সুর করেন। তুলনাহীন। উনি গানটা শেখালেন। তারপরে বললেন, ওমুক তারিখে রেকর্ড হবে। হিজ মাস্টার্স ভয়েসে। ওটা তখন ছিল মতিঝিলে, যেখানে এখন স্টক মার্কেট। বিশাল ভবন। ওটার ছয় বা সাততলায় গেলাম। লিফট ছিল না, হেঁটে উঠতে হতো। ওখানে গিয়ে দেখি, সৈয়দ শামসুল হক খুব দৌড়াদৌড়ি করছেন। বললাম, কী ব্যাপার, তুমি এখানে? বলে, আরে এই ছবি তো আমার লেখা। আর গানও আমি লিখেছি। ওই যে, ‘এমন মজা হয় না’, ওগুলো সব ওরই লেখা। বলল, খুব ভালো লাগছে, তুমি আমার গান গাইছ।

শিবব্রত: আপনার সঙ্গে তাঁর আগে থেকে পরিচয় ছিল? বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী?

কাজী আনোয়ার হোসেন: না, তা নয়। জগন্নাথ কলেজের সহপাঠী। আমি লাস্ট বেঞ্চে বসতাম। আমি, (সৈয়দ) শামসুল হক, আর আমীর–উল ইসলাম, যে এখন ব্যারিস্টার। আমরা তিনজন পাশাপাশি বসতাম। ফিসফিস করে আলাপ করতাম। ওদিকে ক্লাস চলছে। বিখ্যাত ভদ্রলোক, মতিন সাহেব ক্লাস নিচ্ছেন। উনি পড়ছেন ট্রেজার আইল্যান্ড। আবৃত্তির মতো করে পড়তেন, লং জন সিলভার। গলাটা ছিল দারুণ।

শিবব্রত: এরপর সৈয়দ হকের সঙ্গে সুতরাং ছবির গানের রেকর্ডের ওখানে দেখা?

কাজী আনোয়ার হোসেন: আগেও মাঝেমধ্যে দেখা হয়েছে। ও আসত আমার এখানে। আমি খুব রেসপেক্ট করতাম ওকে। কথা এত সুন্দর বলত! একদম মুক্তোর দানার মতো। সুতরাং ছবিতে আমার এই গানের মধ্যে (এই যে আকাশ, এই যে বাতাস) আবদুল আলীম সাহেব দু–তিনটে লাইন গাইলেন, ‘বন্ধু রে তোমার লাগি হইলাম দেশান্তর’।

শিবব্রত: সুতরাং–এর গানগুলো ওই সময় হিট হয়েছিল। আপনার ক্যারিয়ার তো ওই দিকে চলে যাওয়ার কথা ছিল।

কাজী আনোয়ার হোসেন: গানের ক্যারিয়ার আমাকে টানতে পারেনি। আমি বরাবর জানতাম, এটা হবে না। আমার আব্বা (কাজী মোতাহার হোসেন) বলতেন, তুই গান গাইছিস গা, আমি কিন্তু চোখ বুজে দেখতে পাই, তুই একটা ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে লিখে যাচ্ছিস।

শিবব্রত: বাবা কি আপনাকে লেখক হিসেবে দেখতে চাইতেন?

কাজী আনোয়ার হোসেন: হ্যাঁ।

শিবব্রত: আপনি যা পড়তে পছন্দ করতেন, লিখতে পছন্দ করতেন, তাতে তাঁর অনুমোদন ছিল?

কাজী আনোয়ার হোসেন: হ্যাঁ, ছিল। আমি ‘কুয়াশা’ লিখেছিলাম অনেক আগে। ১৮ বছর বয়সে। তারপর যখন ‘রানা’ ধরলাম, ওনাকে কয়েকটা বই দিলাম, উনি পড়লেন, পড়েটড়ে কয়েকটা বানান ভুল ধরলেন। রাতে লিখতাম তো। হ্রস্ব-ই কারের জায়গায় দীর্ঘ-ই কার দিয়ে দিতাম। এখনো আমার বানান দেখে নিতে হয়।

শিবব্রত: এসব লেখার ব্যাপারে তিনি উৎসাহ দিতেন?

কাজী আনোয়ার হোসেন: হ্যাঁ, হ্যাঁ। বলতেন, তোর যা খুশি তুই লিখবি। তবে বানান শুদ্ধ করে লিখবি। তোর জন্য আলাদা অভিধান কেউ বানাবে না।

শিবব্রত: আর কিছুতে আপত্তি ছিল না তাঁর?

কাজী আনোয়ার হোসেন: উনি এমন চাইতেন না যে সুসাহিত্য লিখতে হবে। আমার মনের কথা বা যে লেখায় মানুষ নিজেকে দেখতে পাবে—এই সব নিয়ে আব্বার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। উনি শুধু একটা কথা আমাকে বলেছিলেন—দেখিস, কবিতা লিখতে যাস না।

শিবব্রত: কবিতায় আপত্তি কী ছিল?

কাজী আনোয়ার হোসেন: সেটা আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করিনি। উনি শুধু বলেছিলেন, কবিতা লিখিস না। কবিতা হবে না তোর দ্বারা। ওনার হয়নি, সে জন্যই হয়তো বলেছেন...হা হা হা।

শিবব্রত: আপনাদের বাড়িতে গানের পরিবেশ—ভাই কাজী মাহবুব হোসেন সেতার বাজান, বোন সন্​জীদা খাতুন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, কিন্তু আপনি গাইলেন ফিল্মের গান...

কাজী আনোয়ার হোসেন: সন্​জীদা প্রথমে আধুনিক গান, নজরুলগীতি—এগুলো গেয়েছেন রেডিওতে। তারপরে উনি স্থির হলেন রবীন্দ্রসংগীতে। এরপর থেকে রবীন্দ্রসংগীতই চলল ওনার। রবীন্দ্রসংগীত আমার ভালো লাগে, কিন্তু গাইব—এত বাঁধা ছক—এখান থেকে এভাবে গাইতে হবে, ওখান থেকে ওভাবে, এদিক-ওদিক আর করা যাবে না। ওদিক থেকে নজরুলগীতি, পল্লিগীতি—এগুলোয় স্বাধীনতা আছে। আধুনিকে তো আছেই। ক্লাসিক্যাল ধরনের আধুনিক আমার পছন্দ।

শিবব্রত: এখন যাঁরা গান করেন, তাঁদের মধ্যে কাদের গান আপনার ভালো লাগে?

কাজী আনোয়ার হোসেন: কলকাতায় গাইছেন শুভমিতা ব্যানার্জি। দুর্দান্ত। তুলনাহীন। নচিকেতার মধ্যে অনেক গুণ আছে। আর নতুন একজন এসেছেন—রূপঙ্কর।

শিবব্রত: গান কি আপনি ইউটিউবে শোনেন?

কাজী আনোয়ার হোসেন: হ্যাঁ, ইউটিউবে। ফেসবুকের চেয়ে ইউটিউব আমি বেশি ঘাঁটি।

শিবব্রত: ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে আপনার? স্ট্যাটাস আপডেট করেন?

কাজী আনোয়ার হোসেন: আছে। খুব কম ঢুকি। স্ট্যাটাস আপডেট খুব কম করি।

শিবব্রত: কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে দাবা খেলেননি আপনি?

কাজী আনোয়ার হোসেন: দাবা আমি খেলিনি। একবার খেলেছিলাম। হারিয়েছিলাম। এখন বুঝি, উনি ছেড়ে দিয়েছিলেন আমাকে...হা হা হা। এক সন্ধ্যায় কিছু ভালো লাগছিল না। ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে দেখি উনি ড্রয়িংরুমে দাবা নিয়ে বসে আছেন। বলেন, কী রে খেলবি নাকি? বললাম, হ্যাঁ খেলি। আব্বা সাজালেন ঘুঁটি। উনি খুব চাইতেন আমি দাবার মধ্যে আসি। দাবা খেলি। আমি থাকতাম একতলার চিলেকোঠায়। সন্ধ্যার সময় উনি একটা দাবার বোর্ড আর দাবার একটা বই নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে আমার চিলেকোঠায় উঠে আসতেন। বলতেন, তুই তো ভালোই খেলিস রে। এই বইটা পড়। কিন্তু দাবায় আমার আগ্রহ ছিল না।

শিবব্রত: অন্যরা তো খেলতে আসত আপনাদের বাসায়। তরুণ আবদুর রাজ্জাকের (পরে জাতীয় অধ্যাপক) দাবা খেলতে আসার স্মৃতি কি আপনার মনে আছে?

কাজী আনোয়ার হোসেন: আমি যখন দাবা শিখে নিয়েছি, তত দিনে উনি (আবদুর রাজ্জাক) আর তরুণ নন। রীতিমতো বয়স্ক। উনি আমাদের বাসায় খেলতে আসতেন কম। ওনারা তো বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবেই বেশি খেলতেন। একবার একটা প্রতিযোগিতায় আমি নাম দিয়েছিলাম আব্বার চাপাচাপিতে। উনি ১২ চালে আমাকে খতম করে দিলেন।

শিবব্রত: আবদুর রাজ্জাক আপনাকে ধরাশায়ী করে দিলেন? খেলোয়াড় হিসেবে তাহলে তো তিনি খুবই ভালো ছিলেন!

কাজী আনোয়ার হোসেন: রীতিমতো ভালো খেলতেন।

শিবব্রত: আপনার বাবা বেশি ভালো খেলতেন নাকি রাজ্জাক সাহেব?

কাজী আনোয়ার হোসেন: আব্বা তো চ্যাম্পিয়ন হতেন সব সময়। তো, রাজ্জাক সাহেব ১২ চালে আমাকে হারিয়ে দেওয়ায় আমি অবাক। বললাম, মাত্র ১২ চালে আপনি আমাকে হারিয়ে দিলেন? উনি বললেন, তোমাদের কাছে আমি বাঘ। কিন্তু ওনার (কাজী মোতাহার হোসেন) সঙ্গে খেলি না, মানে পারি না। পারি না কেন? কারণ ওনার জেতার অভ্যাস হয়ে গেছে। হেরে গেলে উনি এত কষ্ট পান...

শিবব্রত: রাজ্জাক সাহেব কি ইচ্ছা করে আপনার বাবার কাছে হারতেন নাকি? হাজার হলেও আপনার বাবা তাঁর শিক্ষক ছিলেন তো...

কাজী আনোয়ার হোসেন: না। আমার আব্বা তো আর পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছিলেন না। সিনিয়র ছিলেন। তো, রাজ্জাক সাহেব আমাকে হারিয়ে দিলে বাসায় এসে আমি বললাম, হেরে গেলাম। আব্বা বললেন, দেখা তো, কীভাবে হারলি। দেখালাম। বললেন, দূর! তুই তো একটা ট্র্যাপে পড়ে হেরেছিস। খেলে হারায়নি তোকে। তুই তো জানিস না এটা একটা ট্র্যাপ। ওপেনিং কয়েকটা ট্র্যাপ থাকে না? ওগুলোর একটায় পড়ে গিয়েছিলাম।

শিবব্রত: গান কি এখন আপনার অবসর কাটানোর উপাদান?

কাজী আনোয়ার হোসেন: ইউটিউবে গান আর দাবার চালগুলো দেখি। ওগুলো দেখতে ভালো লাগে।

শিবব্রত: বই পড়া?

কাজী আনোয়ার হোসেন: আমার যেসব কাজে লাগবে বা আমার প্রকাশনীর জন্য কাজে লাগবে, সেগুলো ছাড়া বেশি বই পড়ি না। এখন তো বেশি সময়ও নেই হাতে। যেমন ইয়েশুদাসের ওই গানটা (যাব দীপ জ্বালে যা না) নিয়ে বেশ কিছুদিন আনন্দে কাটালাম। গানটার ভেতরেই বাস করলাম। একটা ছবি আছে না পাড়োসান, সেটার মজার গানগুলো বাদ দিলে একটা গান আছে, সায়রা বানু যখন সারেন্ডার করছে, কথাটা এ রকম: আজ আমাকে কথাটা বলতেই হবে।

শিবব্রত: শারম আতি হ্যায়, ম্যাগার আজ হয়ে ক্যাহনা হোগা...

কাজী আনোয়ার হোসেন: হ্যাঁ। হঠাৎ সেদিন শুনে...(কাজীদা গানটি গাইতে শুরু করলেন)। গানটা এমনিতে বহুবার শুনে গেছি। কিন্তু সেদিন হঠাৎ করেই হিট করল।

শিবব্রত: আপনার মাছ ধরার অভ্যাস গেল কোথায়?

কাজী আনোয়ার হোসেন: মাছ ধরায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম একসময়। আমার পাগল হতে সময় লাগে না, ছাড়তেও সময় লাগে না।