
মাসরুর আরেফিন
প্রকাশক: কথাপ্রকাশ, ঢাকা,
প্রকাশকাল: মার্চ ২০২২
প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল
২১০ পৃষ্ঠা, দাম: ৩৫০ টাকা।
তালতলী বাজারে এসে রিকশা থামল। তালতলীর নদীটার কুলকুল শব্দ শোনা যাচ্ছে কান খাড়া করলেই। জাহেদ তার বাবার কাছ থেকে শিশি-বোতলটা চেয়ে নিল এবং শরীর টানটান করে দাঁড়াল পাশের দোকানের সামনে ঝুলতে থাকা কলার কাঁদিতে একটা হাত রেখে। দোকানদার বললেন, ‘দেহি, দেহি, ভাডিখানার জাহেদ না?’
জাহেদ লজ্জা পেয়ে গেল, বলল, ‘হুম’। তার বাবা দোকানিকে বললেন, ‘আমার ছেলেকে চেনেন?’
দোকানি বললেন, ‘চিনমু না? লালটু হিরুরে কেডায় না চেনে? লালটু হিরু এইহানে আহে কাগাসুরা রোডে নদীর নামায় এত্ত বড় লাডির মাতায় আডা লাগাইয়া ফড়িং ধরতে। হা-হা-হা। দ্যাহেন দ্যাহেন, ওই যে আপনের পোলার হাতে এহনও ফড়িং আডকাইয়া রাহোনের বুতোল।’
জাহেদ তাকে বলতে চাইল—ভুল, এটা ফড়িং রাখার বোতল না, এটা আড়িয়াল খাঁর বিশেষ এক পানি ধরার জাদু-আয়োজনের অংশ।
নৌকা রওনা দেবে দেবে। বড় নৌকা। জাহেদ তার বাবাকে বলল, ‘এত বড় নৌকা, বাবা?’ বাবা বললেন, ‘গয়নার নৌকা।’ জাহেদ তাকিয়ে দেখতে লাগল ওই পেটমোটা, কিছুটা চালকুমড়া ধাঁচের নৌকাটাকে। নৌকার ছইতে ওরা দুটি বড় বিড়ালের ছবি এঁকে রেখেছে। তখনই ছোট কাকা বাসেত নামের লোকটাকে চিল্লিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নৌকা ছাড়মু? ইলতুমিশ কাকায় দোয়া পাডাইছে?’
জাহেদ খেয়াল করল তিনি ইলতুতমিশকে বলেছেন ‘ইলতুমিশ’। আশ্চর্য! বাসেত শরীর টানটান করে দাঁড়ালেন মাস্তুলের পাশে, পাশের দড়িতে হাত রাখলেন আর নদীর অন্ধকার গর্ভের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘দোয়া লইয়া আর কী হইবে? সব ভ্যাজতাইয়া গেছে।’
জাহেদ ভাবতে লাগল, কী ভেস্তে গেছে? কী? তার হাতে তো বোতল, পকেটে তাবিজ, মনের মধ্যে দোয়া—সবই আছে। তাহলে? শুধু আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে না; উল্টো আকাশের দেশের পেছন দিকের মেঘের গম্বুজগুলো থেকে একটু পরপর গুড়ুম-গুড়ুম শব্দ আসছে, ওগুলো এমন যে ওই শব্দ যেন এই পৃথিবীতে ঘটছে না, ঘটছে দূর–আকাশের দেশে, যেখানে আছে একই রকম নদীওয়ালা আরেক পৃথিবী। জাহেদের তবু বিশ্বাস, আড়িয়াল খাঁ আসতে আসতে আকাশে তারা ফুটবেই।
জাহেদ বুঝতে পারল, নৌকা বড় নদীর কাছাকাছি চলে এসেছে। উত্তেজনায় তার বুক এতটাই দুরুদুরু করতে লাগল যে মনে হলো বুকটা গলা দিয়ে মুখ দিয়ে বের হয়ে হাতেই উঠে আসবে। সে দেখল, বাসেত বসে আছেন একটি ইটের লাইনের ওপরে—চার–পাঁচটা ইট একটার ওপর একটা রাখা স্তম্ভের মতো। জাহেদ বুঝতে পারল না বাসেতকে সে কী বলে ডাকবে, চাচা না ভাই? সে হড়বড় করে বলে বসল, ‘বাসেত ভাই চাচা, আমরা কি আড়িয়াল খাঁ আসছি? আর ওরা নৌকায় ইট নিয়া যাইতেছে? কী জন্য?।’
বাসেত বললেন, ‘ইট নিয়ে যাই আমারদিগের বইয়ের দোকান বানানোর কামে।’
জাহেদ বলল, ‘ইম্পসিবল।’ ইংরেজিতে ইম্পসিবল কথাটা বলে সে একরকম লজ্জাই পেয়ে গেল, তবু আবার বলল, ‘ইম্পসিবল। ত্রিশটা ইট দিয়া কোনো বইয়ের দোকান, কোনো দালান হয় না। আমরা কি আড়িয়াল খাঁ আসছি চাচা? সেইটা বলেন।’
হায়দার তখন নদীর পানিতে হাত ডুবিয়ে, যার ফলে জাহেদের কানে শব্দ এল একটা গড়গড় মতো, বললেন, ‘ওই দিকে তাকাও। তুমি উল্টা তাকাইয়া রহিয়াছ। আমরা এখন মধ্য চরবাড়িয়া পার হইলাম। আর তুমি তাকাইয়া রহিয়াছ জিয়াউর রহমান আছে যেইদিকে। প্রেসিডেন্টের জন্য এত মায়া! উইদিকে তাকাও। আমরা এখন পার হইতেয়াছি মধ্য চরবাড়িয়া। এখন নদীর দুই পাশে খালি আমরুল, জারুল আর গাওছা লতা আর খালি বনচাইলতা। আমার এইসব মুখস্থ। একটু পরে নদী যাইবে কান্নি খাইয়া হালকা ডাইনে। আর তহন শুরু হইবে তেলাকুচ, তেল, জিকা আর গাব—গাব আর গাব। নারিকেল ও শুফারি তো থাকিবেই। ওই গাবের ঝাড় যেই শ্যাষ হইবে, তুমি বোঝবা যে আড়িয়াল খাঁ আসিয়া গেছ। ওই যে তাকাও, তাকাও।’
এদিকটায় এত হইচই শুনে জাহেদের বাবা ছইয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। বৃষ্টি তখনো গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ছে। তিনি বেরিয়েই বললেন, ‘সর্বনাশ। জাহেদের তো জ্বর আসবে। হায়দার তুমি কী? তুমি দেখো না বৃষ্টি হচ্ছে?’
জাহেদ বলল, ‘বাবা, আমি এই দিকে। বাবা, ওমর আলী চাচা তোমারে জবাই দিতে নৌকায় আনছে। বাবা আমি বস্তা দেখছি, দা দেখছি, ইট দেখছি। ইটের উপরে বসা বিছা মণ্ডল আর দুই ছেলে। বাবা তুমি ওমর চাচারে জিগাস করো ওরা কারা?’
তখনই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো, একদম হালকা গুঁড়ি থেকে গুঁড়ি, আর জাহেদ দেখল দূরে সামনে কিছুটা আলো-আলো—এক বিশেষ আলোর তিন–চার ধাপ মতো জিনিসটাকে এই একবার মনে হচ্ছে যে ওটা তার দিকে আসছে, আবার মনে হচ্ছে তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
ওমর আলী ছইয়ের ভেতরেই বসে আছেন। হায়দার জাহেদের সামনে দাঁড়িয়ে এবার তাকে বললেন, ‘এই যে আড়িয়াল খাঁ।
জাহেদ আড়িয়াল খাঁ দেখেই সব ভুলে গেল এক মুহূর্তের জন্য। সে শুধু মনে মনে বলল, ‘বাব্বা, কত্তো বড় নদী।’ আর সে তাকাল আকাশের দিকে। দেখল, তারাগুলো সেখানে স্থির হয়ে ফুটে আছে। কী করে তারাগুলোকে তাদের জায়গা থেকে নড়ানো যায়, নড়িয়ে এই নদীর পানিতে এনে ফেলা যায়, তা সে জানে না। সে খুব হতাশা বোধ করতে লাগল, কিন্তু ঠিকই মনে জোর নিয়ে গলা খুলে বলে উঠল, ‘বাবা, আড়িয়াল খাঁ।’
জায়েদের বাবা বলতে লাগলেন, ‘হ্যাঁ বাবা, আড়িয়াল খাঁ, হ্যাঁ বাবা, আড়িয়াল খাঁ। ওই দ্যাখো লঞ্চ যায়।’
নদীর কালো পানি ভয়ানকভাবে কাঁপছে তখন। সেই কাঁপন থেকে তাদের নৌকা দুলছে কোনো বেতবনের বেতগাছের মাথার মতো করে। এবার পাশের বড় ইঞ্জিন নৌকা থেকে বড় বড় টর্চের আলো ফেলা হলো তাদের নৌকায়, আর এক লোক ওখানে দাঁড়িয়ে মুখে মাইক লাগিয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন নানা প্রশ্ন।
‘কার নৌকা এইডা?’
ছোটকাকা চার-পাঁচটি টর্চের আলোর সামনে পড়ে তার চোখ দুটো হাত দিয়ে ঢেকে উত্তর দিলেন, ‘ইলতুতমিশের নৌকা। আমনেরা কারা?’
ওই নৌকা থেকে সেই লোক বললেন, ‘আমরা নৌ-পুলিশ। তোমরা কই যাও?’
ছোট কাকা বললেন, ‘আমরা এই নদীর উজানে আট হাজার যাই। ওইহানকার থানা চারঘাটার কাছের একটা চরে যাই।’
‘সেইটা আজকে ক্যানো যাও? আজকে দেশের প্রেসিডেন্ট মারা গেছে, আজকে এই দিকে ক্যানো?’
ছোট কাকা কী উত্তর দেবেন বুঝতে পারলেন না। আবার বাঁশির আওয়াজ উঠল বিরাট। আর পুলিশের প্রশ্ন উড়ে এলো এই দিকে, ‘নৌকায় বাচ্চা ছেলে এইডা কেডা? সে ক্যান চরে যায়?’
বইটি অচিরেই বইমেলায় প্রকাশিত হবে।