অল্প কথায়

ওমর

ওমর চলচ্চিত্রের দৃশ্য
ওমর চলচ্চিত্রের দৃশ্য

ওমর ছবিটির একটি দৃশ্য এই রকম: নাদিয়া, গল্পের নায়িকা, স্কুল থেকে ঘরে ফিরছে। হাতে বই, পরনে স্কুলের পোশাক। ওমর তার সদ্যযুবা প্রেমিক, ইশারায় ডেকে নেয় তাকে। শূন্য ও অব্যবহৃত একটি ঘরে তারা–শুধু দুজন। চতুর্দিকের উন্মুখ চোখ এড়িয়ে তাদের কথা বলার সুযোগ নেই। হয় চোখে চোখে, নয়তো গোপনে পত্রালাপ তাদের সংযোগের একমাত্র পথ। তবে দুজনে এখন এত কাছাকাছি, অনায়াসে আলিঙ্গন সম্ভব, সম্ভব চুম্বনও। তবু দুজন দূরত্ব বজায় রাখে। ওমর অর্থাৎ ছেলেটি জানায়, নাদিয়াকে বিয়ে করতে চায় সে৷ মেয়েটি দুষ্ট হাসিতে জিজ্ঞেস করে, বিয়ের পরে মধুচন্দ্রিমায় কোথায় নিয়ে যাবে? ছেলেটির তাৎক্ষণিক জবাব, মোজাম্বিক। বিস্মিত মেয়েটি বলে, মোজাম্বিক? বাংলাদেশ নয় কেন? ঠোঁটের কোনায় সাহসী হাসি জমিয়ে ছেলেটি বলে, ‘ওদের এমনিতেই অনেক দুর্যোগ, সেখানে বিপদ বাড়িয়ে কাজ নেই।’ ছেলেটি ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে, মেয়েটির কপোল থেকে বেয়াড়া একটি বা দুটি চুল সরিয়ে দেয়। হঠাৎ মেয়েটি ছেলেটির গালে ছোট্ট একটি চুমো দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।
বিস্মিত আনন্দিত সুখী ওমর তার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।

হানি আবু আসাদ

ওমর নামের সোয়া দুই ঘণ্টার এই ফিলিস্তিনি চলচ্চিত্রে শুদ্ধ সুখী মুহূর্ত সম্ভবত এই একটিই। চারদিকে দীর্ঘ পাঁচিল, রাস্তার কোনায় কোনায় খোলা বন্দুক নিয়ে টহলরত ইসরায়েলি সেনা। যেকোনো সময়, যাকে ইচ্ছা জেলে পুরতে পারে। এই যে কঠিন, দুর্মর পৃথিবীতে ফিলিস্তিনিদের বাস, সেখানেও প্রেম আকস্মিক পুষ্পের মতো ফোটে। অযত্নে, বিরুদ্ধ আবহে সে প্রেমও শুকিয়ে যায় অথবা উন্মত্ত আগ্রাসী বরাহের পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে তার মৃত্যু হয়। যেমন ঘটে এই চলচ্চিত্রে।
হানি আবু আসাদ পরিচালিত ওমর ছবিটি এ বছর শ্রেষ্ঠ বিদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে অস্কার প্রতিযোগিতায় মনোনীত হয়েছিল। যাঁরা কট্টর ফিলিস্তিনবিরোধী, অথবা ইসরায়েলপন্থী, তাঁরাও স্বীকার করেছেন, চলচ্চিত্র হিসেবে ওমরকে তার যোগ্য স্থান দিতেই হবে৷ কাহিনিতে আছে অধিকৃত অঞ্চলের মানুষের গল্প, ফলে রাজনীতি এর প্রধান অনুষঙ্গ; যদিও সেটি এই ছবির পশ্চাদ্ভূমি মাত্র। ওমর-এর আসল গল্প প্রেম, পতন, বিশ্বাসঘাতকতা ও উদ্ধার নিয়ে। শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজেডির সব উপাদানই এখানে বর্তমান। যাকে আমি উদ্ধার অর্থাৎ রিডেম্পশন বলছি, কারও কারও কাছে তা অবশ্য আরোপিত সমাপ্তি মনে হয়েছে।
খুব সংক্ষেপে গল্পটি এই রকম: তিন বন্ধু তারেক, আমজাদ ও ওমর। পশ্চিম তীরের এই তিন যুবক আক-আকসা বিগ্রেডের সদস্য। ইসরাইয়েলি অবরোধ ও নিবর্তন তাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা। সেই নিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই—এটি এই অধিকৃত অঞ্চলের মানুষের প্রতি মুহূর্তের প্রতিটি নিঃশ্বাসের ভাবনা। এরই মধ্যে জন্ম নিল প্রেম। তারেকের বোন নাদিয়ার পাণিপ্রার্থী ওমর। আমজাদও নাদিয়াকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, যদিও সে স্বপ্নের সঙ্গে ছবিতে পরিচয় ঘটে না আমাদের। নাদিয়ার সঙ্গে আমাদের প্রথম দেখা তারেকের বাসায়। সেখানে চা দেওয়ার সময় পিরিচের নিচে চিরকুট রেখে যায় মেয়েটি। (জহির রায়হানের কাচের দেয়াল যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা এই দৃশ্যের সঙ্গে নৈকট্য খুঁজে পাবেন।) চতুর্দিকে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা পশ্চিম তীর, সে দেয়ালের পেছন থেকেই হয় চোরাগোপ্তা হামলার পরিকল্পনা। তারেক দলপতি, তার নির্দেশে আমজাদের গুলিতে একজন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত হওয়ার পর অপরাধী সন্দেহে গ্রেপ্তার হয় ওমর। বন্দিশালার অকথ্য নির্যাতনের পর ইসরায়েলের চর হিসেবে কাজ করতে রাজি হয় সে। সেখানেই ইসরায়েলি গোপন পুলিশের এজেন্ট হানি তাকে জানায়, নাদিয়ার সঙ্গে তার প্রেমের কথা তাদের অজানা নয়। এমনকি আমজাদের সঙ্গে যে নাদিয়ার মাখামাখি আছে, সে খবরও তারা জানে। যদি নাদিয়ার সঙ্গে ওমর মিলন চায় তবে তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে হবে। তারেকের খোঁজ এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পায় ওমর। নাদিয়ার সঙ্গে মিলন হবে—বুকে এই আশা তার। কিন্তু বাইরে এসে দেখে সবাই, এমনকি নাদিয়াও তাকে সন্দেহ করছে চর হিসেবে। একদিন নাদিয়া ও আমজাদকে একসঙ্গে দেখে সন্দেহ গভীর হয় তার মনে। এ অবস্থায় আমজাদের মুখোমুখি হয় ওমর, গলা টিপে ধরে আমজাদের। ওমরের জিজ্ঞাস্য, নাদিয়ার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? জেরার মুখে আমজাদ এবার বলতে বাধ্য হয় নাদিয়ার সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্কের কথা। বলে যে নাদিয়ার গর্ভে বেড়ে উঠছে তার সন্তান। হতবাক হয়ে পড়ে ওমর। তার বিস্ময় আমজাদের বিশ্বাসঘাতকতায় ততটা নয়, যতটা নাদিয়ার মিথ্যাচারে। যে কিশোরীকে নিয়ে একদিন স্বপ্ন দেখেছিল রূপকথার রাজ্য গড়ার, নিজ হাতে তাকে সে তুলে দেয় আমজাদের হাতে। গল্পের পরিণতি হয় ইসরায়েলি সেনার হাতে তারেকের মৃত্যু ও ওমরের হাতে ইসরায়েলি এজেন্ট হানির হত্যার মধ্য দিয়ে।
পুরো কাহিনিটি গোয়েন্দা গল্পের মতো—একদিকে একাধিক খোসায় ঢাকা রহস্য, অন্যদিকে ঘটনার ক্ষিপ্রতা৷ সব মিলিয়ে ছবিটি দর্শককে শ্বাসরুদ্ধ করে রাখে। ইসরায়েলি সেনার বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা হামলার শেষে ওমর পালাচ্ছে, পশ্চিম তীরের সরু গলি, পাথুরে পথ, পেছনে ছুটে আসছে সেনা কমান্ডো।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে আমরা এই প্রার্থনা নিয়ে বসে থাকি, যেন কিছুতেই ধরা না পড়ে ওমর। এই ছবির সূত্র ধরে আমাদের জানা হয়ে যায় নিত্যদিন খোলা বেয়নেটের মুখে কীভাবে কাটে ফিলিস্তিনিদের দিন ও রাত। এক মুহূর্ত স্বস্তি নেই, যেকোনো সময় যেকোনো ঘরের দরজা যেতে পারে বুটের আঘাতে ভেঙে। অবস্থা এমন, মন খুলে কারও সঙ্গে দুটো কথা বলাও কঠিন। চারদিকে গিজগিজ করছে ইসরায়েলি চর, যেমন ওমর নিজেও।
জেলখানা থেকে বেরোনোর আগে তার শরীরে বেঁধে দেওয়া হয় গোপন যন্ত্র; কখন সে কোথায় যায়, কার সঙ্গে কথা বলে, যন্ত্রের মাধমে সবই জানা হয়ে যায় ইসরায়েলের৷ নাদিয়া ও আমজাদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানতে পেরে ওমর নিজেই তাদের বিয়ের উদ্যোগ নেয়। তারেককে এ কথা জানাতে যেদিন তাদের গোপন আস্তানায় দেখা হয় তিনজনের, অকস্মাৎ হামলা হয় ইসরায়েলি বাহিনীর। হয়তো ওমরের শরীরে লুকানো যন্ত্র থেকেই এই সাক্ষাতের খবর মিলেছিল। অথবা আমজাদের কাছ থেকে, কারণ সেও তো একজন ইসরায়েলি চর।
তারেকের মৃত্যুর পর ইসরায়েলি বাহিনীর বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে ওমর। হানির কাছে আবদার জানায়, তার একটি রিভলভার প্রয়োজন। হানি নিজ হাতে ওমরের হাতে তুলে দেয় সে বন্দুক। তবে ওমর বন্দুক চালাতে জানে না, এমন ভান করলে হানি তাকে ট্রিগার টিপে দেখায় কী করে গুলি চালাতে হয়। গুলিভরা বন্দুক হাতে নিয়ে ওমর এবার সেটি তাক করে হানির দিকে।
এখানেই ছবির সমাপ্তি। স্পষ্টতই, গল্পের এই সমাপ্তি শুধু যে ওমরের শুদ্ধির খাতিরে তা নয়, ফিলিস্তিনিদের স্বপ্নপূরণের জন্যও। এই ছবির যদি কোনো খুঁত থাকে, তা এই আরোপিত স্বপ্নপূরণে।
চলচ্চিত্রটির পরিচালনা-প্রযোজনা থেকে এর অভিনয় ও সব কারিগরি কাজের ৯৫ ভাগই করেছেন অধিকৃত পশ্চিম তীরের শিল্পী ও কর্মীরা। পরিচালক হানি আসাদ ও প্রধান প্রযোজক আবু আসাদ, দুই ভাই, তাঁরাও ফিলিস্তিনি, তবে স্থায়ীভাবে মার্কিন মুলুকের বাসিন্দা। আট বছর আগে তাঁর ছবি প্যারাডাইস নাও-এর জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছিলেন তিনি। ওই ছবিও মনোনীত হয়েছিল অস্কার পুরস্কারের জন্য। প্যারাডাইস নাও ছবিতেও দেখি অবরোধের মুখে ফিলিস্তিনিদের নিরন্তর লড়াই। আর এরই ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টির মতো প্রেম, অবোধ স্বপ্ন, দুরন্ত আশা—বিদ্যুতের ঝলকের মতো জ্বলে উঠে আবার নিভে যাওয়া।
সংগ্রামরত যেকোনো জাতির লেখক-শিল্পীদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব নিজেদের লড়াইয়ের কাহিনি ওই জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত স্মৃতি ধরে রাখা। ফিলিস্তিনের নবীন চলচ্চিত্রকারেরা সে দায়িত্ব যোগ্যতার সঙ্গে পালন করছেন, ওমর ছবিটি দেখে অনায়াসেই জন্মে এমন প্রত্যয়।