বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসে

রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি দিন

১৯২৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান হাউসের সামনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রমেশচন্দ্র মজুমদার ও অপূর্ব চন্দ
১৯২৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান হাউসের সামনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রমেশচন্দ্র মজুমদার ও অপূর্ব চন্দ

বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউস ঢাকার এক ঐতিহাসিক ভবন। আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বহু মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনার সঙ্গে এ ভবনের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। আমাদের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের এক পর্যায়ে সরকারি বাড়ি হিসেবে নির্মাণ করা হয় এই ভবনটি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। ফলে তৎকালীন ঢাকা শহরের উত্তর প্রান্তের নয়নাভিরাম রমনা এলাকাকে রাজধানীর কেন্দ্রীয় অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নির্মাণ করা হয় অনেকগুলো সুবৃহৎ বাড়ি ও সরকারি ভবন। কিন্তু ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর ঢাকা প্রাদেশিক সরকারের রাজধানীর মর্যাদা হারায়। পূর্ব বাংলার প্রভাবশালী মুসলিম নেতারা বিশেষ করে ঢাকার নবাবদের বঙ্গভঙ্গ রদজনিত অসন্তুষ্টি দূর করার লক্ষ্যে ইংরেজ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং বছরে একবার গভর্নরের তিনজন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলরের ঢাকায় একবার সভা করার ব্যবস্থা করে। ওই তিনজন সদস্য ঢাকায় এলে যাতে থাকতে পারেন সে জন্য সরকারিভাবে তৈরি করা হয় তিনটি বাড়ি। ওই কাউন্সিলের তিনজনের মধ্যে ছিলেন বর্ধমানের মহারাজা প্রতাপচন্দ্র মহতাব, জনাব শামসুল হুদা এবং ইংরেজ সদস্য হুইলার সাহেব। এই তিন সদস্যের নামে বাড়ি তিনটির নামকরণ করা হয়। বর্ধমানের মহারাজা থাকতেন বলেই বর্তমান বাংলা একাডেমির মূল ঐতিহ্যবাহী ভবনটির নামকরণ করা হয় বর্ধমান হাউস।
বর্ধমান হাউস বাংলা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এই ভবন ছিল এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাসভবন। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড. কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ এই ভবনে বসবাস করেছেন। এবং এই দুই প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ পণ্ডিতের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন বাংলার দুই মহান সাহিত্যস্রষ্টা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল ইসলাম যে এই ভবনে ছিলেন সে সম্পর্কে প্রায় সবাই অবহিত। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবও যে বাংলা একাডেমিতে অবস্থান করেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও প্রখ্যাত শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বর্ধমান হাউসে তোলা ছবিতেই আমরা সেটি প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও যে বর্ধমান হাউসে কয়েক দিন অবস্থান করেছেন সে সম্পর্কে কোনো রবীন্দ্রগবেষক এ পর্যন্ত আলোকপাত করেননি। এবং বর্ধমান হাউসে কবির অবস্থানের প্রমাণ হিসেবে এ সংক্রান্ত কোনো ছবিও কেউ উপস্থাপন করেননি। আমরা সেই অনালোচিত অধ্যায়ের ওপর কিছুটা গবেষণা করেই বর্ধমান হাউসে তাঁর অবস্থানের তথ্যাদি এবং একটি ছবি উপস্থাপন করে এই লেখাটি সম্পন্ন করতে প্রয়াসী হয়েছি।
বর্ধমান ভবনের রাজনৈতিক গুরুত্বের কথা সবাই অবহিত। এখানে বাস করেছেন পূর্ব বাংলার এককালের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন (পরবর্তীকালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল) ও মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে এই ভবনের সম্পর্কের কথাও বিশদভাবে পুঁথিপুস্তক থেকে জানা যায়। আসলে রাজনীতির সংস্কৃতি ও সংস্কৃতির রাজনীতির ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অসাধারণ। এ বিষয়ে এ লেখায় বিশদভাবে আলোচনার সুযোগ নেই। আমরা শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বর্ধমান হাউসে একসময়ে অবস্থান করেছেন, সেই ঐতিহাসিক ঘটনাটির প্রতি আলোকপাত করব।

২.
রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় এসেছেন দুবার। প্রথমবার এসেছিলেন ১৮৯৮ সালে। ওই সফরের বিষয়টিও আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ ওই সময়ে বর্ধমান হাউস প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অতএব তখন বর্ধমান হাউসে তাঁর থাকার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা অনুসন্ধান করেছি বর্তমান বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কি না, এ বিষয়টি নিয়ে। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন দ্বিতীয়বার ঢাকায় আসেন তখন এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি হিসেবে। সেই সুবাদেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের তৎকালীন প্রভোস্ট ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের (আর. সি. মজুমদার হিসেবে খ্যাত) বাসভবন বর্ধমান হাউসে কয়েক দিন অবস্থান করেন তিনি। এ ছাড়া ঢাকার নবাবদের অতিথি হিসেবে বুড়িগঙ্গা নদীতে তুরাগ হাউস বোটেও ছিলেন কয়েক দিন।
রবীন্দ্রনাথের ঢাকায় আসার ব্যাপারটি নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি কোথায় থাকবেন এবং তাঁর সফরসঙ্গীদের অবস্থান কোথায় হবে, সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য মি. ল্যাংলি রমেশচন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে আলোচনায় যা বলেন সে সম্পর্কে লেখা আছে একটি প্রামাণ্য বইয়ে: ‘মি. ল্যাংলি বলেন, “ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে আমার বাড়িতেই ড. টেগোরকে সম্মানিত অতিথি করে রাখা উচিত। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই যে, আমরা ইউরোপীয়ানরা ঠিক আপনাদের মতোন করে কি ড. টেগোরকে আদর-আপ্যায়ন করতে পারব? আর আমাদের বাড়িতে থেকে তিনি হয়তো অসুবিধা বোধ করবেন। তারচেয়ে আপনি এক কাজ করুন, ড. টেগোরকে আপনার বাড়িতে রাখুন। আপনার স্ত্রী আছেন, তিনি কবির সেবাযত্ন করতে পারবেন।” রমেশ বাবু ল্যাংলির কথায় সানন্দে রাজি হলেন এবং এই কথা তিনি এক চিঠিতে কবিকে জানিয়ে দিলেন। কবি নিজে স্থির করেছিলেন, ঢাকায় গিয়ে তাঁর সম্পর্কীয় এক নাতনির বাড়িতে থাকবেন। কিন্তু রমেশ বাবুর চিঠি পেয়ে কবি তাঁকে জানালেন, “...তাহলে এ কথাই পাকা রইলো তোমার ওখানেই আশ্রয় নেব।” কিছু রঙ্গ করে বললেন, “...নাতনির অভিসারে যদি কখনো কখনো যাত্রা করি আশা করি তাহলে কোনো কথা ওঠবে না”’ (ঢাকায়রবীন্দ্রনাথ,গোপাল চন্দ্র রায়, পৃ. ২৭-২৮। গোপাল চন্দ্র রায়ের লেখা ঢাকায়রবীন্দ্রনাথবইয়ে ল্যাংলি সাহেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘ড. টেগোর’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন)।
রবীন্দ্রনাথের বর্ধমান হাউসে অবস্থানকালে একটি মজার কাণ্ড ঘটেছিল। এটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ড. মজুমদার ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে খুনসুটিও করেছিলেন। সে বর্ণনাও আছে রমেশচন্দ্র মজুমদারের আত্মজীবনীতে। তিনি লিখছেন, ‘আমার ছেলের নাম অশোক, ডাকনাম রবি। তার বয়স তখন নয়-দশ বছর হবে। আমরা সকলে সাবধান করে দিয়েছিলাম যতদিন রবীন্দ্রনাথ আমার বাড়িতে আছেন তাকে যেন কেউ রবি বলে না ডাকে। ছেলেকেও সে কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিনেই আমার ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম কি? সে বলে বসলো—রবি। তখন তিনি গম্ভীরভাবে আমাকে ও আমার স্ত্রীকে ডেকে বললেন, তোমরা তো ভালো লোক নও। আমরা তো কিছু বুঝতে না পেরে ভয়ানক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি। কি ব্যাপার? তিনি বললেন, আমি আসার আগেই আমার নামটা তোমরা চুরি করেছ। সুতরাং এরপর আরো নানা জনিস চুরি করতে পার। আমরা হেসে উঠলাম।’ (জীবনেরস্মৃতিদীপ, পৃষ্ঠা-৮৪) ।
উপর্যুক্ত তথ্যসমূহ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৬ সালে দ্বিতীয়বার ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের বাসভবন অর্থাৎ বর্ধমান হাউসে অবস্থান করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বর্ধমান হাউসে এই সংক্ষিপ্ত অবস্থান বর্ধমান হাউসে বিখ্যাত মনীষীদের অবস্থানের তালিকাকে এক অনন্য গৌরবে মণ্ডিত করেছে। বর্ধমান হাউসে তাঁর অবস্থানের আরেকটি একটি বিবরণ পাওয়া যায় ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত রমেশচন্দ্র মজুমদারের আত্মজীবনী জীবনেরস্মৃতিদীপ-এ। রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখছেন, ‘দোতলার যে ঘরে রবীন্দ্রনাথ থাকতেন তার ঠিক সামনে একটি আমগাছ ছিল। তখন গাছটি মুকুলে ভরে গেছে। সকালে চা পানের পর রবীন্দ্রনাথ ওই ঘরের বারান্দায় একটি ইজি চেয়ারে বসে থাকতেন। বলতেন, এভাবে বসে থাকতে ভারি ভালো লাগে। আমার বাড়ির বাগানে আরো অনেক গাছ ছিল। সমস্ত বাগান তখন ফুলের শোভা। বাগানে একটি পুষ্করিণীও ছিল। সবমিলিয়ে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তিনি উপভোগ করতেন।’ উল্লেখ্য, বর্ধমান হাউস তখন দোতলা ছিল। সামনে যে আমগাছের কথা বলা হয়েছে সে আমগাছটি এখনো আছে। আর পুষ্করিণীটি তো আছেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের দোতলার পশ্চিমাংশে ছিলেন, উপরোক্ত বর্ণনা থেকে সেটি প্রশ্নাতীতভাবেই বোঝা যায়।