১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিভাজন এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা, বিশেষ করে ইন্টারসার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স বা আইএসআইয়ের ব্যর্থতার বিষয়টি এখন সুবিদিত। তবে আইএসআই ছাড়াও পাকিস্তানের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একাত্তরকে কীভাবে দেখছিল, তা বোঝার অন্যতম দলিল হলো পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের গোয়েন্দা তথ্যের সারসংক্ষেপ এবং পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) পাক্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনগুলো। ১৯৭১ সালের এই ‘টপ সিক্রেট’ প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পাকিস্তানি প্রশাসন শুরুতে যে ‘স্বাভাবিকতা’র ধুয়া তুলেছিল, তা ক্রমেই কীভাবে একটি ভীতিপ্রদ ও বিশৃঙ্খল বাস্তবতায় পরিণত হয়েছিল।
এই দলিলগুলো কেবল ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ নয়, বরং একটি ‘দখলদার’ শক্তির মনস্তাত্ত্বিক পরাজয় ও প্রশাসনিক ধসের সাক্ষ্য। প্রাথমিক উৎস হিসেবে এসব গোয়েন্দা নথির দ্বান্দ্বিক অবস্থান লক্ষণীয়। একদিকে নথিগুলো পাকিস্তান সরকারের অফিশিয়াল ন্যারেটিভ বা রাষ্ট্রীয় বয়ান, যেখানে সচেতনভাবে সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে; অন্যদিকে এই দলিলের প্রতিটি ছত্রেই বাঙালির প্রতিরোধের অকাট্য প্রমাণ ছড়িয়ে আছে।
গোয়েন্দা নথিপত্রে আওয়ামী লীগের বিবর্তন একটি নাটকীয় উপাখ্যানের মতো। বছরের শুরুতে, অর্থাৎ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে গোয়েন্দা পুলিশের দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ ছিল একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, যারা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু ১ মার্চের পর থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন আসে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় পুলিশি রিপোর্টে দেখা যায়, রাষ্ট্রযন্ত্র স্বীকার করে নিচ্ছে যে তাদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তান চলছে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে।
২৫ মার্চের পর, যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করে, তখন গোয়েন্দা নথিতে আওয়ামী লীগ রূপান্তরিত হয় ‘নিষিদ্ধ’ এবং ‘দেশদ্রোহী’ শক্তিতে। তবে এই রূপান্তরের মাঝখানেও পুলিশ প্রশাসনকে স্বীকার করতে হয়েছে যে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামোই ছিল প্রতিরোধের প্রাথমিক ভিত্তি। গ্রামের পর গ্রাম ‘দুর্গ’ হিসেবে গড়ে তোলার যে নির্দেশ শেখ মুজিব দিয়েছিলেন, তা যে কেবল কথার কথা ছিল না, বরং বাস্তবেও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তা বিভিন্ন থানা আক্রমণের রিপোর্টে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রতিবেদনগুলোতে দক্ষিণপন্থী বা ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি), জামায়াত-ই-ইসলামী এবং মুসলিম লীগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে। পুলিশের বয়ানে এদের ‘দেশপ্রেমিক’ এবং সরকারের সহযোগী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। এপ্রিল মাসের শুরু থেকেই এই দলগুলো ‘শান্তি কমিটি’ গঠনের মাধ্যমে সামরিক প্রশাসনকে বেসামরিক মোড়ক দেওয়ার চেষ্টা করছিল। নুরুল আমিন, খাজা খয়েরউদ্দিন বা গোলাম আযমের মতো নেতাদের তৎপরতা, গভর্নর হাউসে তাঁদের ঘন ঘন বৈঠক এবং উপনির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতির কথা প্রতিবেদনগুলোতে বারবার এসেছে।
অন্যদিকে এই প্রতিবেদনগুলোর একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে বামপন্থী ও কমিউনিস্ট দলগুলোর কার্যক্রমের বিশ্লেষণ, যা মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক ভিন্নমাত্রা উন্মোচন করে। গোয়েন্দা নথিতে বামপন্থীদের মূলত দুই ভাগে দেখা হয়েছে—মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী। প্রতিবেদনগুলোতে মস্কোপন্থী ন্যাপ (মোজাফফর) এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে আওয়ামী লীগের সহযোগী এবং ‘ভারতের দালাল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু পিকিংপন্থী বা মাওবাদী গ্রুপগুলোর (যেমন মোহাম্মদ তোয়াহার ইপিসিপি-এমএল, পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন বা সর্বহারা পার্টি) অবস্থান ছিল অত্যন্ত জটিল। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, এই গ্রুপগুলো পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর বিরোধী ছিল, কিন্তু একই সঙ্গে তারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতাসংগ্রামকেও ‘ভারতের সম্প্রসারণবাদ’ বা ‘বুর্জোয়া আন্দোলন’ হিসেবে দেখত। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে তোয়াহা বা আবদুল হকের মতো নেতারা নিজস্ব ‘মুক্তাঞ্চল’ গড়ে তুলেছিলেন এবং তাঁরা একই সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনী ও আওয়ামী লীগ—দুইয়ের বিরুদ্ধেই লড়াই করছিলেন। নোয়াখালী, পাবনা বা খুলনার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই ত্রিমুখী সংঘাতের চিত্র প্রতিবেদনগুলোতে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এটি প্রমাণ করে যে একাত্তরের রাজনীতি কেবল দ্বিপক্ষীয় ছিল না, বরং সেখানে শ্রেণিসংগ্রাম ও মতাদর্শিক সংঘাতের একটি তীব্র স্রোতও প্রবহমান ছিল।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিও এই রিপোর্টগুলোর পরতে পরতে মিশে আছে। হিন্দু সম্প্রদায়কে এই নথিতে ধারাবাহিকভাবে ‘সন্দেহভাজন’, ‘ভারতের চর’ বা ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ বলে চিত্রিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের দেশত্যাগ, ঘরবাড়ি লুণ্ঠন ও হত্যার ঘটনাগুলোকে অনেক সময় ‘দুষ্কৃতকারীদের কাজ’ বলে দায়সারাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে অথবা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিহারি বা অবাঙালি জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিয়ে পাকিস্তান প্রশাসনের উদ্বেগ ছিল প্রবল। মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন জায়গায় অবাঙালিদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে রেকর্ড করেছে। কিন্তু এই রেকর্ডিংয়ের ধরনটি ছিল একপক্ষীয়। সেখানে বাঙালি নিধনের ঘটনাগুলোকে লঘু করে দেখিয়ে অবাঙালিদের ওপর হামলাকে বড় করে দেখানোর একটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়, যাতে সেনাবাহিনীর নৃশংসতাকে ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষার’ মোড়কে বৈধতা দেওয়া যায়। তবু ঐতিহাসিক সত্য হলো, এই নথিপত্রগুলো প্রমাণ করে যে একাত্তরের সংঘাত কেবল সামরিক ছিল না, এটি ছিল তীব্রভাবে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত বিদ্বেষপ্রসূতও, যার শিকার হয়েছিল নানা সম্প্রদায়ের নিরপরাধ মানুষ।
একাত্তরের মে মাসের পর থেকে গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোর প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠে ‘মুক্তিফৌজ’ বা ‘মুক্তিবাহিনী’। পুলিশের পরিভাষায় তাদের ‘মিসক্রিয়্যান্টস’ (দুষ্কৃতকারী) বা ‘ইন্ডিয়ান ইনফিলট্রেটর’ বলা হলেও, তাদের অপারেশনের বিবরণ পড়লে বোঝা যায় যে তারা ছিল এক অপ্রতিরোধ্য গেরিলা শক্তি। দলিলগুলোতে দেখা যায়, মুক্তিবাহিনী কোনো প্রথাগত সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে বরং পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত হানছিল। তারা থানাগুলো আক্রমণ করে অস্ত্র লুট করছিল, রেললাইন ও ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করছিল এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে স্যাবোটাজ চালাচ্ছিল। এই ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পুলিশ প্রশাসনকে সর্বদা তটস্থ করে রাখত। পুলিশ রিপোর্টে যখন বলা হয়, ‘থানার পুলিশ ভয়ে পালিয়েছে’ বা ‘লঞ্চে করে এসে দুষ্কৃতকারীরা থানা জ্বালিয়ে দিয়েছে’, তখন তা কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি নয়, বরং এটি প্রমাণ করে যে গ্রামীণ জনপদে পাকিস্তান সরকারের কোনো কর্তৃত্ব অবশিষ্ট ছিল না।
এই কর্তৃত্বহীনতা মোকাবিলার জন্যই পাকিস্তান সরকার গঠন করেছিল রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের মতো বাহিনী। গোয়েন্দা নথিতে এই কোলাবোরেটর বা সহযোগীদের সাংগঠনিক গঠন, তৎপরতা এবং তাদের ওপর হামলার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র চেয়েছিল এদের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন সচল রাখতে। কিন্তু নথিপত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই কৌশলটি বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শান্তি কমিটির সদস্য এবং রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ফরিদপুর, খুলনা বা নোয়াখালীর মতো জেলাগুলোতে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানদের হত্যা বা তাঁদের বাড়িতে গ্রেনেড হামলার ঘটনাগুলো নিয়মিত পুলিশ রিপোর্টে উঠে আসত। এটি প্রমাণ করে যে সমাজে একটি ‘সিভিল ওয়ার’ বা গৃহযুদ্ধ চলছিল এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের স্থানীয় দোসরদের নিরাপত্তা দিতেও ব্যর্থ হচ্ছিল। এই ব্যর্থতা সাধারণ মানুষের মনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ভীতিমিশ্রিত শ্রদ্ধা এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি অনাস্থা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
গোয়েন্দা নথিগুলোতে ধ্বনিযুদ্ধ বা ‘সনিক ওয়ার’ এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের এক অসাধারণ চিত্রও পাওয়া যায়। যুদ্ধ কেবল বন্দুকের নলে সীমাবদ্ধ ছিল না; শব্দ, গুজব, লিফলেট ও প্রতীকের মাধ্যমেও যুদ্ধটি পরিচালিত হচ্ছিল। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নিয়মিত রিপোর্ট করতেন যে শহরে বা গ্রামে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শোনা যাচ্ছে অথবা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। এই ‘শব্দ’ ও ‘দৃশ্য’ পাকিস্তান প্রশাসনের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা লিফলেট ছড়িয়ে সরকারি কর্মচারী ও পুলিশদের হুমকি দিত, যা একধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করত। পুলিশ রিপোর্টে ‘গুজব’-এর যে উল্লেখ পাওয়া যায়, তা আসলে ছিল পাল্টা তথ্যের প্রবাহ, যা পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রচারণাকে অকার্যকর করে দিচ্ছিল। রাতের অন্ধকারে গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দ, দেয়ালে লেখা স্লোগান কিংবা গোপনে বিলি করা প্রচারপত্র—সবই ছিল এই সনিক ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অংশ, যা পাকিস্তানি বাহিনীকে সব সময় এক অদৃশ্য আতঙ্কের মধ্যে রাখত।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এই ‘শত্রু-দলিল’ বা ‘হস্টাইল আর্কাইভ’ গুরুত্বপূর্ণ আকর হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। সামরিক-রাজনৈতিক সংঘাতকে ‘আইনশৃঙ্খলার সমস্যা’ হিসেবে তুলে ধরা এই দলিলাদি প্রমাণ করে, অন্ধ লেভিয়াথান তার পতনের পথে নিজের হাতেই সাক্ষ্যপ্রমাণ রেখে যাচ্ছিল।
* লেখক: খণ্ডকালীন শিক্ষক, আইইউবি