‘আমাদের আধুনিক’ আবুল হোসেন

চল্লিশের দশকে শীর্ষ বাঙালি মুসলিম কবিদের মধ্যে আবুল হোসেন ছিলেন অগ্রগণ্য। ১৫ আগস্ট এই কবির জন্মশতবর্ষ

আবুল হোসেন (১৫ আগস্ট ১৯২২—২৯ জুন ২০১৪)
ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

‘নিজের মনে কাজ করে গেছি। ফলের জন্য অপেক্ষা করিনি। যা দেখেছি, শুনেছি, জেনেছি, চিনেছি এবং যে আনন্দ, দুঃখ, বেদনা পেয়েছি, তার নীরব সাক্ষী এই সব কবিতা।’ কবিতা সংগ্রহ-এর ভূমিকায় কথাগুলো বলেছেন কবি আবুল হোসেন। পেরিয়ে যাচ্ছে তাঁর জন্মের এক শ বছর। কোনো শোরগোল নেই, উৎসবের উদ্দীপিত আলো নেই কিংবা আতশবাজির আলোড়ন নেই; কিন্তু বাংলাদেশের কবিতার তৎপর ভোক্তারা জানেন, আধুনিক কবিতার ইতিহাসে তিনি উজ্জ্বল একটি অবস্থান তৈরি করতে পেরেছিলেন।

শুরুটা হয়েছিল ১৯৪০ সালে। কলকাতা থেকে বেরিয়েছিল তাঁর প্রথম কবিতার বই নববসন্ত। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কালোত্তীর্ণ প্রতিভা রামকিঙ্কর বেইজ। ১৮-২০ বছরের আবেগে টইটম্বুর এই বই সেকালে কবি ও সমালোচকদের দৃষ্টি কেড়েছিল। কিন্তু কেন? ইশারা দিয়েছিল কি কবিতার অভিনবত্ব? কিংবা প্রথাগত কাব্যভাষা ভেদ করে দেখা দিয়েছিল আঙ্গিক ও প্রকরণের অভাবিত নিরীক্ষা?

দেখা যাবে, তিরিশি কবিতার মৃদু অনুরণন শোনা যাচ্ছে আবুল হোসেনের কবিতায়। শব্দ, ছন্দ ও অন্ত্যমিলের ধ্বনি মনে করিয়ে দিচ্ছে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দের কবিতাকে। আবার সেসব ছাপিয়ে উঁকি দিচ্ছে গদ্যের তরঙ্গও। কোথাও কোথাও মিশে যাচ্ছে গদ্য ও পদ্যের যুগল স্রোত। তবে শেষ পর্যন্ত বোধ হয় জয়ী হলো গদ্যের এলায়িত বিন্যাস। বাংলা কবিতায় এই প্রণোদনা জুগিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমিয় চক্রবর্তী ও সমর সেন। আর গদ্যের সেই ছন্নছাড়া বিন্যাসে আবুল হোসেন ছড়িয়ে দিলেন নাগরিক অভিজ্ঞতা ও বীক্ষণ। পূর্ব বাংলার কবিদের কাছে আন্তরিকভাবে গৃহীত হলেন তিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে কমে এল তাঁর কবিতার ভার। এই কবির নববসন্ত-এর স্মৃতি মনে রেখে খানিকটা আক্ষেপের সুরে তাঁর পরের প্রজন্মের কবি শামসুর রাহমান ১৯৫৩ সালে ‘পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক কবিতা’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আমরা সেই বসন্তকে উপেক্ষিত হতে দেখলাম।’

অন্য অনেকের মতো আবুল হোসেন বিপুল আর বিস্তৃতভাবে লেখেননি। তাঁর দ্বিতীয় বই বিরস সংলাপ প্রকাশ পেল অনেক অনেক বছর পর, ১৯৬৯ সালে। প্রথম বইয়ের প্রকাশকাল থেকে দ্বিতীয় বইয়ের দূরত্ব কয়েক দশক। তৃতীয় বই হাওয়া, তোমার কী দুঃসাহস-এর দেখা মিলল ১৯৮২ সালে। দীর্ঘ বিরতি সত্ত্বেও আবুল হোসেন কবিতার সঙ্গ ছাড়েননি; কবিতাও ছেড়ে যায়নি তাঁকে। প্রকৃতপক্ষে প্রেরণায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। আর তাই দৃঢ়ভাবে বলেছেন, ‘প্রেরণা ছাড়া আর যা-ই হোক, কবিতা হয় না। কবিতার প্রেরণা কবির কাছেই আসে।’

হয়তো সেই প্রেরণার বশেই আরও কিছু লেখা আমরা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে। কিশোর কবিতাসহ তিনি উপহার দিয়েছেন একরাশ অনূদিত কবিতা। তাঁর অন্যক্ষেতের ফসল নামের সংকলনে স্থান পেয়েছে ইয়েটস, ইকবাল, রবার্ট ফ্রস্ট, এজরা পাউন্ড, এলিয়ট, ল্যাংসটন হিউজ, জন ব্যারিম্যান, রসুল হামজাটফ প্রমুখ কবির কবিতা। আন্তভাষিক ও আন্তসাংস্কৃতিক সংযোগের পরিচয় বহন করে তাঁর এই সংকলন। প্রশ্ন হলো, শত বছরের এই আলোয় আমরা কীভাবে দেখব তাঁকে? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে ফিরে যেতে হবে দূর অতীতে।

বিশের দশকের গোড়ার কথা ভাবা যাক; কলকাতায় তখন উনিশ শতকী আধুনিকতার নতুন এক সম্প্রসারিত রূপ গড়ে উঠছে, রবীন্দ্র-বিরোধিতা যার একটি প্রধান অনুষঙ্গ। তত দিনে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দুটো বর্গ তৈরি হয়ে গেছে—বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান। আত্মপরিচয় নির্মাণের রাজনীতিতে বাঙালি মুসলমান তৈরি করতে চাইছে স্বতন্ত্র অবস্থান। তখন পর্যন্ত কলকাতাই থেকে গেছে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভূমিকায়; যদিও ‘পূর্ববঙ্গ’–এর পরিচয় সামনে রেখে ঢাকায় দেখা দিচ্ছে মৃদু উত্থান। ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী এই উত্থানকে রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রশ্রয়ও দিচ্ছে।

এই সব রাজনৈতিক কৃৎকৌশল সত্ত্বেও আমরা খেয়াল করব, মুসলমানদের সম্পাদনায় মোহাম্মদী, সওগাত প্রভৃতি প্রভাবশালী সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা থেকে। মূলত কলকাতাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠছিল বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক আধুনিকতা। তখন কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর আহমদ, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রমুখ তরুণ কবি ও লেখক ছিলেন মুসলমানের সাংস্কৃতিক ও নন্দনতাত্ত্বিক আধুনিকতার তরুণ প্রতিনিধি। তাঁদের লক্ষ্য ছিল নিজ সম্প্রদায়ের জীবন, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে সাহিত্যিক রূপকল্পে পরিবেশন করা।

কবিতায় এই ধারার তৎপরতা চালিয়েছেন শাহাদৎ হোসেন, গোলাম মোস্তফা প্রমুখ। ধারাটির বহুমাত্রিক সম্প্রসারণ ঘটেছে ফররুখ আহমদের কবিতায়।

কিন্তু তরুণতম কবি আবুল হোসেন গেলেন ভিন্নপথে। বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ের বদলে কবিতায় মুখ্য করে তুললেন উদারনৈতিক ও সম্প্রদায়নিরপেক্ষ বাস্তবতা। তাঁর কবিতায় উঁকি দিয়েছে এক প্রগতিবাদী মন। প্রকৃতপক্ষে এটিই ছিল বাংলা কবিতায় প্রভাবশালী ডিসকোর্স। জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে ও সমর সেনের মতো কবিরা এই ডিসকোর্সকে আশ্রয় করেই হয়ে উঠেছেন আধুনিক।

সেদিক থেকে বলা যায়, আবুল হোসেনের পথ স্বতন্ত্র কোনো প্রবাহ নয়। যেসব শর্ত মান্য করে আমরা কবিতাকে ‘আধুনিক’ অভিধায় চিহ্নিত করি, সেসব শর্তের অধীন বলেই আবুল হোসেন আমাদের কাছে আধুনিক। ভাষার প্রশ্নে তিনি চলতি পথের মুখের ভাষার রীতিকে যথাসম্ভব অনুসরণ করতে চেয়েছেন। আমরা দেখেছি, আধুনিকতাবাদীদের কেউ কেউ আলাপের ভঙ্গিকে কবিতায় ব্যবহারযোগ্য মনে করেছিলেন। অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা তার বড় প্রমাণ। বলা ভালো, আবুল হোসেনের কবিতায় কথ্যভঙ্গিমা থাকলেও আঞ্চলিক বা সামাজিক ডায়ালেক্টের প্রয়োগ প্রায় শূন্য।

আধুনিকতার প্রসঙ্গে টানা যায় আবুল হোসেনের নাগরিক চৈতন্যকে। জসীমউদ্‌দীন, বন্দে আলী মিয়া প্রমুখ কবির সুবাদে একসময় এমন ধারণা গড়ে উঠেছিল যে পূর্ব বাংলার কবিদের হাতে যা কিছু রচিত হয়, তা মূলত ‘গ্রাম্য’; পূর্ব বাংলার সাহিত্য বা কবিতা ‘পল্লি’র আবেগে ভরপুর। তবে আবুল হোসেনের কবিতা বহন করে চলল শহর পরিভ্রমণের চিহ্ন—হোক তা ঢাকা, কলকাতা কিংবা ব্যাংকক। কবিতার প্রেক্ষাপটকে তিনি স্থাপন করেছেন জাতিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরে। কখনো কখনো আধুনিকতার স্থানিক ও আঞ্চলিক পরিচয়কে ধূসর করে দিয়েছেন।

নাগরিকতার ভেতরই আমরা আবুল হোসেনকে দেখতে পাই বিচ্ছিন্ন মানুষ হিসেবে; যে বিচ্ছিন্নতা মধ্যবিত্তের শ্রেণিচরিত্রের বিরাট একটি অংশ। তিনি ব্যঙ্গ করেন তাঁর শ্রেণিস্বভাবকে। অবশ্য কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ তাঁকে আলোড়িত করে না। তাঁর সমকালীন অনেকেই মার্ক্সবাদে দীক্ষা নিলেও তিনি ছিলেন দীক্ষার বাইরে। তার বদলে তিনি দেখেন, শোনেন, বোঝেন, লেখেন এবং আত্মসত্তাকে আবিষ্কার করেন জটিল আর্থসামাজিক বাস্তবতায়। ‘মধ্যবিত্ত’ নামক ছোট্ট একটি কবিতায় আত্মঘোষণা দিয়ে লিখেছেন:

‘...আমাদের থাক এই ম’রে ম’রে

বেঁচে থাকা।

আমি ফাঁকা মধ্যবিত্ত এক।’

এমন মধ্যবিত্ত বলেই হয়তো বা পশ্চিমের আধুনিকতার ব্যাপারে তাঁর কোনো দ্বিধা বা প্রশ্ন নেই, প্রতিরোধের প্রস্তাবনা নেই। অথচ ঔপনিবেশিক সমাজ ও সংস্কৃতির দহন এবং দায় পরিগ্রহণ করে বারবার তিনি খুঁজেছেন নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন আত্মকে।

এই আত্মসচেতনতা, সামষ্টিক বিপন্নতায় নিজেকে খুঁজে পাওয়ার তাগিদ আধুনিকতার এক আদি শর্ত। আবুল হোসেনের তরফ থেকে পূর্ব বাংলার মুসলমানের জন্য সম্ভবত এটিই ছিল সবচেয়ে বড় উপহার। আর আজও তাই বাংলাদেশের কবিতায় তিনি হয়ে আছেন ‘প্রথম আধুনিক’ কিংবা ‘আমাদের আধুনিক’। কারা এই ‘আমরা’? পূর্ব বাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান? কোনো বিশেষ সম্প্রদায়? পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক, স্থানিক, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক পরিচয় ধারণ করে এই ‘আমরা’ বাংলাদেশ বলে একটি ভূখণ্ডকে গভীর আবেগে বরণ করে নিয়েছি।

‘প্রথম আধুনিক’–এর আখ্যান যা-ই হোক না কেন, সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের কবিতায় আধুনিকতার হদিস পেতে গেলে আবুল হোসেনের সঙ্গে পাকাপোক্ত একটা হিসাব করেই নিতে হয়। আধুনিকতার পুরোনো বসন্তের খোঁজে বেরোতে গেলেই নববসন্তের ডাক পড়ে; সেই ডাকে সাড়া না দিয়ে পারি কি?