
কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাস্তবে খুবই দিলখোলা আর বড় মনের মানুষ ছিলেন। আড্ডা-আলাপে ছিলেন দারুণ রসিক। তবে একটা জায়গায় এই লেখক ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রম, তাঁর ছিল সীমাহীন জেদ। জেদের বশেই হাত পুড়িয়ে ধূমপান ছেড়েছিলেন তিনি। সেই গল্প একটু পরে। তার আগে তাঁর জেদি মনোভাবের অন্য এক গল্প জানা যাক।
ছাপাখানায় তারাশঙ্করের একটি উপন্যাস প্রিন্টে উঠেছে। ছয় ফর্মা মানে ৮০ পৃষ্ঠার মতো ছাপাও হয়ে গেছে। এ সময় হন্তদন্ত হয়ে প্রেসে গেলেন তারাশঙ্কর। সবাইকে তাড়া দিয়ে ছাপা আটকালেন। লেখায় কী যেন একটা পরিবর্তন করতে হবে। তো বাড়িতে ফিরে সেই উপন্যাস আবার লেখা শুরু করলেন তিনি, প্রায় ৯০০ পৃষ্ঠা আবার লিখলেন নতুন করে।
স্বভাবে এই কথাসাহিত্যিক এমনই ছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একবার নিজেই বলেছিলেন, ‘আমার জেদ চিরকালই বড্ড বেশি। এই দেখো না জেদের বশে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর ধরে সিগারেট খাওয়ার অভ্যেস এক দিনে ছেড়ে দিলুম।’ সুনীল তো কথাটা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। ‘চেইন স্মোকার’ তারাশঙ্কর হুট করে এক দিনের নোটিশে যে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিতে পারেন, এ তো একেবারেই অবিশ্বাস্য!
তাই কৌতূহলী হয়ে সুনীল যখন জানতে চাইলেন, ‘এত কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন কীভাবে?’ জবাবে কোনো কথা না বলে তারাশঙ্কর শুধু নিজের বাঁ হাতটা উঁচু করে দেখালেন—হাতজুড়ে অসংখ্য পোড়া দাগ, যেন কেউ ছ্যাঁকা দিয়েছে। এবার ভয়ে চমকে উঠলেন সুনীল, ‘এ কী হয়েছে!’
এরপর তারাশঙ্করের নিরুত্তাপ জবাব, ‘কিছু না। সিগারেট ছাড়ার পর ও জিনিস আবার খেতে লোভ হলেই সিগারেট ধরিয়ে নিজের হাতে ছ্যাঁকা দিয়েছি। তাই এখন আর লোভ হয় না।’
জেদের মতোই প্রবল ছিল তাঁর আত্মসম্মানবোধও। তারাশঙ্করের এক বন্ধু একবার নির্বাচনে দাঁড়ালেন। বন্ধুর প্রচারকর্মী হিসেবে মাঠে নেমে পড়লেন তিনি। পোস্টার সাঁটানো থেকে শুরু করে মিছিল–মিটিং—সবকিছুতেই নামলেন কোমর বেঁধে। এর মধ্যে জানতে পারলেন, তাঁর বন্ধু যাঁর বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন, তিনি ওই বন্ধুরই নিকটাত্মীয়।
এরপর হঠাৎই ওই দুই আত্মীয়ের মিটমাট হয়ে গেল। তারাশঙ্করের বন্ধু মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে ফিরে এলেন নির্বাচনী মাঠ থেকে। এমন অবস্থায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় তারাশঙ্কর, কার জন্য কোথায় লড়লেন এত দিন!
পরে বন্ধুটি একপ্রকার জোর করেই দুপুরবেলা খাওয়ার জন্য তারাশঙ্করকে নিয়ে গেলেন প্রতিদ্বন্দ্বী সেই আত্মীয়েরই বাড়িতে।
খেতে বসেছেন। সবে ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে যাবেন, ঠিক তখনই সেই আত্মীয়ের বড় ছেলে হাসির ছলে বলে উঠল, ‘তারাবাবু, আপনি আমাদেরই বিরোধিতা করে এখন আমাদের বাড়িতেই পাত পেড়ে খাচ্ছেন?’
হাতের গ্রাস নামিয়ে রাখলেন তারাশঙ্কর। বললেন, ‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। লজ্জাহীনতার যে কাজ আমি করতে যাচ্ছিলাম, সঠিক সময়ে তা থেকে আমাকে বাঁচিয়েছেন। এখনো মুখে তুলিনি, এই নামিয়ে রাখলাম।’
কথা শেষ করে সেই যে ওই বাড়ি থেকে বেরোলেন, আর পেছন ফিরে তাকাননি।
তারাশঙ্করের এমন জেদি কাণ্ডের উদাহরণ ভূরি ভূরি। কল্লোল পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর সাহিত্যযাত্রার সূচনা। পত্রিকাটি নিয়মিত তাঁর লেখা ছাপত। কিন্তু একদিন কল্লোল পত্রিকা অফিসে গিয়ে তেমন আপ্যায়ন আর অভ্যর্থনা পাননি বলে তাঁকে আর কোনো দিন ওই অফিসে নেওয়া যায়নি। নিজের জেদ আর আত্মমর্যাদার প্রশ্নে এমনই কঠোর ছিলেন ১৯৭১ বইয়ের লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
সূত্র: বিনোদ ঘোষালের বই বাংলা সাহিত্যের দশ দিক ও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কল্লোল যুগ
গ্রন্থনা: বাশিরুল আমিন