‘ভালোবাসি জোৎস্নায়’, ‘চৈত্রের কাফন’, ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে’ বা ‘আশায় আশায় বসে আছি ওরে আমার মন’—এমন অজস্র গানের মাধ্যমে কয়েক দশক ধরে সংগীতপ্রেমীদের মনের মণিকোঠায় রয়েছে কলকাতার ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি। গত শতকের সত্তর দশকে এই ব্যান্ড গড়ে তুলেছিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। শুধু তা–ই নয়, ব্যান্ডটির মূল কান্ডারিও ছিলেন তিনি। আজ গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিন। মৃত্যুদিনে এ লেখায় ফিরে তাকানো হয়েছে গায়ক–গীতিকার গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের দিকে। সঙ্গে আছে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ ব্যান্ডের ভাঙা–গড়ার গল্পও।
কলকাতার বিখ্যাত ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র দলনেতা গৌতম চট্টোপাধ্যায়, যিনি ‘মণিদা’ নামে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করে কিছু কথা লিখছি। শুধু কলকাতা নয়, বাংলাদেশেও বেশ জনপ্রিয় এই গানের দল। সত্তরের দশকে টগবগিয়ে চলা এসব নালহীন ঘোড়ার খুরের আওয়াজ গান হয়ে আজও বাজে শ্রোতাদের কানে। প্রায় পঞ্চাশ বছর পেরিয়েছে, এখনো তাদের গান মানুষ শুনছেন, গাইছেন; আবার স্বপ্নও দেখছেন। কেন?
কারণ, এই গানে আছে অন্য রকম এক আমেজ। অন্য এক নাগরিকতা, অন্য এক দ্রোহ। আর বাংলা সংগীতের জগৎ তথা ব্যান্ডজগৎকে এই ধারা উপহার দেওয়ার পেছনে বড় অবদান যাঁর, তিনি গৌতম চট্টোপাধ্যায়। তিনি একাধারে ছিলেন গায়ক, সুরকার, গীতিকার, সংগীত পরিচালক ও চলচ্চিত্র পরিচালক। তবে ঠিক এভাবে বলে আসলেই বোঝানো যাবে না যে তিনি কী পারতেন আর কী করতেন। তাঁর হাত ধরেই সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতার বাংলা গানে এক নতুন ধারার সূচনা হয়।
ষাটের দশকে যে ‘আরবান ফোক’ ধারার প্রচলন ঘটেছিল বিশ্বজুড়ে, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’কে সেই ধারারই অনুসারী বলা যায়। গতানুগতিক সংগীতবোধের বাইরে গিয়ে গৌতম চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর সাগরেদরা সে সময় গানে রাজনীতি-বিপ্লব, ভালোবাসা, দারিদ্র্য, অন্যায়-অবিচার, স্বাধীনতা—সবকিছুকে প্রাসঙ্গিকভাবে আনতে পেরেছিলেন। রক মিউজিক মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা তখন কলকাতা বা ঢাকার শ্রোতাদের ছিল না।
গৌতম চট্টোপাধ্যায় মানে মণিদার যখন যেটা করতে ভালো লাগত, সেটাই তিনি ভালোভাবে করতেন। তাঁদের বাড়িতে গানবাজনার চল ছিল, সব বাদ্যযন্ত্র সাজানো থাকত বাড়িতে। একেবারে সুরের পরিবেশ যাকে বলে। তাঁর শুরুটা হয় পাড়ার অনুষ্ঠানে তবলা বাজানোর মাধ্যমে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, কণ্ঠশিল্পী ছাড়া অন্য সহশিল্পীদের যোগ্য সম্মান দেওয়া হয় না। সেই ষাটের দশকেই ব্যাপারটা নিয়ে রীতিমতো বিদ্রোহ করেছিলেন তিনি। তখনো কিন্তু তিনি পাশ্চাত্য সংগীতের ব্যান্ডের দর্শনের সঙ্গে তেমনভাবে পরিচিত ছিলেন না। তাঁর কেবল মনে হতো, সবার সঙ্গে মিলে একসঙ্গে গান করলে সবাই যোগ্য সম্মান পাবেন।
গৌতম চট্টোপাধ্যায় যেমন একসঙ্গে দল পাকিয়ে পাশ্চাত্য সংগীত শুনতেন, তেমনি বেদে, বৃহন্নলাদের গান শুনতে চলে যেতেন এদিক–সেদিক। লোকাল ট্রেনের বাউল গান কিংবা বাউল মেলায় বাউলদের সংগীতও টানত তাঁকে, তাঁদেরকে। সব সময় চাইতেন মাটির কাছাকাছি থেকে এমন কিছু করার, পাশ্চাত্যের সঙ্গে বাংলার নিজস্বতাও অক্ষুণ্ণ থাকবে যেখানে। তখন তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ছেন। গিটারে হাত পাকানো শুরু হয়েছে সবে। যোগ দিলেন ‘আর্জ’ নামের একটি ব্যান্ডে। এই দল শুধু ইংরেজি গানই কাভার করত। এর কিছুদিন পর ছেড়ে দিলেন ব্যান্ড। ছাড়ার পেছনে তাঁর বক্তব্য ছিল, ইংরেজিতে গান করে লাভ নেই, বাংলায় গান করতে হবে। ইতিমধ্যেই সে সময় তিনি নকশালবাড়ির আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। আর গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের এই ধারার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার প্রভাবই হয়তো তাঁর বাংলা গানের দিকে ঝুঁকে পড়ার ক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছিল।
‘মহীনের ঘোড়াগুলি’কে তিনি পরিচয় করিয়ে দেন বিভিন্ন ধরনের গান ও বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে। ফলে গিটার, স্যাক্সোফোন, ড্রামসের সঙ্গে একতারা, ভায়োলিন, বাঁশি ইত্যাদির সংমিশ্রণ ঘটে বাংলা রক সংগীতে। বাউল, রক, লাতিন মিউজিকের ট্যাঙ্গো–সালসা—এসব একত্রে মিলিয়ে–মিশিয়ে গৌতম চট্টোপাধ্যায় তৈরি করেন নতুন আরেক গানের জগৎ। গানের কথায় ভিন্নধর্মিতা, মঞ্চে পরিবেশনসহ সব মিলিয়ে গানকে এমন এক রূপ তিনি দিয়েছিলেন, যেটা সেই সত্তরের জন্য ছিল একটা বিপ্লব।
রাজনীতিতে জড়িয়ে কিছুকাল আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়, গান-বাজনা তখন সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল। এরপর কিছুদিন জেলও খাটেন। জেলে বসে কিছু গান লিখেছিলেন। বছর দেড়েক জেল খেটে ছাড়া পাওয়ার পর কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হয় তাঁকে। কয়েক বছর চাকরি করে ফিরে আসেন কলকাতায়। এসেই গঠন করেন ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’।
‘মহীনের ঘোড়াগুলি’কে তিনি পরিচয় করিয়ে দেন বিভিন্ন ধরনের গান ও বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে। ফলে গিটার, স্যাক্সোফোন, ড্রামসের সঙ্গে একতারা, ভায়োলিন, বাঁশি ইত্যাদির সংমিশ্রণ ঘটে বাংলা রক সংগীতে। বাউল, রক, লাতিন মিউজিকের ট্যাঙ্গো-সালসা-এসব একত্রে মিলিয়ে-মিশিয়ে গৌতম চট্টোপাধ্যায় তৈরি করেন নতুন আরেক গানের জগৎ। গানের কথায় ভিন্নধর্মিতা, মঞ্চে পরিবেশনসহ সব মিলিয়ে গানকে এমন এক রূপ তিনি দিয়েছিলেন, যেটা সেই সত্তরের জন্য ছিল একটা বিপ্লব।
সত্তর দশকে এ ধরনের গান বুঝতে পারা এবং গ্রহণ করার মতো মানুষ ছিল একেবারেই কম। এমনকি এই ব্যান্ডকে ধারণ করে রাখার মতো শক্তি ছিল না সে সময়ের সংগীতপ্রতিষ্ঠানগুলোরও। শুরু হওয়ার পর ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১—এই ছয় বছর মাত্র ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’কে বিচরণ করতে দেখা গিয়েছিল। এরপর দীর্ঘ সময়ের জন্য ঘোড়াগুলি চলে গিয়েছিল লোকচক্ষুর আড়ালে, আস্তাবলে—যে যার জীবিকায়। ১৯৮১ সালে ব্যান্ড ভাঙার আগের তিনটি অ্যালবামে মাত্র আটটি গান, ১৫ থেকে ২০টা অনুষ্ঠান আর রেকর্ড না হওয়া কয়েকটা গান—এসবই ছিল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র সম্বল।
‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ ভেঙে যাওয়ার পর গৌতম চট্টোপাধ্যায় নিজের গানের দুনিয়াকে একাই টেনে নিতে থাকেন। বিভিন্ন সিনেমায় মিউজিক কম্পোজ করেন এবং সে সময়েই শুরু করেন ছবি বানানো। তাঁর প্রথম ছবি ‘নাগমতি’, যার জন্য ১৯৮৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। দ্বিতীয় ছবি ছিল ‘সময়’, যা কখনো মুক্তি পায়নি। তিনি কিছু তথ্যচিত্রও তৈরি করেছিলেন। ‘ঢোলবাদকদের নিয়ে’সহ আরও বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তিনি তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন। এসব করেই তখন দিন কাটাচ্ছিলেন গানের এই মানুষ।
কিন্তু আশির দশকের শেষের দিক থেকে গৌতম চট্টোপাধ্যায় দেখতে পেলেন, তাঁদের গান নিয়ে নতুনভাবে উন্মাদনা তৈরি হচ্ছে কলকাতায়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গাওয়া হচ্ছে তাঁদের সেই সব গান। নতুন যাঁরা গিটার বাজিয়ে গান বানাচ্ছেন, তাঁরা আশপাশে ঘোরা, আড্ডা দেওয়া শুরু করেছেন। সবার প্রশ্ন—মহীনের ঘোড়াদের এই সামুদ্রিক জলকেলিতে বিশ্রাম আর কত দিন? যন্ত্রণাময় পৃথিবীর সমস্যাসংকুলতা থেকে আর কত দিন দূরত্বে থাকবেন তাঁরা! চারদিকে সে সময় মহীনের ঘোড়াদের ফিরে আসার আহ্বান।
এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে গজিয়ে ওঠা ভক্তকুলের ডাকে সাড়া দিয়ে অতঃপর তাঁরা ফিরে এসেছিলেন ১৯৯৫ সালের বইমেলায়, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে। ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ অ্যালবাম দিয়ে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র পুনরাবির্ভাব ঘটল। তবে সরাসরি নয়, এবার পালা এল নতুনদের দিয়ে কাজ করানোর। যোগ্য দলনেতা গৌতম চট্টোপাধায় একজন খাঁটি পথপ্রদর্শকের মতো সবাইকে সামনে নিয়ে এলেন, সুযোগ দিলেন গাওয়ার। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ সম্পাদিত এই অ্যালবাম তুমুল জনপ্রিয়তা পেল শ্রোতাদের কাছে।
তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র সম্পাদনায় (বলা চলে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের একার শ্রমের ফসল) মোট চারটি অ্যালবাম বের হলো। কুড়ি বছরের ব্যবধানে উৎপন্ন এই বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়ার একটি কারণ যদি হয় শ্রোতাদের নতুন গান শোনার আগ্রহ, অন্য কারণ অবশ্যই গীতিকার হিসেবে গৌতমের আত্মপ্রকাশ।
‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র প্রধান ঘোড়া, গানের কারিগর থেকে শুরু করে সম্পাদিত চারটি জনপ্রিয় অ্যালবামের স্রষ্টা গৌতম চট্টোপাধ্যায় আলো ছড়িয়েছেন তাঁর সব কাজেই। গাছ যেমন সবাইকে ছায়া দেয়, তিনি ঠিক গাছের মতো করেই ছায়া দিয়ে গেছেন কলকাতার বাংলা ব্যান্ড সংস্কৃতিতে। আর তাই আজও শুধু কলকাতা নয়, বাংলাদেশেরও অসংখ্য তরুণ গায়কের অনুপ্রেরণার নাম ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র সেই প্রধান ঘোড়া—গৌতম চট্টোপাধ্যায়, সবার কাছে যিনি এখনো মণিদা।