পানি লাগবে, ক্যানভাসে অ্যাক্রেলিক, শিল্পী নাসির উদ্দিন আহমেদ খান
পানি লাগবে, ক্যানভাসে অ্যাক্রেলিক, শিল্পী নাসির উদ্দিন আহমেদ খান

প্রদর্শনী

শিল্পে গণ–অভ্যুত্থানের রূপায়ণ

প্রতিটি গণ–অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে শিল্প-সাহিত্যে নতুন রসদ জোগান হয়। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানও এর ব্যতিক্রম নয়, বরং সারা দেশের পতিত দেয়ালগুলোর অসংখ্য গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্রের ভাষা, বৈচিত্র্য ও শিল্পমানকে সমকালীন শিল্প আন্দোলন হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়।

ইতিমধ্যে এই শিল্প আন্দোলনের নানা ধ্বনি-প্রতিধ্বনি এ দেশের চারুশিল্পীদের শিল্পকর্মে প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সমকালীন শিল্পীদের ‘সময়ের প্রতিধ্বনি: শিল্পের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ রূপায়ণ’ শীর্ষক যৌথ শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতেও এর প্রমাণ মেলে। প্রবীণ, নবীন ও শিশুশিল্পীদের বৈচিত্র্যময় শিল্পকর্মের সমাহারে প্রদর্শনীতে এসেছে নতুন মাত্রা। শিশুশিল্পীদের সঙ্গে নবীন ও প্রবীণ শিল্পীদের বোধ, ভাবনা, কল্পনা, বাস্তবতা ও বিমূর্তায়নের ঐক্য ও পার্থক্য বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে এ প্রদর্শনীতে।

এক সাঈদ পরপারে, লক্ষ সাঈদ ঘরে ঘরে, ক্যানভাসে অ্যাক্রেলিক, শিল্পী আব্দুস সাত্তার

প্রাচ্যধারার গুরু-শিল্পী আব্দুস সাত্তারের চিত্রকর্মটি ক্যালিগ্রাফি ও চিত্রকর্মের মেলবন্ধন। চিত্রে উল্লম্ব স্মৃতিস্তম্ভসদৃশ ফুল ও লতাপাতায় ঢাকা দেয়ালে লেখা ‘এক সাঈদ পরপারে, লক্ষ সাঈদ ঘরে ঘরে’। দুই হাত মেলে ধরা আবু সাঈদের যে প্রতীকী চিত্র দেয়ালজুড়ে এখনো বিদ্যমান, তা যেন শিল্পীর তুলিতে অর্থবহ ও শৈল্পিকভাবে উপস্থাপনের উদাহরণ। শুধু আব্দুস সাত্তার নন, আরও অনেক শিল্পীর কাজেই গণ–অভ্যুত্থানের বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন শিল্পী নাসির উদ্দিন আহমেদ খানের ক্যালিগ্রাফি—‘পানি লাগবে?’। তাঁর ক্যালিগ্রাফি সিরিজের অন্য কাজগুলোতে বাংলার প্রকৃতির রূপ-রস দৃষ্টির পরিতৃপ্তি ধরে মনকেও প্রশান্তি দেয়। 

জুলাই পদযাত্রা, ক্যানভাসে অ্যাক্রেলিক, শিল্পী এ এ এম কাওসার হাসান

গ্যালারির কেন্দ্রে ভাস্কর এ এ এম কাওসার হাসানের ভাস্কর্য ও দেয়ালে ঝোলানো তাঁর ‘জুলাই পদযাত্রা’ শিরোনামের চিত্রটির গাঁথুনি একই সরলীকরণে গাঁথা। যে সরলীকরণ শিশুশিল্পীর বিমূর্ত ধারার কাজের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যাবে। আর শিশুদের বিমূর্ত ধারার কাজের সঙ্গে প্রবীণ শিল্পী আজহারুল ইসলাম শেখের রিলিফ ভাস্কর্যসদৃশ টেক্সচার-প্রধান ‘আত্মা’ শিরোনামের চিত্রটি মিলিয়ে দেখলে শিশুশিল্পী এবং প্রবীণ শিল্পীদের অবচেতন কিংবা সচেতন মনের শিল্পসত্তার ঐক্যকে অনুধাবন করা যাবে। শুধু রঙের প্রলেপে রিলিফ প্রসঙ্গ নয়, সরাসরি ত্রিমাত্রিক বস্তু (অবজেক্ট) ক্যানভাসে যুক্ত হয়েছে অনেকের কাজে। মিশ্রমাধ্যমে করা মো. আব্দুর রাজ্জাকের কাজে ত্রিমাত্রিক কয়লাসদৃশ বস্তুর মধ্য দিয়ে ধ্বংসাবশেষ, হাবিবা আক্তার পাপিয়ার ধাতব পাতের লেখায় মা-মাটি-মানুষ, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশাত্মবোধ; অর্পিতা দেবনাথ মিতুর গৌতম বুদ্ধের ধ্যানময় অবয়বে আত্মার শান্তি বিষয় উপলব্ধিকে স্পর্শী করেছে উপকরণের বিশেষত্বে।

আলোছায়ার গান, তেল রং ও চারকোল, শিল্পী মাসুদুর রহমান

শিল্পী আমিরুল ইসলামের জলরং চিত্রমালায় স্মৃতি রোমন্থনের আনন্দ জাগায়। কারণ, তাঁর নদী-নৌকাপ্রধান ল্যান্ডস্কেপে ফটোগ্রাফির কোনো আদল নেই, আছে মনোময় সৃজনের রসবোধ। যা প্রকৃতির অন্তঃকথনকে করেছে প্রাঞ্জল। তদ্রূপ প্রকৃতির প্রাণের কথা, আলোর খেলা আছে আবু শেখ কাজলের কাজে। এ ছাড়া শিল্পী ত্রিবেদী গোপাল চন্দ্র, মো. আবদুল আযীয, আওলাদ হোসেন, ইসরাত জাহান, সোহাগ পারভেজ, মো. মাইদুল ইসলাম খানের কাজের প্রকৃতি আর প্রাণের ছোঁয়া উল্লেখযোগ্য।

পানি লাগবে, ক্যানভাসে অ্যাক্রেলিক, শিল্পী নাসির উদ্দিন আহমেদ খান

মাসুদুর রহমানের কাজগুলোতে একধরনের প্রাকৃতিক দৃষ্টিভ্রম হয়। ক্যানভাসে নানা অবয়ব-মুখাবয়ব ভেসে উঠে ভাবনার অবগাহনে ডুবিয়ে নিয়ে যেন রূপকথার গল্প শোনায়।

এমন নানা গল্পের হদিস পাওয়া যাবে শিল্পী মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান, মো. আবদুল মোমেন মিল্টন, মো. তানভীরুল ইসলাম, জিয়া বিপ্লব, টিপু সুলতান, মো. রাকিবুল হাসান, রিয়াসাত ইলাহী প্রমুখের কাজে।

ট্রেডিশনাল পেইন্টিং, মিশ্র মাধ্যম, শিল্পী ত্রিবেদী গোপাল চন্দ্র

প্রদর্শনীর দেয়াল মূলত ছবি দিয়ে ঠাসা। বৈচিত্র্যময় শিল্পকর্ম থেকে বাছাই করা মানসম্মত শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হলে প্রদর্শনীটি আরও সার্থক হতো বলে আশা করা যায়। হতাশার হলো, জাদুঘরের এ গ্যালারিটি বছরের অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে। প্রত্যাশা করি, জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করে শিল্পরসিকদের সমকালীন শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ করে দেবে। 

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের আয়োজনে ‘আর্ট ফ্লুয়েন্ট’ আর্টিস্ট গ্রুপের সমকালীন যৌথ শিল্পকর্ম প্রদর্শনীটি কিউরেটরিয়াল কো-অর্ডিনেশন করেছেন শিল্পী শেখ মনির উদ্দিন ও নাসির উদ্দিন আহমেদ খান। গত ৯ আগস্ট শুরু হওয়া ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের বীর শহীদদের উৎসর্গ করা প্রদর্শনীটি নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত চলবে।