
ঢাকার লালমাটিয়া এলাকাটি এখন ধীরে ধীরে শিল্পপ্রেমীদের পদচারণে মুখর হয়ে উঠছে। কারণ, এখানকার পাশাপাশি অবস্থিত কয়েকটি আর্ট গ্যালারি শিল্পচর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছে।
শিল্পাঙ্গন গ্যালারির আয়োজনে লালমাটিয়ার ‘ভূমি’ গ্যালারিতে শেষ হয়েছে শিল্পী কিরীটি রঞ্জন বিশ্বাসের ষষ্ঠ একক চিত্রকলা প্রদর্শনী ‘স্বপ্নভূমি’।
বহুকক্ষবিশিষ্ট গ্যালারিটি ঘুরে দেখা ছিল যেন এক গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে চলা। তবে এই ভ্রমণ কেবল ছবি দেখার নয়—এখানে একেকটি কক্ষে বসে চা খাওয়া, আড্ডা দেওয়া বা গল্প করার মতো এক আরামদায়ক অভিজ্ঞতাও রয়েছে।
কিরীটির ছবির বিষয় রূপসী বাংলার জীবনগাথা, যা মূলত তাঁর শৈশব–স্মৃতির মূলে গাঁথা। গৃহপালিত বিড়াল, গতিময় ঘোড়া, কৃষকের গরুর গাড়ি, চরাঞ্চলের মুক্ত–বিস্তৃত প্রান্তরে চারণরত মহিষ, সুন্দরবনের নৈসর্গিক সৌন্দর্য, গ্রামীণ জীবনে মাছ ধরা, কুষ্টিয়ার বাউলজীবন, অঘ্রানের রূপ, মনীষী শিল্পী–সাহিত্যিকদের প্রতিকৃতি, গ্রাম্য পথ, শিশু–কিশোরদের দুরন্ত খেলা—সব মিলিয়ে এক বিস্মৃত অথচ আনন্দময় স্মৃতিজগৎ খুলে যায় দর্শকের সামনে।
গ্যালারির একেকটি ঘরে প্রবেশ করলে মনে হয়েছে, যেন সারা বাংলাদেশকে একে একে হেঁটে দেখা যাচ্ছে। প্রথম যে কক্ষটিতে প্রবেশ করি, সেখানে বেশ কয়েকটি বিড়ালের লক্ষ্যস্থির দৃষ্টি আমাকে মুগ্ধ করে। সফট প্যাস্টেলের কোমল আঁচড়ে বিড়ালের লোমশ দেহ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে শিল্পীর অভূতপূর্ব অঙ্কন দক্ষতায়।
অনেক ছবিতে এসেছে সাদা বক—কখনো জলাশয়ে মাছ শিকারে, কখনো গহিন অরণ্যের ঘন সবুজে বিশ্রামরত। এসব চিত্রে পাখিকুলের স্বাভাবিক জীবনের গল্প উঠে এসেছে।
এখানে পাখি যেন স্বাধীনতার প্রতীক। অন্যদিকে কৃষকের জীবনে গরুর উপস্থিতি তার সহযাত্রীর মতো—অঘ্রানের ধান তোলার দৃশ্যে সেই সখ্য প্রকাশ পেয়েছে। একসময় নিত্য দেখা এ দৃশ্য আজ বিলুপ্তপ্রায়, যা শিল্পীর স্মৃতি–নিবিষ্ট চেতনা থেকে উঠে এসেছে। আশি–নব্বইয়ের দশকের কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে এ দৃশ্য ছিল প্রতিদিনের জীবনের অংশ।
‘হাটে যাওয়া’ শিরোনামের একটি চিত্রে দেখা যায়, গ্রামীণ পথে কাঁধে ভার বহন করে এক পুরুষ ও তার সঙ্গে দুটি শিশু হেঁটে যাচ্ছে। এ ছবিতে বিনিময়ভিত্তিক জীবনের সহজিয়া সুর ধ্বনিত হয়েছে। অন্যদিকে ‘আমার পতাকা–১’ চিত্রে দেখা যায়, পতাকা হাতে জমির ভেতর দিয়ে তিন শিশুর অগ্রযাত্রা—দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসার প্রতীকী রূপে।
একই ধারায় ‘আমার পতাকা’ চিত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের মিছিলের গতি ধরা পড়েছে। গতি আছে নারী ক্রিকেটারের দেহ–অবয়বেও—যেন সময় ও জীবনের ছন্দকে ধারণ করছে এই চিত্রমালা।
কিরীটির ছবির ভেতরে সহজ–সুন্দর জীবনের পাশাপাশি আছে গভীর মানবিক বোধ। শৈশবে যে শিশুটি কাগজের প্লেন বানিয়ে আকাশে উড়িয়ে দেয়, সে–ই একদিন হয়তো হয়ে ওঠে দেশ গঠনের কারিগর। তাঁর চিত্রে সেই স্বপ্নবীজের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা ভবিষ্যতের সম্ভাবনার প্রতীক।
নদী, নৌকা, কলাগাছের ভেলা, নিসর্গ, আকাশ, কাশফুল, পলাশ ফুল—বাংলার প্রকৃতির সহজতা রংতুলির আঁচড়ে ধরা পড়েছে তাঁর কাজে। কিরীটির বেড়ে ওঠা কুষ্টিয়ায়; সেই বাউল–অঞ্চলের আত্মনিবিষ্ট সুর, দেহতত্ত্ব ও ভজনগীতি তাঁর ছবিতে লাল, সাদা ও গেরুয়া রঙের আভায় এক অমায়িক আবহ তৈরি করে।
এ প্রদর্শনীতে ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এস এম সুলতান, জাকির হোসেনসহ অনেক মনীষীর প্রতিকৃতি, যা কিরীটির শিল্পবোধের সহজ পাঠ উন্মোচন করে। তবে শাপলা ও পাহাড়ি ফুলের কয়েকটি চিত্র এখনো প্রাথমিক অনুশীলনের ইঙ্গিত বহন করে; সেখানে তাঁর তুলি চালানোর কৌশল কারও কারও কাছে অপরিপক্ব ও বেমানান মনে হতে পারে। সব মিলিয়ে এই চিত্রমালা কেবল দৃশ্য নয়, বরং এক অনুভূতির ভুবন। কিরীটির তুলি যেন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই বাংলায়, যেখানে জীবন, প্রকৃতি ও মানুষ এক অবিচ্ছেদ্য সুরে বাঁধা।
মোট ৫২টি চিত্রকর্ম নিয়ে সাজানো প্রদর্শনীটি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত ছিল ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত।