
দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চারুকলা শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। ফলে শিক্ষানবিশ ও সদ্য শিক্ষা-সমাপ্ত নবীন শিল্পীরা বাংলাদেশের শিল্পচর্চায় বড় প্রভাব রাখছেন। রাজধানীতে প্রতিনিয়ত চলমান প্রদর্শনী দেখলে তার প্রমাণ মেলে। এই শিল্পীদের মধ্যে দলগত প্রদর্শনীর প্রবণতাই বেশি—তাঁদের রয়েছে অনেক সংগঠনভিত্তিক গ্রুপও। অর্থাৎ সংঘবদ্ধ হয়ে প্রদর্শনী আয়োজনের মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের সৃষ্টিকর্ম শিল্পরসিকদের সামনে তুলে ধরেন।
বলা যায়, দেশে এই নবীন শিল্পীর সংখ্যা এখন অনেক। তাঁদের কাজের ধারাতেও রয়েছে বৈচিত্র্য। অনুশীলনধর্মী প্রকৃতি বা চোখের দেখা বিভিন্ন অবজেক্টের কম্পোজিশন যেমন আছে, তেমনি অনেকের কাজে দেখা যায় বুদ্ধিভিত্তিক চর্চার প্রতিফলন; কেউবা দেখিয়ে যাচ্ছেন চমকপ্রদ করণ-কৌশল ও কসরত। তবে তাঁদের মধ্যে আরেক দল রয়েছেন—যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রাপ্ত শিল্পী নন, পেশা যা–ই হোক না কেন, ছবি আঁকার নেশা থেকেই তাঁরা নিয়মিত সৃষ্টিতে যুক্ত। সুনামও কুড়াচ্ছেন এবং তাঁদের কাজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঘাটতি বোঝার উপায় নেই।
কথাগুলো বলছি ‘দ্য আর্ট অব স্মল থিংস’ শিরোনামের প্রদর্শনী প্রসঙ্গে। প্রদর্শনীটি ঢাকার লালমাটিয়ার ইল্যুশন গ্যালারিতে চলছে। এখানে বেশ কয়েকজন স্বশিক্ষিত শিল্পী রয়েছেন; পাশাপাশি দেশবরেণ্য অতিথি শিল্পীদের কাজও রয়েছে।
এশিয়ান ওয়াটারকালার সোসাইটি আয়োজিত এই প্রদর্শনীর বিশেষত্ব হলো—ক্যানভাসগুলো ছোট, কিন্তু তার বিষয়বর্ণনা বিস্তৃত ও গভীর। ঠিক মিনিয়েচার নয়, তবে ছোট পরিসরে বৃহৎ ক্যানভাসের অনুভবকে ধরার প্রয়াস—অর্থাৎ বড় ক্যানভাসের অভিব্যক্তি মিলবে ছবিগুলোতে।
শিল্পী হাসনাত সোহাগের ‘গোধূলি বেলায় বুড়িগঙ্গা’ চিত্রটির কথাই ধরা যাক—আট বর্গইঞ্চি পরিমাপের এই চিত্রে নদী, লঞ্চঘাট, আকাশ ও ইমারতের বৃহৎ অনুভবের কোনো কমতি নেই। একই ধাঁচে নদী-নৌকার দৃশ্যায়ন দেখা যায় এশিয়ান ওয়াটারকালার সোসাইটির উদ্যোক্তা অরুণ চন্দ্র বর্মনের জলরং চিত্রেও।
স্বশিক্ষিত শিল্পী আল-আকসার সফট প্যাস্টেলে করা নারীমুখ কিংবা ঐতিহ্যনির্ভর স্টিল লাইফে চোখের পলকে যেন এক জাদুকরি আবেশ তৈরি হয়। কালো জমিনে রঙের কোমল ছোঁয়ায় তিনি বস্তু ও ভাবনার দ্যুতিকে অসাধারণভাবে সুসমন্বিত করেছেন। আগেই বলা হয়েছে, স্বশিক্ষিত ধারার বেশ কয়েকজন শিল্পীর কাজ মুগ্ধ করার মতো। শিল্পী অন্তিক ধর তেলরঙে ছোট পরিসরে এঁকেছেন ‘জাস্টিস লেডি’—এ ছবিতে দেখা যায়, নারী বিচারক এক হাতে দাঁড়িপাল্লা ধরে আছেন, অন্য হাতে হয়তো রায় লিপিবদ্ধ করছেন; কিন্তু তাঁর চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা। ছবির অন্তরালে সমাজবাস্তবতার কোনো গল্প হয়তো লুকিয়ে আছে।
শিল্পী মোহাম্মদ রবিনের ছবি আরও ক্ষুদ্র পরিসরে—পাঁচ বর্গইঞ্চির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই ছোট আয়তনের ভেতরেই তেলরঙে স্প্যাটুলার আঘাতে গড়ে ওঠা আয়তাকার ফর্ম, নারীদেহের সৌষ্ঠব ও অভিব্যক্তির সঙ্গে মিলেমিশে নতুন মাত্রা পেয়েছে।
মুরারি মূরলী মোহনের শরতের কাশফুল, তাপস কর্মকার, জাহিদ খান, মাহারুন নিসা ও ভানু রায়ের কাজে ধরা আছে বাংলার নদী, নৌকা, নিসর্গ ও শহরের গল্পগাথা।
এই নিসর্গ বা বাংলার প্রকৃতি সুনিপুণভাবে উঠে এসেছে অতিথি শিল্পী আব্দুল মান্নানের ‘ল্যান্ডস্কেপ’ ও সোহাগ পারভেজের ‘আমার দেশ’ চিত্রে। ল্যান্ডস্কেপ ও নগরায়ণের চিত্রই বেশি দেখা গেলেও, শিল্পীদের কাজে মনোজগতের নানা অনুভূতিও প্রকাশ পেয়েছে। অতিথি শিল্পী বীরেন সোমের ‘মনের লাল’, আব্দুল মোমেন মিল্টনের ‘হোলি যাত্রা’, ইয়াছিন ভূঁইয়ার ‘কর্কটক্রান্তি’, শামীম আহমেদের ‘রঙিন প্রবাহ’, সুলেখা রহমানের ‘স্নেহ’—সব কাজেই মনোজগতের বিভিন্ন কথার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়।
প্রকৃতি, নগরজীবনের গতি, ক্লান্তি, পরিসরহীনতা, মানুষ ও পরিবেশের সংঘাত, সহাবস্থান এবং সাম্যের অনুসন্ধান—সব মিলিয়ে এক অন্তর্লোক ও বহির্লোকের সংযোগসূত্র ছোট ফ্রেমের মধ্যেও বৃহৎ নন্দনের বিস্তার সম্ভাবনা এই প্রদর্শনী। প্রদর্শনীটি ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত দর্শকদের জন্য খোলা থাকবে।