অধ্যাপক ক্লিন্টন বি সিলি ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর ইমেরিটাস অধ্যাপক, একজন গবেষক ও অনুবাদক। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। ‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড’ ক্লিন্টন বি সিলির চৌদ্দটি প্রবন্ধের একটি সংকলন যেখানে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন সাহিত্যকর্মকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সমন্বিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
বইটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ইউপিএল থেকে। এই প্রকাশনাকে কেন্দ্র করে একটি প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ইউপিএল, যেখানে লেখক ক্লিন্টন বি সিলিসহ আরও অনেকে অংশ নেন বাংলাদেশ, ভারত, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে।
জুমের মাধ্যমে যোগ দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্লিন্টন বি সিলি ও গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, কলকাতা থেকে পবিত্র সরকার, সিডনি থেকে সাইদ চৌধুরী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম ও ফারুক মঈনউদ্দীন। ইউপিএলের কর্ণধার মাহরুখ মহিউদ্দিনের স্বাগত উদ্বোধনী বক্তব্যের পর সঞ্চালনার দায়িত্ব নেন ড. নাজিয়া মনজুর। মুক্ত আলোচনা পর্বে অংশ নেন, ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, শফি আহমেদ ও শামসুল বারী। ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রসচিব নজরুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানের শুরুই প্রয়াত শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
ক্লিন্টন বি সিলি একজন জীবনানন্দ–অনুরাগী। তাঁর লেখা জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যিক জীবনী ‘আ পোয়েট অ্যাপার্ট’-এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রথমা প্রকাশনী’ থেকে ফারুক মঈনউদ্দীনের অনুবাদে ‘অনন্য জীবনানন্দ’ নামে। ক্লিন্টন সিলি এখানে দেখিয়েছেন, কেন জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যের ধারায় অনন্য বা অন্যদের থেকে আলাদা। এর প্রথম ভাগে জীবনানন্দের জীবনপথ, পারিবারিক প্রেক্ষাপট, কর্মজীবন ও সমসাময়িক সাহিত্যচর্চা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে তাঁর কবিতার বিষয় ও শৈলী বিশ্লেষণ, যেখানে প্রকৃতি, সময়, একাকিত্ব, মৃত্যু ও নারীচিত্রকে নতুন দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। লেখক দেখান, জীবনানন্দের কবিতা রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আধুনিকতার একান্ত নিজস্ব কণ্ঠস্বর সৃষ্টি করেছে। এখানে তিনি জীবনানন্দকে কেবল সাহিত্যিক নয়, বরং তাঁর সময়ের সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়ার এক নিয়ামক হিসেবে দেখিয়েছেন।
‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড’ বইতে ক্লিন্টন বি সিলি বাংলা মঙ্গলকাব্য, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মহাভারত, রামায়ণ, মীর মশাররফ হোসেন ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন গভীর, অন্তর্ভেদী ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ। সেই সঙ্গে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গ, রিজিয়া রহমান থেকে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী ও রাজা প্রতাপাদিত্যও।
‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড’ বইতে ক্লিন্টন বি সিলি বাংলা মঙ্গলকাব্য, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মহাভারত, রামায়ণ, মীর মশাররফ হোসেন ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন গভীর, অন্তর্ভেদী ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ। সেই সঙ্গে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গ, রিজিয়া রহমান থেকে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী ও রাজা প্রতাপাদিত্যও।
অনুষ্ঠানে সিডনি থেকে যুক্ত অধ্যাপক ক্লিন্টন বি সিলির বন্ধু এবং একসময়ের ছাত্র সাইদ চৌধুরী সিলি সম্পর্কে একটি পরিচিতিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি জানান, ২০০৮ সালে কলকাতায় এই বই প্রথম প্রকাশের পর ২০১১ সালের দিকে প্রকাশনাটি বন্ধ হয়ে গেলে বইটি বাজারে পাওয়া যাচ্ছিল না। এর এত বছর পর ইউপিএলের কাছে বইটি প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ করা হয় এবং ইউপিএল কর্তৃপক্ষ সানন্দে বইটি প্রকাশ করে। সাইদ চৌধুরী ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বরিশাল জিলা স্কুলে ক্লিন্টন বি সিলির ছাত্র ছিলেন।
অধ্যাপক পবিত্র সরকার তাঁর বক্তব্যে বলেন, হিন্দু রেনেসাঁ একসময় অনেকটা সত্যি ছিল। যে কারণেই হোক, বাঙালি বা ভারতীয় মুসলমানদের ইংরেজির প্রতি বিদ্বেষ ছিল, কারণ ইংরেজ এসে তাদের সাম্রাজ্য কেড়ে নিয়েছে। তারা ইংরেজি না শিখে খানিকটা পিছিয়ে পড়ে। ফলে যাঁরা রেনেসাঁসের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই প্রধান নামগুলো ছিল হিন্দু। যদিও তার মধ্যে ডিরোজিও ছিলেন। ডিরোজিও এসে আরেক ধরনের নেতৃত্ব তৈরি করেছিলেন। হিন্দুদের মধ্যে একটা নাস্তিকীয় ধারা তৈরি হয়েছিল। তারপর মুসলমানরা এলেন। তাঁদের মধ্য থেকে বড় লেখক আসেন মীর মশাররফ হোসেন, যার কথা ক্লিন্টন তাঁর বইতে বলেছেন। ধীরে ধীরে মুসলমান লেখকেরা দৃশ্যে আবির্ভূত হতে লাগলেন। তাঁদের একটা অভিযোগ ছিল হিন্দু লেখকদের সম্বন্ধে, কারণ, অনেক হিন্দু লেখকের মধ্যে একধরনের পক্ষপাত ছিল, যেমন বঙ্কিমচন্দ্র। তখন দেশপ্রেমের উপন্যাস, নাটক যেগুলো জনপ্রিয় হয়েছিল, তাতে দেখা যাচ্ছিল, পরাধীনতার আসল কারণ হচ্ছে মুসলমানরা। ফলে আমাদের স্বদেশি উপন্যাসে দেখা গেল, মুসলমান শাসকেরা আমাদের শত্রু, ব্রিটিশ নয়। ব্রিটিশদের কথা তাঁরা বলতে পারেননি। সরকারি চাকরি বা যেকোনো কারণে। যার ফলে মুসলমান লেখকেরা অভিমান প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে একটা সত্য আছে। কিন্তু তাঁর মতে, আমরা যদি বঙ্কিমচন্দ্র ভালো করে পড়ি, দেখতে পাব, বঙ্কিমচন্দ্র মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে যতটা ছিলেন, মুসলমান সাধারণ মানুষদের ততটা সমালোচক ছিলেন না।
ক্লিন্টনের সঙ্গে পবিত্র সরকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়িয়েছিলেন। পবিত্র সরকার বলেন, মঙ্গলকাব্যের যে স্ট্রাকচার, তার সঙ্গে যে তাসের দেশের স্ট্রাকচারের একটা মিল আছে, এ পর্যন্ত কোনো বাঙালি সেটা বলেননি। ক্লিন্টন প্রথম বললেন। ক্লিন্টন আমেরিকান হয়ে বাঙালির মতো লিখেছেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড’ বইতে জীবনানন্দ হোক, মধুসূদন হোক, ভারতচন্দ্র হোক, রবীন্দ্রনাথ হোক বা মীর মশাররফ হোসেন—সবার সম্বন্ধে লেখাগুলোয় বাইরের দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি বাঙালি হিসেবেও একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
পবিত্র সরকারের বক্তব্যের সুর ধরে গায়ত্রী চক্রবতী স্পিভাক, ফারুক মঈনউদ্দীন ও ফিরদৌস আজিমের কাছে উপস্থাপক জানতে চান, যদি আমরা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য করতে চাই, তবে সাহিত্য সমালোচনা করতে একজনের কতটুকু অন্তর্দৃষ্টি বা ভেতরের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন?
ক্লিন্টনের সঙ্গে পবিত্র সরকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়িয়েছিলেন। পবিত্র সরকার বলেন, মঙ্গলকাব্যের যে স্ট্রাকচার, তার সঙ্গে যে তাসের দেশের স্ট্রাকচারের একটা মিল আছে, এ পর্যন্ত কোনো বাঙালি সেটা বলেননি। ক্লিন্টন প্রথম বললেন। ক্লিন্টন আমেরিকান হয়ে বাঙালির মতো লিখেছেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বলেন, তিনি আইডেনটিটি পলিটিকসের বিরুদ্ধে। তাঁর মতে, ‘আমরা সবাই ভাষার দিক থেকে বহিরাগত।’ তিনি জানান, যখন পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র পঁচিশ বছর। তিনি তখন সবে দেরিদার বইগুলো দেখছিলেন।
গায়ত্রীর মতে, তথাকথিত যে স্বাভাবিক ভাষা, সেটাও একদিক দিয়ে কৃত্রিম ভাষা। তিনি ভাষার মধ্যে ভাষার কঙ্কাল দেখতে পান। তিনি জানান, তাঁর একসময় বদভ্যাস ছিল, যখন বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে যেতেন, যাঁরা বাংলা জানেন না, ইংরেজি কথাগুলো তাঁদের ইন্দো-ইউরোপীয় উৎসগুলো থেকে দেখাতে যেতেন, এটা দেখানোর জন্য যে বাংলা ও ইংরেজির মধ্যে কতটুকু সম্বন্ধ আছে। গায়ত্রী চক্রবর্তীর মতে, ক্লিন্টন বি সিলির বাংলায় তিনি সেই জিনিস দেখতে পান।
গায়ত্রী চক্রবর্তী আরও বলেন, ক্লিন্টন বি সিলির বাংলার সঙ্গে জড়িত হতে পারাটা যথার্থ ছিল, যেটা দেখে তাঁর কিছুটা হিংসা হয়। কারণ, গায়ত্রী নিজে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা শিখেছেন। তাই আক্ষেপ করলেন, তিনি যদি ক্লিন্টনের মতো বাংলা শিখতে পারতেন, তাহলে যেন ভাষার প্রতি ভালোবাসাটা আরও কড়া হতো।
গায়ত্রী চক্রবর্তী জ্ঞান বা বুদ্ধি দিয়ে লেখাকে জানার কথা বলেন, যেটা ক্লিন্টনের আছে। ক্লিন্টন সিলি বাংলা কবিতার যে ব্যাখ্যা করেছেন, সেটা গায়ত্রী চক্রবর্তীকে মুগ্ধ করেছে। আরও একটা দিকের কথা তিনি বলেন। সেটা হলো, অধ্যয়নের জন্য অনুশীলন করতে হবে।
ক্লিন্টন সিলির অনুরোধে বইটি বাংলা অনুবাদ করার অভিজ্ঞতার কথা জানান ফারুক মঈনউদ্দীন। কেন অনুবাদ করেন, এ প্রসঙ্গে ফারুক মঈনউদ্দীন জানান, তিনি অনুবাদ করেন, কারণ, যাঁরা ইংরেজি পড়বে না, তাঁদের জন্য তিনি নিজে যা পড়েন, সেটা শেয়ার করার তাগিদ অনুভব করেন। এর আগে ‘অনন্য জীবনানন্দ’ বইটির অনুবাদ প্রসঙ্গে জানান, জীবনানন্দের একটি আত্মজীবনীর জন্য তাঁর মৃত্যুর পর আমাদের সতেরো বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রভাত কুমার দাস লিখেছিলেন সেটি। তারপর আরও উনিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে আরেকটি পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যিক জীবনীর জন্য এবং কাজটা করেন একজন বিদেশি ক্লিন্টন সিলি, যা আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়। আমেরিকান পিস কোরের সদস্য হিসেবে বরিশাল এসেছিলেন ক্লিন্টন। ফারুক মঈনউদ্দীন জানান, সে সময় দুই বছর বরিশালে থেকেও জীবনানন্দ দাশের নাম শোনেননি ক্লিন্টন। নামটি প্রথম শোনেন আমেরিকায় গিয়ে কবি জ্যোতির্ময় দত্তর কাছ থেকে। তখনই জীবনানন্দের আশ্চর্য ভুবনের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর।
ফিরদৌস আজিম তাঁর বক্তব্যে সিলির ‘বাংলা সাহিত্য বীক্ষণ’ রচনার প্রসঙ্গ আনেন। ফিরদৌস আজিম বলেন, ‘আমাদের ভাষায় দর্শন মানে বিভিন্নভাবে দেখা। জায়গা থেকে, স্থান থেকে, দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা। যখন আমরা দর্শন শব্দটা বলি, তখন শব্দটা পাল্টে যায়। আমরা দর্শন লাভ করি।’ এ প্রসঙ্গে তিনি সিলি যেভাবে এখানে এডওয়ার্ড সাইদের ওরিয়েন্টালিজমের কথা আনলেন, সে সম্পর্কে বলেন।
বইতে ক্লিন্টন বি সিলি ‘বাংলা সাহিত্য বীক্ষণ’ নামে যে প্রবন্ধ লিখেছেন, সেখানে মূলত বাংলা সাহিত্যকে দেখা, বোঝা ও মূল্যায়নের এক সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। তিনি বলেন, সাহিত্যকে দেখা মানে শুধু পর্যবেক্ষণ নয়, এটি একধরনের ‘দর্শন’, যেখানে দর্শক (সমালোচক) ও দর্শনযোগ্য বিষয়ের (সাহিত্য) মধ্যে এক জটিল সম্পর্ক কাজ করে। দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতিতে ‘দর্শন’ শব্দটি পবিত্র ও শ্রদ্ধাসূচক অর্থে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু পাশ্চাত্য দৃষ্টিতে ‘দেখা’ প্রায়ই হয়ে ওঠে নিয়ন্ত্রণ বা দখল করার মাধ্যম।
এই ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সিলি উল্লেখ করেন এডওয়ার্ড সাইদের ওরিয়েন্টালিজমের প্রভাবের কথা, যেখানে পশ্চিমা দৃষ্টিতে প্রাচ্য এক নির্মিত বাস্তবতা, যা দেখা ও বর্ণনার মাধ্যমে ইউরোপ নিজেই সৃষ্টি করেছে। অর্থাৎ দেখা সেখানে একধরনের ক্ষমতা প্রয়োগ। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সিলি বলেন, সাহিত্য সমালোচনায়ও একই বিপদ রয়েছে, সমালোচক প্রায়ই সেই সাহিত্যকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে তৈরি করে নেন। তিনি বাংলা কবিতার উদাহরণ হিসেবে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, ও জীবনানন্দ দাশের রচনার বিশ্লেষণ করেন। শামসুর রাহমানের কবিতায় যেমন ঢাকা শহরের বাস্তব ও মানসিক দুই রূপ দেখা যায়, তেমনি শহীদ কাদরী ও জীবনানন্দের কবিতায় দেখা হয়ে ওঠে নান্দনিক কিন্তু বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা, যেখানে নারী কেবল দেখা যাওয়া এক বস্তু। সিলি এখানে নারীবাদী সমালোচকদের, বিশেষ করে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করে দেখান, দেখা কখনোই নিরপেক্ষ নয়; তা ক্ষমতা, লিঙ্গ ও সংস্কৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শেষে তিনি বলেন, সাহিত্য বিশ্লেষণ করার সময় পশ্চিমা বিশ্বজনীন মানদণ্ড প্রয়োগ করা উচিত নয়, কারণ সাহিত্য সর্বদা সংস্কৃতিনির্ভর। অরুণ মুখার্জীর উদ্ধৃতি টেনে তিনি বলেন, ‘সাহিত্য মূল্যায়নে আমাদের প্রয়োজন সাংস্কৃতিক অন্তরঙ্গতা অর্থাৎ যে সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে সাহিত্যটি এসেছে, তার ভেতরের বাস্তবতা বোঝার আন্তরিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা।’ সিলি মনে করেন, বাংলা সাহিত্যকে দেখতে হলে প্রভুত্বের দৃষ্টি নয়, অংশগ্রহণের দৃষ্টি দরকার; যেন আমরা সাহিত্যকে সৃষ্টি নয়, দর্শন হিসেবে গ্রহণ করি এবং এর ভেতর দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির গভীর মানবিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারি।
ক্লিন্টন সিলি ‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড’ বইতে কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমানের ‘উত্তর পুরুষ’ বইটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। ক্লিন্টনের মতে, রিজিয়া রহমান এমন লেখক যিনি ইতিহাস, জাতিসত্তা ও ব্যক্তিসত্তার জটিল সম্পর্ককে গভীর বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। ‘উত্তর পুরুষ’ উপন্যাসটি (১৯৭৭) এই অনুসন্ধানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ক্লিন্টন সিলি ‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড’ বইতে কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমানের ‘উত্তর পুরুষ’ বইটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। ক্লিন্টনের মতে, রিজিয়া রহমান এমন লেখক যিনি ইতিহাস, জাতিসত্তা ও ব্যক্তিসত্তার জটিল সম্পর্ককে গভীর বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। ‘উত্তর পুরুষ’ উপন্যাসটি (১৯৭৭) এই অনুসন্ধানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যেখানে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজারে বসবাসকারী এক খ্রিষ্টান পরিবার, ডি ক্রুজ পরিবারের জীবনের মাধ্যমে বাংলাদেশের বহুজাতিক ও বহুসাংস্কৃতিক বাস্তবতার প্রতিফলন দেখা যায়। উপন্যাসে ডি ক্রুজ পরিবারের চার সদস্য অ্যান্টনি, তাঁর স্ত্রী, মেয়ে লিসি ও ছেলে বনি প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে পরিচয়ের সংকটে ভোগে। প্রবীণ অ্যান্টনি নিজেকে পর্তুগিজ বীরের উত্তরাধিকারী মনে করে, কিন্তু তাঁর জীবনের গর্ব আসলে ইতিহাসের মিথ। অন্যদিকে তাঁর স্ত্রী বাস্তবধর্মী নারী, যিনি দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়েনে স্বামীর গৌরবগাথাকে অর্থহীন বলে মনে করেন। মেয়ে লিসির জীবনে প্রেম, গর্ভধারণ ও সমাজের তিরস্কার নারীর ব্যক্তিসত্তার সংকটকে প্রতীকায়িত করে। ছেলে বনি, যুবপ্রজন্মের প্রতিনিধি, যে ইতিহাস ও ধর্মীয় ঐতিহ্যকে প্রশ্ন করে মুক্ত মানবিক পরিচয়ের সন্ধান করে। ক্লিন্টনের মতে, রিজিয়া রহমান ইতিহাসকে কেবল পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করেননি; বরং তিনি দেখিয়েছেন, ইতিহাস মানুষের মানসিক গঠনের অংশ। পর্তুগিজ উপনিবেশ, আরাকানি প্রভাব, বাঙালি সংস্কৃতি—সবকিছুর মিশ্রণে বাংলাদেশের সমাজে যে সংকর সংস্কৃতি জন্ম নিয়েছে, সেটিই উপন্যাসের কেন্দ্র। ‘উত্তর পুরুষ’ তাই এক অর্থে জাতিগত, ধর্মীয় ও ভাষাগত মিলনের আখ্যান।
অধ্যাপক সিলি বলেন, জাতীয় পরিচয় আজকের দিনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, আমেরিকার ক্ষেত্রেও তা–ই। এখনকার আমেরিকায় কিছু গোষ্ঠী চেষ্টা করছে ‘আমেরিকান’ মানে ‘শ্বেতাঙ্গ’, এমনকি ‘পুরুষ’—এই সংকীর্ণ পরিচয় চাপিয়ে দিতে। এতে ভীষণ বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। কে আমেরিকান, কীভাবে তাঁকে চেনা যাবে, তার মানে কী। সিলি বলেন, ‘রিজিয়া রহমান এটি তাঁর উপন্যাসে অত্যন্ত প্রভাবশালীভাবে তুলে ধরেছেন। আমরা কীভাবে নিজেদের পরিচয় নির্ধারণ করি, নাগরিক হওয়ার মানে কী—এ প্রশ্ন নিয়ে তিনি আমাদের ভাবতে বাধ্য করেন। তাঁর মতে, আজ আমাদেরও এই প্রশ্নও করা দরকার যে একটি জাতির নাগরিক হওয়া মানে কী? কারণ, আজ আন্তর্জাতিকতাবাদ ধারণাটি আমেরিকায় কিছু গোষ্ঠীর হাতে কলঙ্কিত হচ্ছে। তাঁরা বলেন, আমেরিকা ফার্স্ট। এটা তাঁর কাছে “দেশের দাস্য” ধারণারই আরেক রূপ। তিনি বলেন, যখন একটি নির্দিষ্ট ভাবনা, একটি একক ঐক্যবোধকে অন্য সবকিছুর ওপরে স্থান দেওয়া হয়, তখন সেটি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। আর এই প্রেক্ষাপটে রিজিয়া রহমান আমাদের দেখিয়েছেন, একটি জাতির নাগরিক হওয়ার মানে আসলে কী, তা ভেবে দেখা কতটা জরুরি।’
জাতীয় পরিচয় আজকের দিনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, আমেরিকার ক্ষেত্রেও তা–ই। এখনকার আমেরিকায় কিছু গোষ্ঠী চেষ্টা করছে ‘আমেরিকান’ মানে ‘শ্বেতাঙ্গ’, এমনকি ‘পুরুষ’—এই সংকীর্ণ পরিচয় চাপিয়ে দিতে। আজ আমাদেরও এই প্রশ্নও করা দরকার যে একটি জাতির নাগরিক হওয়া মানে কী? কারণ, আজ আন্তর্জাতিকতাবাদ ধারণাটি আমেরিকায় কিছু গোষ্ঠীর হাতে কলঙ্কিত হচ্ছে।ক্লিন্টন বি সিলি
এই আলোচনার পর গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক ইতিহাস, আত্মপরিচয়, ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ইতিহাসের সংঘাত নিয়ে আলোচনা করেন। সঙ্গে উপস্থাপক তাঁকে ধরিয়ে দেন, রিজিয়া রহমানের উপন্যাসের একটি চমকপ্রদ বাক্যের কথা, যেখানে উপন্যাসের নায়ক অ্যান্টোনি ইতিহাসে মোহগ্রস্ত ছিল। তিনি জানতে চান, পূর্বপুরুষের ব্যক্তিগত ইতিহাস বনাম রাজনৈতিক ইতিহাসের সংঘাতকে কীভাবে দেখা হবে? গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বলেন, ‘আমরা ইতিহাসের মধ্যেই জন্মেছি, এবং আমরা ইতিহাসের সঙ্গেই অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। বিষয়টা আসলে জটিল। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে, যখন আমরা ইতিহাস লিখতে যাই বা ইতিহাস জানতে চাই, তখন মনে হয়, আমরা তার ভেতরেই আছি।’
বইতে ‘এক মাধ্যম থেকে আরেক মাধ্যমে রূপান্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যজিৎ রায়’ নামের একটি চমৎকার প্রবন্ধ রয়েছে। লেখক আলোচনা করেছেন সাহিত্য, সংগীত বা চিত্রকলার মতো প্রতিটি শৈল্পিক সৃষ্টিই মূলত একধরনের রূপান্তর। একটি ভাব, অনুভূতি বা ধারণাকে ভিন্ন মাধ্যমে নতুন রূপে প্রকাশ করে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্ম ও সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র সৃষ্টিকে একসূত্রে বাঁধা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ নিজের সাহিত্যজীবনে বহুবার এমন রূপান্তর ঘটিয়েছেন। যেমন তাঁর নাটক ‘চিত্রাঙ্গদা’ থেকে পরবর্তীকালে নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’র সৃষ্টি। তেমনি তাঁর নিজের কবিতাগুলোও তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেন, যা তাঁকে এনে দেয় নোবেল পুরস্কার। এখানে রূপান্তর কেবল ভাষার নয়, বরং ভাব, কাঠামো ও চরিত্রের পরিবর্তন, যা শিল্পের নতুন প্রাণসঞ্চার ঘটায়। এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘নষ্টনীড়’ এবং সত্যজিৎ রায়ের তার চলচ্চিত্ররূপ ‘চারুলতা’। ‘নষ্টনীড়’-এ তরুণী চারুলতা, তার স্বামী ভূপতি ও দেবর অমলের সম্পর্কের মধ্যে জটিল মানসিক দ্বন্দ্ব, একাকিত্ব ও আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটে। এই গল্প একদিকে এক বুদ্ধিদীপ্ত নারীর সৃজনশীলতার কাহিনি, অন্যদিকে এক দাম্পত্যের অন্তর্গত নিঃসঙ্গতার প্রতিচ্ছবি। লেখক এখানে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলনও দেখতে পান। বিশেষত তাঁর বৌদি কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে সম্পর্ক এবং তাঁর অকালমৃত্যুর মানসিক অভিঘাত, যা রবীন্দ্রনাথের একাধিক কবিতা ও গল্পে প্রতিফলিত। সত্যজিৎ রায় এই গল্পকে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাষাকে রূপ দিয়েছেন চিত্র, সুর ও নীরবতার মাধ্যমে। সংলাপের চেয়ে মুখভঙ্গি, দৃষ্টি, ক্যামেরা মুভমেন্ট ও সংগীতের ব্যবহারে তিনি সাহিত্যকে দৃশ্যমান জীবনে রূপান্তর করেছেন। ফলে ‘চারুলতা’ হয়ে উঠেছে শুধু একটি গল্পের চলচ্চিত্র নয়, বরং এক গভীর সৃষ্টিশীল রূপান্তর, যেখানে সাহিত্য ও চলচ্চিত্র একে অপরের মধ্যে মিশে গেছে শিল্পের উচ্চতর এক ঐক্যে।
এই অধ্যায় নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে অধ্যাপক ফেরদৌস আজিম প্রথমেই বলে নেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমাদের গর্ব। তাঁর জীবনের ঘটনাগুলো, বিশেষত কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে সম্পর্কের গল্পটিকে একটা রোমান্টিক কাহিনি হিসেবেই আমরা দেখি। কিন্তু যখন আমরা একটি টেক্সট পড়ি, তখন আমাদের উচিত সেই টেক্সটকেই পড়া, জীবনীর রঙে নয়। “নষ্টনীড়”-এর নয়টি অধ্যায় থেকে “চারুলতা” ছবিতে যে চারটি অধ্যায় বেছে নেওয়া হয়েছে তাতে কী যোগ হলো? কী বাদ গেল? সত্যজিৎ রায়ের হাতে সেই চারটি অধ্যায় কতটা বদলে গেল? আমরা জানি, অনুবাদ ও অভিযোজনের ক্ষেত্রে অনেক কিছুই বদলে যায়, মাধ্যম বদলালে ব্যাখ্যাও বদলায়। তবু দর্শকেরা যদি মনে করেন, আমরা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছু বলতে পারব না অথবা যদি মনে করি, প্রেম যদি নারীর জীবনের কেন্দ্র হয়, তবে সেটি দোষ, তাহলে সেটিই তো আমাদের ভাববার বিষয়। যখন আমরা একজন নারীর ভালোবাসাকে সাহিত্যিক প্রতিনিধিত্বে আনি, তখন সেই ভালোবাসার মূল্য দিতে হবে নারীকেই, পুরুষ চরিত্রকে নয়। অমল বিয়ে করে বিদেশে গেলে তার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। কিন্তু চারুলতা ও তার স্বামীর সম্পর্ক, এত কষ্টের পর, তা কেমন রূপ নেবে? বাস্তবে তো কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেছিলেন। যদি সেটা প্রেমের কারণে হয়, তাহলে বারবার সেই কাহিনি আমাদের সাহিত্যে ফিরে আসে এবং প্রতিবারই নারীকে ত্যাগের প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়।’ তাঁর বিশ্বাস, যদি আমরা সাহিত্যে নারীর ভালোবাসার নতুন প্রতিনিধিত্ব তৈরি করতে পারি, তাহলে আমরা এমন এক মুক্ত পরিসরে পৌঁছাতে পারব, যেখানে ভালোবাসার জন্য নারীকেই আর মূল্য দিতে হবে না।
উপস্থাপক যোগ করেন, বইতে সিলি বলেছেন, যেখানে অমল নিজেকে সরিয়ে নেয়, যেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই ক্ষমাপ্রার্থনা করছেন, ‘থাক’। এই ‘থাক’ মানে গল্প শেষ নয়, বরং এক অনির্ধারিত ভবিষ্যতের দিকে উন্মুক্ত হয়ে থাকা। এটাই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে মানবিক মুহূর্ত।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত পররাষ্ট্রসচিবের কাছে ক্লিন্টন সিলিকে বাংলাদেশে নাগরিকত্ব কিংবা অন্য কোনো সরকারি সম্মাননা দেওয়ার আহ্বান জানান ফারুক মঈনউদ্দীন। তিনি অনুষ্ঠানে বিষয়টা দেখবেন বলে জানান।