শ্রদ্ধা

ফুটবল নিয়ে ঘুমাত যে ছেলেটা

খুব স্বাভাবিকভাবেই ডিয়েগো ম্যারাডোনার খেলা তোমরা দেখোনি, তবে তাঁর নাম কে না জানে! কারণ, তিনি সব সময়ের সেরা ফুটবলারদের একজন। ২৫ নভেম্বর চিরকালের মতো বিদায় নিলেন আর্জেন্টিনার এই মহাতারকা। কেমন ছিল তাঁর ছেলেবেলা?

ছবি ১: খেলার মাঠে ছোট্ট ম্যারাডোনা, ছবি ২: গ্রামের ক্লাব লিটল অনিয়নের বন্ধুদের সঙ্গে ম্যারাডোনা (সামনে ডান থেকে দ্বিতীয়), ছবি ৩: বাড়ির সামনে ফুটবল নিয়ে কসরত
সংগৃহীত

১৯৬৩ সালের ৩০ অক্টোবর। ডিয়েগো ম্যারাডোনা সিনিয়রের পরিবারে খুশির দিন, পরিবারের একমাত্র ছেলের তিন বছর পূর্ণ হলো যে। ছেলের নামটা নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়েই রাখা, ডিয়েগো ম্যারাডোনা। কিন্তু খুশির দিনে তেমন আয়োজন নেই। কোনো রকমে সংসার চালানো বাবা ডিয়েগোর সামর্থ্য হয়নি জাঁকজমক আয়োজন করার। তবু ভিলা ফিওরিতো শহরে তাঁদের ছোট্ট ঘরে দাওয়াত দিয়েছেন নিকটাত্মীয়দের। সেদিন কাজিনের কাছ থেকে উপহার হিসেবে প্রথম ফুটবল পেলেন ছোট্ট ম্যারাডোনা।

তারপর তাঁকে পায় কে! আনন্দে সারা দিন কাটে ফুটবলের সঙ্গে। ফুটবল দিয়ে খেলা, ফুটবল নিয়ে খেতে বসা, এমনকি ফুটবল সঙ্গে নিয়ে ঘুমানোও। কোনোভাবেই ফুটবলের সঙ্গ ছাড়েন না। তাঁর ভয়, হাতছাড়া করলে যদি কেউ ফুটবলটা নিয়ে যায় কিংবা চুরি হয়ে যায়! প্রথম প্রথম মা দোনা তোতা তেমন গা করেননি। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনিও বিরক্ত হন। ছেলের পড়াশোনার দিকে ঝোঁক নেই, সারা দিন খালি ফুটবল আর ফুটবল! কোনোভাবেই তাঁকে পড়তে বসানো যায় না। ফুটবলটা কয়েকবার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টাও করলেন। কিন্তু ম্যারাডোনার কাছ থেকে ফুটবল কেড়ে নেওয়া কি এতই সহজ?

ফুটবল যেখানে ম্যারাডোনাও সেখানে

সেই ফুটবলকে সঙ্গী করে ছোটবেলাতেই শুরু করলেন খেলা। তত দিনে মা-বাবা হাল ছেড়ে দিয়েছেন, এই ছেলেকে দিয়ে পড়াশোনা করানো সম্ভব না। তার চেয়ে ফুটবলই খেলুক! পরিবারের এই সমর্থনে আর কিছু ভাবতে হয়নি ম্যারাডোনাকে। মাত্র ৯ বছর বয়সে খেলতে শুরু করেন তাঁদের গ্রামের দল লিটল অনিয়নের হয়ে। রাতারাতি হয়ে গেলেন বিস্ময়বালক। তাঁর চেয়ে কয়েক বছরের বড় ছেলেদের সঙ্গে খেলতে নেমে যে বালক তুখোড়ভাবে বল ড্রিবলিং করে ক্ষিপ্র গতিতে প্রতিপক্ষকে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছেন, তাঁকে তো বিস্ময়বালক বলতেই হয়। শুধু একক নৈপুণ্য দেখিয়ে তিনি যে গোল করেন, তা নয়, দলের অন্যদের দিয়েও গোল করান। সেই চোখধাঁধানো খেলায় ম্যারাডোনা লিটল অনিয়ন দলকে একটি-দুটি ম্যাচ জেতাননি, জেতালেন টানা ১৪০টি ম্যাচ!

তত দিনে তাঁর খেলা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা সবাই নিশ্চিত হয়ে গেছেন, এই ছেলে বিশেষ কিছু করে দেখাবে ফুটবলে। বালক ম্যারাডোনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল দূরদূরান্তে। এমনকি খবরের কাগজেও ছাপা হলো তাঁর নৈপুণ্যের কথা।

বাবা ডিয়েগো তত দিনে ছেলে ম্যারাডোনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। নিজে কষ্ট করে বাড়তি উপার্জন করে ছেলেকে ফুটবল খেলার জার্সি-বুট কিনে দেন, সময় বের করে খেলা দেখতে যান মাঠে। কোনোভাবেই ছেলেকে ফুটবল থেকে ঝরে যেতে দিতে রাজি নন তিনি। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, এই ছেলে একদিন ব্রাজিলীয় তারকা পেলের চেয়েও বড় হবে।

১২ বছর বয়সে ম্যারাডোনা লিটল অনিয়ন ক্লাব ছেড়ে নাম লেখালেন আরেকটু বড় ক্লাব লস সেবোলিটাসে। সেখানেও তাঁর জাদুতে মুগ্ধ দর্শক। ছোটখাটো গড়নের ম্যারাডোনা তখন ‘প্লেমেকার’ হিসেবে খেলেন। অর্থাৎ, গোল করার চেয়ে করানোতে বেশি আগ্রহ তাঁর। ম্যারাডোনার এই নৈপুণ্যেই লস সেবোলিটাস ফিরল জয়ের ধারায়, টানা ১৩৬ ম্যাচ তাদের কেউ হারাতে পারল না!

আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে বড়বেলার ম্যারাডোনা

ছোটবেলা থেকে ম্যারাডোনা খুব কাছ থেকে অভাব দেখেছেন। তাঁর বাবা ডিয়েগো কখনো ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন, কখনো নৌকায় যাত্রী পারাপার করে উপার্জন করতেন। ৮ ভাইবোনের বড় পরিবার, একবেলা সবাই খেলে পরের বেলায় না খেয়ে থাকেন মা দোনা তোতা। তবে বুঝতে দিতেন না কাউকে। ছেলেমেয়েদের বলতেন, ‘আজ পেটটা ব্যথা করছে, তাই খাব না, তোমরা খেয়ে নাও।’ কিন্তু ম্যারাডোনা ঠিকই বুঝতেন মায়ের ছেলভোলানো কথা। তাই যখন নিজের ফুটবলপ্রতিভা বুঝতে পেরেছিলেন, তখনই সিদ্ধান্ত নেন, যে করেই হোক ফুটবল খেলে উপার্জন করে পরিবারের অভাব-অনটন দূর করবেন।

পরিবারের সমর্থন আর নিজের একাগ্রতার সঙ্গে প্রতিভার সমন্বয় ঘটিয়ে ম্যারাডোনা খুব অল্প সময়ে ভাগ্য বদলে ফেলতে পারলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে আর্জেন্টিনা জুনিয়রস দলের হয়ে খেলতে শুরু করলেন পেশাদার ফুটবল। তারপর কেবল সামনে ছুটে চলা।

মাত্র ১৬ বছরে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের জার্সি গায়ে উঠল। তারপরের গল্প তো সবার জানা। আর্জেন্টিনাকে একক নৈপুণ্যে জেতালেন ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১১ জনকে কাটিয়ে করা গোলটিকে ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ আখ্যা দিল ফিফা। ১৯৯০–এর বিশ্বকাপেও আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তুললেন, তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে হেরে গেলেন পশ্চিম জার্মানির কাছে। জাতীয় দলের বাইরে ক্লাবের হয়েও একই রকম সফল ছিলেন তিনি। একে একে আর্জেন্টিনার বোকা জুনিয়রস ক্লাব থেকে ইউরোপে পাড়ি জমিয়ে খেলেছেন বার্সেলোনায়। সেখান থেকে নাপোলিতে নাম লিখিয়ে ম্যারাডোনা একাই গড়লেন ক্লাবের ইতিহাস। হয়ে উঠলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবল খেলোয়াড়।

আর্জেন্টিনার দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া ফুটবলপাগল সেই শিশুটি যে একদিন পুরো বিশ্বকে তাঁর খেলার জাদুতে মাতিয়ে রাখবেন, তা কে জানত!