গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

আলোকচিত্রে গল্প

চিরবিচ্ছেদের নীরবতার স্থিরচিত্র

অতীত পাঠের অনেক ধরনের উপায় রয়েছে। তারিখ, দলিল, স্মৃতিচারণ বা বিবরণীর মধ্য দিয়ে যেমন, আবার এমন কিছু মুহূর্ত রয়েছে যাদের সমস্ত ভার, আবেগ ও বাস্তবতা সবচেয়ে সংক্ষেপে ধারণ করে কেবল একটি আলোকচিত্র। সময়ের সীমানা ভেদ করে টিকে থাকা এসব ছবির পেছনে থাকে একাধিক গল্প। এই ধারাবাহিকের প্রতিটি পর্বে আমরা তুলে ধরব এমনই কোনো বিশ্ববিখ্যাত আলোকচিত্রের অন্তরঙ্গ ইতিহাস।

রাজা আর্থারের ক্যামেলট, যা ইউরোপীয় সাহিত্যে আদর্শ রাজত্ব ও বীরত্বের প্রতীক হয়ে আছে। এর অন্তরে লুকিয়ে আছে একটি নিষিদ্ধ প্রেমের শ্বাসরুদ্ধকর ইতিহাস। স্যার ল্যান্সেলট ও রানি গিনিভারের গোপন সম্পর্ক কেবল রাজকীয় বিশ্বাসঘাতকতার গল্প নয়, বরং এটি এক সভ্যতার নৈতিক পতনের রূপক হিসেবেও উপস্থিত। এই প্রেমের দ্বন্দ্বে দেখতে পাওয়া যায় মানুষের চিরন্তন সংকট, যেমন দায়িত্ব ও আকাঙ্ক্ষা, ন্যায় ও প্রেম, আত্মসংযম ও আত্মবিসর্জনের মুখোমুখি সংঘাতকে।

ক্যামেলটের কিংবদন্তি যেখানে ন্যায়, বীরত্ব ও আত্মসংযমের পূজারূপে দাঁড়ায়, সেখানে ল্যান্সেলট-গিনিভারের সম্পর্ক সেই আদর্শকে ভেতর থেকে ভেঙে দেয়। ইতিহাসের নয়, বরং কল্পনায় নির্মিত এই রাজ্যের পতন আমাদের নৈতিক ও মানসিক জগৎকে প্রশ্ন করে যে মানবিক ভালোবাসা কি কখনো আদর্শের ঊর্ধ্বে যেতে পারে?

এই দ্বন্দ্ব মধ্যযুগীয় নৈতিকতার কেন্দ্রে থাকা প্রশ্নকে সামনে আনে, মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ গুণ কী—কর্তব্য, নাকি প্রেম?
জুলিয়া মার্গারেট ক্যামেরুন

বারো শতকের ফরাসি কবি ক্রেতিয়েন দ্য ত্রোয়া যখন প্রথম ল্যান্সলেট ও গিনিভারের প্রেমকে সাহিত্যিক রূপ দেন, তখন ইউরোপে জন্ম নিচ্ছিল ‘ফিনামোওর’ বা ‘কোর্টলি লাভ’ বা ‘আদর্শ প্রেম’-এর ধারা। এই রীতিতে প্রেম ছিল নিষিদ্ধ ও পাপ। কিন্তু তাতে একধরনের পবিত্র তপস্যার সৌন্দর্য ছিল। সাহিত্যে একজন নাইট তার রানির সেবায় নিজেকে উত্সর্গ করে এবং সেখানে প্রেমকে ধর্মের মতো নিবেদনের প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়।

ল্যান্সলেট এই আদর্শেরই প্রতিমূর্তি। তিনি রাজা আর্থারের শ্রেষ্ঠ সেনাপতি। কিন্তু তাঁর বীরত্বের উৎস রাজরানির প্রতি প্রেম। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর প্রতিটি জয়, প্রতিটি মহিমা মূলত গিনিভারের প্রতি ভক্তির প্রকাশ। কিন্তু এই প্রেমই আবার তাঁকে আধ্যাত্মিক পথ থেকে বিচ্যুত করে। তাঁর আনুগত্য দুই ভাগে বিভক্ত করে দেয়। একদিকে রাজা ও ঈশ্বরের প্রতি, অন্যদিকে প্রেম ও মানবিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি। ফলে তিনি কখনো পবিত্র গ্রেইল অর্জনের যোগ্য হতে পারেন না। (পবিত্র গ্রেইল হলো একটি কিংবদন্তি পবিত্র পানপাত্র, যা মূলত শেষ নৈশভোজে যিশুখ্রিষ্টের ব্যবহৃত পানপাত্র বা আরিমাথিয়ার জোসেফ যিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণের সময় তাঁর রক্ত সংগ্রহ করার জন্য ব্যবহার করেছিলেন বলে মনে করা হয়। এটি মধ্যযুগীয় কিংবদন্তি, বিশেষ করে আর্থারিয়ান কিংবদন্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি রহস্য ও মুগ্ধতার উৎস হয়ে আছে)। ফলে এই দ্বন্দ্ব মধ্যযুগীয় নৈতিকতার কেন্দ্রে থাকা প্রশ্নকে সামনে আনে, মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ গুণ কী—কর্তব্য, নাকি প্রেম?

‘দ্য পার্টিং অব স্যার ল্যান্সেলট অ্যান্ড কুইন গিনিভিয়ার’। আলোকচিত্রী: জুলিয়া মার্গারেট ক্যামেরুন

পনেরো শতকে স্যার থমাস ম্যালরি তাঁর মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘লে মর্ট ডি আর্থার’–এ ল্যান্সেলট-গিনিভারের প্রেমকে ট্র্যাজিক আকার দেন। এখানে প্রেমকে আর আদর্শ নয়, বরং পাপ ও পতনের প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়। ম্যালরির বর্ণনায়, ষড়যন্ত্রকারী আগ্রাভেন ও মর্ড্রেডের ফাঁদে ধরা পড়ে এই নিষিদ্ধ সম্পর্কের গোপন রহস্য।

যখন ল্যান্সেলট পালিয়ে যান, তখন তাঁর তলোয়ারের আঘাতে নিহত হন রাজ্যের বহু নাইট, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন গাওয়েনের দুই ভাই গ্যারেথ ও গাহেরিস। রাজরানিকে রাজদ্রোহের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আইন ও আবেগের দ্বন্দ্বে রাজা আর্থার নিজেও অসহায় হয়ে পড়ে। ল্যান্সেলটকে রক্তাক্তভাবে উদ্ধার করা হয়, যখন তিনি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া আগুন থেকে রানিকে মুক্ত করেন। সেই মুহূর্তে প্রেম ও কর্তব্যের সীমা মুছে যায় এবং রাজ্যের নৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। মূলত এ সময়কেই ক্যামেলট পতনের সূচনা হিসেবে বলা হয়।

দুই ভাই হারানোর শোক ও রক্তের ঋণ শোধ করার নিমিত্তে গাওয়েনের ক্রোধ যুদ্ধে রূপ নেয়। রাজা আর্থারও বাধ্য হন নিজের প্রিয়তম বন্ধুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে। ফলে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এই গৃহযুদ্ধ যেন এক প্রতীকী আত্মবিনাশ, যেখানে বন্ধুত্ব, আনুগত্য ও প্রেম—সবই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

পরবর্তীকালে ল্যান্সেলট আশ্রয় নেন ফ্রান্সে; আর্থার তাঁকে তাড়া করেন, কিন্তু এই বিভক্তির সুযোগে রাজ্যের ভেতরে জন্ম নেয় বিশ্বাসঘাতকতা। আর্থারের অবর্তমানে মর্ড্রেড রাজসিংহাসন দখল করেন। কামলানের যুদ্ধক্ষেত্রে আর্থার তাঁর নিজের সন্তানসদৃশ শত্রুকে হত্যা করে নিজেও মৃত্যুবরণ করেন। সামগ্রিক যুদ্ধে কেবল এক রাজ্যের নয়, সম্পূর্ণ একটি যুগের মৃত্যু হয়।

ল্যান্সেলট ও গিনিভারের সম্পর্ককে বহু সমালোচক ‘সভ্যতার আত্মদর্শন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডে যেখানে বীরত্বের সঙ্গে ধর্মীয় পবিত্রতা অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত, সেখানে এই প্রেম সেই বিশ্বাসের বিপরীত।

রাজ্যের ধ্বংসের পর ল্যান্সেলট ও গিনিভিয়ার অবশেষে তাঁদের অপরাধের গভীরতা উপলব্ধি করেন। তাঁরা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। গিনিভিয়ার সন্ন্যাসিনী হিসেবে কনভেন্টে প্রবেশ করেন, ঈশ্বরের কাছে মুক্তির প্রার্থনায় লিপ্ত হন। অন্যদিকে ল্যান্সেলট পরিত্যাগ করেন বীরত্ব, যুদ্ধ ও মানবসমাজ এবং নির্জন বনে গিয়ে সন্ন্যাসীর জীবন বেছে নেন।

তাঁদের এই বিচ্ছেদ কেবল অনুতাপ নয়, উপরন্তু এটি মানবজীবনের নৈতিক উপলব্ধির প্রতীক। ফলে বলা যায়, প্রেম যত গভীরই হোক, তা যদি ন্যায়ের ভিত্তি ভেঙে দেয়, তবে তার ফলাফল হয় অনিবার্য ধ্বংস।

ল্যান্সেলট ও গিনিভারের সম্পর্ককে বহু সমালোচক ‘সভ্যতার আত্মদর্শন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডে যেখানে বীরত্বের সঙ্গে ধর্মীয় পবিত্রতা অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত, সেখানে এই প্রেম সেই বিশ্বাসের বিপরীত। রানির চরিত্রকেও বিভিন্ন দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রি-রাফায়েলাইট শিল্পীরা যেমন গিনিভারের মধ্যে সৌন্দর্য, অনুতাপ ও নিষ্ঠার মিশ্র প্রতীক দেখেছেন, তেমনি আধুনিক সমালোচকেরা তাঁকে নারীস্বাধীনতার সূক্ষ্ম রূপ হিসেবে দেখেছেন, যিনি ভালোবাসার জন্য সমাজের আইন অমান্য করতে সাহসী, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আত্মদায়িত্বের পথ বেছে নিয়েছেন। অন্যদিকে ল্যান্সেলট এমন এক ট্র্যাজিক নায়ক, যিনি একই সঙ্গে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে দুর্বল। তাঁর প্রেমই তাঁকে মহান করে, আবার সেই প্রেমই তাঁকে পতনের দিকে ঠেলে দেয়।

‘আইডিলস অব দ্য কিং’, গুস্তাভ ডোর, ১৮৬৭

১৮৭৪ সালের আগস্ট মাসের শেষ দিকে ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ কবি অ্যালফ্রেড লর্ড টেনিসন আলোকচিত্রশিল্পী জুলিয়া মার্গারেট ক্যামেরনকে প্রস্তাব দেন তাঁর বিখ্যাত কাব্যসংকলন ‘আইডিলস অব দ্য কিং’ (১৮৭২)–এর জন্য একটি ধারাবাহিক ফটোগ্রাফিক চিত্রায়ণ নির্মাণ করতে। প্রায় ৪০ বছরের সৃজনকালজুড়ে রচিত এই মহাকাব্যিক রচনায় টেনিসন আর্থারিয়ান কিংবদন্তির প্রেম, কর্তব্য ও পতনের কাহিনি চিত্রিত করেছেন। প্রকল্পটি ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও শ্রমসাধ্য, কিন্তু তাতে ক্যামেরনের উৎসাহ একটুও কমেনি, বরং কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। টেনিসন ছিলেন তৎকালীন ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ কবি; আর তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়ে জুলিয়া মার্গারেট ক্যামেরন আশা করেছিলেন একদিকে আর্থিক সাফল্য, অন্যদিকে শিল্পী হিসেবে নিজের মর্যাদার আরও দৃঢ় স্বীকৃতি। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এটা প্রমাণ করতে যে ফটোগ্রাফিও চিত্রকলা বা বইয়ের অন্য যেকোনো অলংকরণের সমান শিল্পরূপ হতে সক্ষম।

ক্যামেরনের ছবিটি টেনিসনের কাব্যের এক মর্মস্পর্শী মুহূর্তকে দৃশ্যমান করে, যা চিরবিচ্ছেদের আগে স্যার ল্যান্সেলট ও রানি গিনিভারের শেষ আলিঙ্গনকে প্রস্ফুটিত করে।
কবি অ্যালফ্রেড লর্ড টেনিসন

ফলে জুলিয়া মার্গারেট ক্যামেরন এমন এক নিবিড় অনুসন্ধান আরম্ভ করেন যেন টেনিসনের কবিতার প্রতিটি চরিত্রের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত মুখ ও অভিব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি তাঁর স্বামী, ভাগনে-ভাগনি, বন্ধুবান্ধব ও অতিথিদের ব্যবহার করেন মডেল হিসেবে। প্রতিটি চরিত্রকে কবিতার ভাব ও বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে তোলার জন্য তিনি অবর্ণনীয় পরিশ্রম করতে থাকেন। বিশেষ করে ‘দ্য পার্টিং অব স্যার ল্যান্সেলট অ্যান্ড কুইন গিনিভিয়ার’ আলোকচিত্রটি ধারণ করার জন্য তিনি কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়ার আগপর্যন্ত ৪২টি নেগেটিভ খরচ করেন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল স্যার ল্যান্সলটের চরিত্রের জন্য উপযুক্ত মডেল খুঁজে পাওয়া। অবশেষে তিনি স্থানীয় ইয়ারমাউথ পিয়ারের এক সাধারণ কুলিকে এই ভূমিকায় বেছে নেন, যাঁর চেহারা ও ভাবভঙ্গি তাঁর কাছে সাবজেক্ট হিসেবে যথার্থ মনে হয়েছিল।

ক্যামেরনের ছবিটি টেনিসনের কাব্যের এক মর্মস্পর্শী মুহূর্তকে দৃশ্যমান করে, যা চিরবিচ্ছেদের আগে স্যার ল্যান্সেলট ও রানি গিনিভারের শেষ আলিঙ্গনকে প্রস্ফুটিত করে। মূল কবিতার এই অংশে টেনিসন লিখেছিলেন—

ল্যান্সেলট বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও থেকে যেত,
তবু তারা মিলিত হতো, আবার, বারবার।
অতঃপর রানি বললেন,
‘ও ল্যান্সেলট, যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো, তবে এবার চলে যাও।’

তারা স্থির করল এক নির্জন রাত্রি
যখন শ্রদ্ধেয় রাজা থাকবেন না প্রাসাদে,
তখন তারা শেষবারের মতো মিলিত হবে,
তারপর হবে চিরতরে বিচ্ছিন্ন।

অতঃপর তারা মিলল—
প্রেমের উত্তাপে নয়, বিদায়ের শোকে ফ্যাকাসে হয়ে।
হাত ধরে, চোখে চোখ রেখে বসে রইল
রানির শয্যার কিনারে, নিচু স্বরে, জড়ানো ভাষায়—
কোনো শব্দ ভেসে উঠল না, কেবল নীরব চাহনি,
কারণ এ ছিল তাদের শেষ ক্ষণ,
এক উন্মাদ বিদায়ের প্রলয়ক্ষণ।

এই কবিতাংশের দৃশ্যকেই জুলিয়া মার্গারেট ক্যামেরন রূপ দিয়েছিলেন তাঁর আলোকচিত্রে, যেখানে আলো ও ছায়ার নাটকীয় সংলাপে ধরা পড়ে ভালোবাসার শেষ সংকোচ, চিরবিচ্ছেদের নীরবতা ও মানব-আবেগের চূড়ান্ত পরিণতি।