মুখবন্ধ
শার্ল বোদলেয়র (১৮২১-১৮৬৭) এখন বিশ্বব্যাপী উনিশ শতকের সেরা ফরাসি কবি পরিচয়ে বিখ্যাত। তিনি দীর্ঘজীবী হতে পারেননি। তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত একমাত্র কবিতার বই—‘আবর্জনার ফুল’ (১৮৫৭)। বইটির পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ পায় ১৮৬১ সালে। ১৮৬৯ সালে—কবির ইন্তেকালের দুই বছর পর তাঁর অনুরাগী বন্ধুরা প্রকাশ করেন ‘পারির বিষাদ: গদ্যে লেখা ক্ষুদে পদ্য’। এখানে যে চারটি কবিতার তর্জমা পেশ করলাম, তাদের প্রথম দুইটি ‘আবর্জনার ফুল’ থেকে আর শেষ দুইটি ‘পারির বিষাদ’ থেকে নেওয়া। তিনটি (১-৩) বুদ্ধদেব বসুর ‘শার্ল বোদলেয়ার: তাঁর কবিতা’ (১৯৬০) গ্রন্থে পাওয়া যায়। দুটি কবিতা (৩-৪) গৌতম পালের ‘শার্ল বোদল্যারের লিপিকা’ (২০০৯) পুস্তকেও মেলে।
— সলিমুল্লাহ খান
আমাদের বিছানা হবে হালকা আতরমাখা,
কবরের মতো গাড়া তাকিয়া আমাদের,
তাকে তাকে থাকবে সুন্দরতর আকাশের তলে
ফোটা বিদেশি ফুলের তোড়া।
জীবনের শেষ উমটুকু খরচা করবে বলে
আমাদের দুই হৃৎপিণ্ড হবে গোটা দুই বিশাল
মশাল, তাদের দ্বিগুণ আলো পড়ে ফিরবে
আমাদের দুই মনে, এক জোড়া আয়নার ওপর।
মায়াবী নীল আর গোলাপি কোনো সন্ধ্যায় আমরা,
একে অপরকে দেব সুদীর্ঘ বিদায়ভরা
ফোঁপাকান্নার মতন মাত্র এক বিদ্যুচ্চমক;
বহুদিন পর পুরোনা দর্পণ আর মরা অগ্নিশিখা
আবার জ্বালাতে সন্তর্পণে, দরজা ঠেলে,
আসবেন দ্বীনদার, সহাস্যবদন, ফেরেশতাপ্রবর।
প্রথম প্রকাশ: ১৮৫১
একমাত্র মৃত্যুই সান্ত্বনা দেয়, আহা! বাঁচিয়ে রাখে সে;
জীবনের অনন্য লক্ষ্য, একমাত্র আশা;
মৃতসঞ্জীবনীর মতন জাগায় সে, আমাদের মাতাল করে
আর সন্ধ্যা না নামা তক পা পা চলবার হিম্মত জোগায়।
ঝড়ঝঞ্ঝা, তুষার, বরফপারের কুলে, কৃষ্ণ দিকচক্রবালে,
একমাত্র দপদপে আলো সেই;
আসমানি কিতাবে প্রতিশ্রুত প্রখ্যাত সরাইখানা
যেখানে লোকে পান ও ভোজন সেরে গা গড়াতে পারে;
সে ফেরেশতা ঘুম পাড়ায় চুম্বকের আঙুল বুলিয়ে
উপহার দেয় হর্ষমাখা স্বপ্ন , গরিব আর বস্ত্রহীন
মানুষের শয্যা পেতে রাখে;
দেব-দেবতার গর্বের ধন সে, গা–ছমছম গোলাঘর,
গরিবের রত্নাগার, পিতা-পিতামহক্রমে প্রাপ্ত জমিজমা,
খোলা দরজা তার, সম্মুখের আকাশ অচেনা।
প্রথম প্রকাশ: ১৮৫২
‘বলো দেখি, দুর্বোধ্য মানুষ, কাকে তুমি ভালোবাসো সবচেয়ে বেশি,
তোমার বাবা, মা, বোন না ভাই?’
‘আমার বাবা, মা, বোন বা ভাই, কেহ নাই।’
‘বন্ধুবান্ধব?’
‘কথাটার অর্থ কী, তা তো কখনো বুঝিনি।’
‘তোমার স্বদেশ?’
‘পাব তাকে কোন অক্ষরেখায়?’
‘সুন্দর?’
‘সে যদি দেবী অমরাবতী ভালোবাসব তাকে আনন্দভৈরবী।’
‘টাকা?’
‘নিকুচি করি তার, যেমন আপনারা ঈশ্বরের।’
‘আচ্ছা, মহামতি বিদেশি, কী তুমি ভালোবাসো?’
‘আমি ভালোবাসি মেঘ...উড়ে চলা মেঘ...ওই...ওই দূরে ওইখানে... আশ্চর্য মেঘ আর মেঘ!’
প্রথম প্রকাশ: ১৮৬২
ফুটফুটে যে শিশুকে ঘিরে সকলে মজায় মেতে উঠেছিল, তাকে দেখে ছোটখাটো, চামড়া কুঁকড়ে ওঠা বৃদ্ধার মনটা আনন্দে ভরে গেল। জিনিসটা এমন সুন্দর, এমন ভঙ্গুর, একান্ত তার, ছোটখাটো বৃদ্ধার নিজের মতো, তারই মতো দাঁতহীন আর চুলহীন।
এই না ভেবে শিশুর খানিকটা কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি, ভাবলেন একটু সাধ-আহ্লাদ করবেন, আর একটু মুখ টুকে ভেংচি কাটবেন।
কিন্তু যেই না জীর্ণাশীর্ণা বৃদ্ধা একটা চুম্বনের কোশেশ করলেন, শিশুটি অমনি ভয় পেয়ে এমন হাত-পা ছোড়াছুড়ি শুরু করল যে তার চিল্লাপাল্লায় ঘর উপচে পড়ল।
তো বেচারি চিরাচরিত যে নির্জনের অধিবাসী, তড়িঘড়ি সেই আপন নির্জনে ফিরে গেলেন; লোকচক্ষুর আড়ালে খানিক কেঁদে নিলেন। মনে মনে বললেন: ‘আহা, আমাদের মতন পুরানা থলের সে সুদিন কি আর আছে! কারও মনই জোগাতে পারি না আমরা, একটা মাসুম বাচ্চার পর্যন্ত না। যে পুচকে সোনামণিদের ভালোবাসতে আমরা এহেন ব্যাকুল, তারা আমাদের দেখে শিউরে ওঠে!’
প্রথম প্রকাশ: ১৮৬২