
বাংলা সাহিত্য ও জ্ঞানতাত্ত্বিক ইতিহাসে গভীর আবেগ ও শ্রদ্ধার স্মারক হয়ে আছে জুলাই মাস। এই মাসেই আমরা স্মরণ করি দুই গুণী ব্যক্তিত্বকে—আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের শক্তিমান লেখক আলাউদ্দিন আল আজাদ এবং বিশুদ্ধ পাণ্ডিত্য, মননশীলতা ও গবেষণার জন্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে। ৩ জুলাই মৃত্যুদিনে আমরা স্মরণ করি আলাউদ্দিন আল আজাদকে, যাঁর উপন্যাস, গল্প ও কবিতা আমাদের সাহিত্যকে দিয়েছে নতুন মাত্রা ও বিবেকের আলো। আবার ১০ জুলাই জন্মদিন ও ১৩ জুলাই মৃত্যুদিনে স্মরণ করি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, যিনি শুধু ভাষাতত্ত্বের ক্ষেত্রেই নন, বরং গোটা বাঙালি আত্মপরিচয়ের নির্মাণেও রেখেছেন অনন্য অবদান।
এ ভূখণ্ডে পঞ্চাশের দশকে কথাসাহিত্য যাঁদের হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়েছিল, আলাউদ্দিন আল আজাদ তাঁদের একজন। তিনি প্রধানত মানবতাবাদী ও প্রগতিশীল ভাবধারায় সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। ১৯৬০ সালে ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ এবং ১৯৬২ সালে ‘ক্ষুধা ও আশা’ উপন্যাস দুটির প্রকাশের মধ্য দিয়ে হয়েছিলেন তুমুল আলোচিত। এছাড়া অসংখ্য গল্প, কবিতা, কাব্যনাট্য, প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে আলাউদ্দিন আল আজাদ বাংলা সাহিত্যে নিজের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ ও গবেষক। ১৯৩২ সালের ৬ মে নরসিংদী জেলার রায়পুর থানার রামনগর গ্রামে তাঁর জন্ম এবং ২০০৯ সালের ৩ জুলাই ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
গত শতকের ষাটের দশকে আলাউদ্দিন আল আজাদ পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তৎকালীন সরকারের রোষানলে পড়া—বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে—সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে ১৯৬১ সালে আজাদ গ্রেপ্তার হন। সে বছরই মুচলেকা দিয়ে রাজবন্দিত্ব থেকে মুক্তিলাভ করেন। কারাবাসকালে আলাউদ্দিন আল আজাদ একটি চিঠি লিখেছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে (জন্ম: ১০ জুলাই ১৮৮৫—মৃত্যু: ১৩ জুলাই ১৯৬৯)।
চিঠিটিতে আলাউদ্দিন আল আজাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেবার আগ্রহ, যোগ দিতে না পারার খেদ; সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করার দৃঢ় সংকল্প ও কারাবাসকালীন অবসরে তাঁর ফরাসি ভাষাশিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহের কথা জানা যাচ্ছে। ফরাসি বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে পাঠনির্দেশিকামূলক বইপত্র জেলে তাঁকে সরবরাহ করার জন্য তিনি অনুরোধ করেছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে। এছাড়াও, তাঁর কালের বর্ষীয়াণ মনীষা—ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে চিঠিতে তিনি বাংলা সাহিত্যের ‘প্রাচীনতম যোগসূত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
চিঠিটি ২০২৫ সালে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ: অগ্রন্থিত চিঠিপত্র’ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখানে টীকাসহ চিঠি ও খামের ছবি যুক্ত করা হলো। মূল চিঠি মুর্তজা বশীর ট্রাস্টে সংরক্ষিত।
Alauddin Al Azad/ Security Prisoner, Dacca Central Jail/ 10.6.61
পরম শ্রদ্ধাস্পদেষু,
আমার সালাম ও কদমবুচি গ্রহণ করবেন। দুর্ভাগ্যবশত আমি এখন রাজবন্দী১। আমার দুঃখ ও দুর্যোগভরা জীবনে যে ক’জন মানুষের অকৃত্রিম স্নেহ লাভ করেছি, তাদের মধ্যে আপনি অন্যতম, এ আমি কোনো দিন ভুলব না। আপনি জানেন, আমার উচ্চাশা ছিল ঢাবির একজন মহান শিক্ষক হওয়া এবং সে পথে আপনার সাফল্যের আদর্শ আমার প্রেরণাস্বরূপ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে কাজ নিয়ে আমার স্বপ্ন ও সাধ সার্থক করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু এখানেও কপালই বাদ সাধল৷ আজকের দিন পর্যন্ত আমি বুঝতে পারলাম না আপনার প্রিয় ছাত্র বর্তমান বিভাগীয় প্রধান২ কোন অপরাধে আমাকে অপছন্দ করলেন। অথচ আপনি থাকলে আমার কল্পনা বাস্তবে রূপায়িত হতে পারত।
যাক, সে অধ্যায় আমি পরিত্যাগ করেছি; এবং কারও বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ নেই, উষ্মাও নেই। পেশাগত কারণে শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম: কিন্তু লেখা, সাহিত্যই আমার সমগ্র সত্তা, সাহিত্যই আমার জীবন; তাই চাকরিতে উন্নতির আশা পরিত্যাগ করে সামগ্রিকভাবে লেখায় মন দিয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারছি, সাহিত্য-সাধনার পথও কুসুমাস্তূপ নয়।
যা–ই হোক, জেলে এসে অখণ্ড অবসর পেলাম। একটা কিছু কাজ নিয়ে না থাকলে সময় কাটানো দায়। অনেক দিন থেকেই আমার কয়েকটি বিদেশি ভাষা শিখবার শখ ছিল। সেগুলোর মধ্যে ফরাসির প্রতি আকর্ষণটাই বেশি। ফরাসি-মানস ও বাঙালি-মানসের মধ্যে একটি সাদৃশ্য আছে বলে মনে হয়; সেদিক থেকে তো বটেই, ফরাসি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কীর্তিসমূহকে মূলে পাঠ করবার আগ্রহও কম নয়। এ প্রসঙ্গে আপনার কথা মনে পড়ে গেল; এবং দ্বিতীয়ত আপনি কেমন আছেন, তা জানবার জন্যও এই চিঠি লিখছি।
আপনি, কোনো এক সময়ে, বেশ ভালোভাবেই ফরাসির চর্চা করেছেন। প্রমাণ আপনার পিএইচডি, থিসিস৩, যা নাকি ফরাসি ভাষায় লেখা। সে জন্য আবেদন করছি, আপনি যদি আমার এই আকাঙ্ক্ষাটি পূর্ণ করেন, তো ভালো হয়। ফরাসির বর্ণপরিচয়ও আমার নেই; সে জন্য একটি ক্রমিক পাঠতালিকার প্রয়োজন। মোটামুটি, বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে ভাষাটাকে সাধারণভাবে আয়ত্ত করবার জন্য যে বইপত্রের দরকার, পাঠনির্দেশসহ সেগুলো আপনার কাছ থেকে চাই। আশা করি, আপনার অনুগ্রহ থেকে আমি বঞ্চিত হব না।
বাংলা একাডেমির অভিধান-সম্পাদনা৪ কি শেষ হয়েছে? আর কিসের ওপর কাজ করছেন? আপনার সমগ্র রচনাবলি সম্পাদিত অবস্থায় অবিলম্বে প্রকাশ হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। কারণ, আমাদের সাহিত্যের আপনি প্রাচীনতম যোগসূত্র।
বিশেষ আর কী, আপনার শরীর কেমন আছে জানাবেন এবং আমার জন্য দোয়া করবেন। আপনার দীর্ঘতর সুস্থ পরমায়ু কামনা করি।
ইতি/ আপনার স্নেহের/ আলাউদ্দিন আল আজাদ
১. আলাউদ্দিন আল আজাদ ১৯৬১ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে কারাবরণ করেন। তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পান যে তিনি আর সরকারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেবেন না। সেই বছরই কারাগারে থাকার পর, তিনি বামপন্থী রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন এবং এরপর সাহিত্য ও গবেষণায় মনোযোগ দেন। প্রখ্যাত নাট্যকার মুনীর চৌধুরীও একইভাবে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন।
২. মুহম্মদ আবদুল হাই।
৩. ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ফ্রান্সের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর থিসিসটি ফরাসি ভাষায় লেখা, বিষয় ছিল ‘সরহপাদ ও কাহ্নুপার গান’, যা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। তিনি ১৯২৮ সালে এই গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করেন।
৪. ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত সবচেয়ে বিখ্যাত অভিধান হলো ‘বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’। এটি বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয়। এই অভিধান বাংলা ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ নিয়ে প্রথম গবেষণার পরিচয় বহন করে।