অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শ্রদ্ধাঞ্জলি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: তোমার ভাষা বোঝার আশা

কিংবদন্তি অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মৃদুভাষী ছিলেন। আজ (১০ অক্টোবর ‘২৫) নির্বাক হলেন। কিন্তু আমাদের ওপর কেমন প্রভাব রেখে গেলেন?

মিত-মৃদুবাকের জন্য পুরো পশ্চিমের সাহিত্যে—প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগের—সফোক্লেস থেকে টি এস ইলিয়টের লেখায় একজন দেবতা প্রভাব বিস্তার করে আছেন, তিনি টাইরেসিয়াস। টাইরেসিয়াস অন্ধ দেবতা ছিলেন। দেবী এথেনা তাঁর দৃষ্টিশক্তি হরণ করেছিলেন। কিন্তু বিনিময়ে তিনি লাভ করেছিলেন দিব্যজ্ঞান। তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের কথা জানতেন। কিন্তু কথা বলতেন কম। যেসব কথা বলতেন, তা অনেক সময় হতো ভয়ংকর সত্য। ফলে সত্য কথার জন্য তাঁকে লোকে ভয় পেত আর অপছন্দও করত। সফোক্লেসের ‘কিং ইডিপাস’ নাটকে আমরা দেখি থিবস নগরীর প্লেগ, খরা ও শস্যহানির জন্য রাজা ইডিপাস যখন দোষী ব্যক্তিকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন, তখন রাজসভার ভবিষ্যদ্বক্তা টাইরেসিয়াস নিশ্চুপ রয়েছেন। রাজা দেবী ডেলফির মন্দির থেকে কিছু হেঁয়ালিপূর্ণ বাণী পেয়েছেন, যা অবিশ্বাস্য। এ রাজ্যে একমাত্র প্রকৃত কারণ জানেন টাইরেসিয়াস। কিন্তু তিনি চুপ রয়েছেন।

কানার হাটবাজারে তিনি মাঝেমধ্যে এমন কিছু কিছু কথা বলতেন, যাতে সবাই নড়েচড়ে বসত। ‘এই দেশে চারদিকে কেবল প্রশাসক দেখি; দার্শনিক, বিজ্ঞানী দেখি না’—তাঁর এই কথা ফটোকার্ড হিসেবে সর্বশেষ ভাইরাল হয়েছিল।

রাজা তাঁর দ্বারস্থ হয়েছেন অবশেষে। টাইরেসিয়াস কিছুতেই মুখ খুলতে রাজি হলেন না। রাজা তখন তাঁর ওপর প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনলেন। অভিযোগ করলেন, রাজার শ্যালকের সঙ্গে মিলে তিনি রাজাকে উৎখাতের যড়যন্ত্রে লিপ্ত। রাজদ্রোহের এ অভিযোগের মুখে একসময় টাইরেসিয়াস মুখ খুললেন। অল্প কথায় জানালেন, মাতৃগামী সে অপরাধী ব্যক্তি রাজা নিজেই। আখেরে টাইরেসিয়াসের কথা সত্য প্রমাণিত হলো। রাজা দুচোখে মায়ের খোঁপার কাঁটা বিঁধিয়ে অন্ধত্ব বরণ করে রাজ্যত্যাগ করলেন। ভবিষ্যতের পাঠকেরা জানতে পারলেন, অন্ধ ছিলেন আসলে রাজা নিজেই। টাইরেসিয়াস ছিলেন দ্রষ্টা।

সৈয়দ মনজুর চশমা পরতেন, তবে অন্ধ ছিলেন না। কিন্তু জন্মেছিলেন সেই যুগে যে যুগে ‘যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা’। কানার হাটবাজারে তিনি মাঝেমধ্যে এমন কিছু কিছু কথা বলতেন, যাতে সবাই নড়েচড়ে বসত। ‘এই দেশে চারদিকে কেবল প্রশাসক দেখি; দার্শনিক, বিজ্ঞানী দেখি না’—তাঁর এই কথা ফটোকার্ড হিসেবে সর্বশেষ ভাইরাল হয়েছিল।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম (১৮ জানুয়ারি ১৯৫১–১০ অক্টোবর ২০২৫)

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার আমার সতীর্থ ছিলেন দুটো প্রতিষ্ঠানে। সিলেট এমসি কলেজ ও কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি। আমরা জন্মেছিলামও একই অঞ্চলে। সিলেটে। কিন্তু এসব তথ্যের ভেতর দিয়ে আমি নিজেকে কোনোভাবেই কোনো দিক থেকেই তাঁর সমকক্ষ ভাবতে পারিনি। ফলে তাঁর প্রতি আমার সব সময় একধরনের সম্ভ্রমমাখা ভীতি কাজ করত। তিনি সব সময় গম্ভীর ও সৌম্য একটি ভাব নিজের ভেতর বজায় রাখতেন। এই আপাত ভাবটিও ভয়ের অন্যতম উৎস হয়তো ছিল।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে প্রথম কবে, কোথায় পরিচয় হয়, তা ঠিক মনে নেই। প্রথম প্রীতিময় সম্পর্ক তৈরি হয় একটি বই বিনিময়ের মাধ্যমে। সেই সাল ও ক্ষণটি আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্প থেকে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কাঠ চেরাইয়ের শব্দ’। বইটি প্রকাশের পর সে সময়ের তরুণ পাঠক সমাজে খানিকটা আলাপের জন্ম দেয়। আমার ইচ্ছা হয় মহাজনদেরও মতামত জানার। সেই বাসনা থেকে এক দুপুরে স্যারের কাছে উপস্থিত হই। স্যার স্বভাবসুলভভাবে সিলেটি হিসেবেই আমাকে গ্রহণ করেন এবং আঞ্চলিক ভাষায় মৃদুমন্দ আলাপ শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর আমি আমার বইটি বের করে স্যারের হাতে দিই।

স্যার খুবই আগ্রহের সঙ্গে বইটি গ্রহণ করতে করতে বলেন, ‘বইটির কথা আমি আগেই শুনেছি। সংগ্রহের অপেক্ষায় ছিলাম।’ তাঁর এই ছোট্ট ‘সংগ্রহের অপেক্ষায় ছিলাম’ বাক্যটি আমাকে উদ্বেলিত করে। আনন্দিত করে। এত বড় একজন লেখক একটি সদ্য তরুণ বইয়ের খোঁজ রেখেছেন এবং সংগ্রহের অপেক্ষায় ছিলেন, এটি আমার জন্য ও সবার জন্যই একটি দারুণ বার্তা ছিল। স্যার সত্যিকার অর্থেই তরুণদের লেখার খোঁজখবর রাখতেন। পরে বিভিন্ন আসরে একান্তে নানা আলাপে তাঁর প্রমাণ পেয়েছি। তিনি একসময় তাঁর অনেক জুনিয়র লেখক ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে মিলে যৌথ উপন্যাস লিখেছেন। এ নিয়ে সে সময় তরুণ সাহিত্য সমাজে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়েছিল। স্যার এ প্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন, ‘লেখাটি কেমন হয়েছে বলো।’ আমি বলেছিলাম, ‘নিরীক্ষা হিসেবে বেশ।’ ‘কমলকুমারের নিরীক্ষার সমতুল্য নয় নিশ্চয়ই’ বলে মৃদু হেসেছিলেন।

একদিন কোনো এক আসরে স্যার তাঁর সঙ্গে পরে একা দেখা করতে বলেন। দেখা করতে গিয়ে দেখি, থিসিসটি তাঁর হাতে। একাডেমি রিভিউ করতে তাঁর কাছে পাঠিয়েছে। স্যার থিসিসটির নানা মতামত বিষয়ে আলাদা নোট নিয়ে রেখেছেন।

আমার গবেষণাচর্চার দীর্ঘদিনের বিষয় ছিল কমলকুমার এবং একটা পর্যায়ে মনে হয়েছিল, আমি কমলকুমার সম্পর্কে বেশ জানি। আমার ভুল দুই সৈয়দ অল্প সময়ের ভেতর ভেঙে দিয়েছিলেন। প্রথম সৈয়দ ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান আর দ্বিতীয় সৈয়দ—সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। সৈয়দ আলী আহসান তখন নিভৃতচারী। কোথাও বের হন না বা সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান না। আমার সঙ্গে দেখা হয় এক ঘটনাচক্রে। জাঁ মিশেল তখন ঢাকার ফরাসি দূতাবাসে নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে সবে যোগদান করেছিলেন। ফরাসিরা রাজনীতির চেয়ে শিল্পের প্রতি বেশি দরদি হবেন, এটাই স্বাভাবিক। তিনি ঢাকায় যোগদানের কয়েক দিন পরই তাঁর বাসায় ঢাকার শিল্প-সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নৈশভোজের দাওয়াত দেন। আমি তখন সংবাদপত্রে কাজ করি। দাওয়াত পাই সে সূত্রে। রাষ্ট্রদূতের বাসার এককোণে শ্মশ্রুমণ্ডিত এক বৃদ্ধ ব্যক্তিকে একাকী বসে পান করতে দেখি। কাছে গিয়ে দেখি, তিনি সৈয়দ আলী আহসান। জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্র ও কমলকুমার নিয়ে গবেষণা করছি, এই পরিচয় দিয়ে কথা বলি। ‘কমলকুমার’ নামটি শুনেই তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন বলে মনে হয়। তিনি তখন ফরাসি কয়েকজন লেখকের নাম বলেন। নাতালি সারোৎ, এলা রব গ্রিয়ে তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বলেন, তাঁদের লেখা সম্ভব হলে পড়তে। আমি পরবর্তীকালে এসব লেখকের সঙ্গে কমলকুমারের ব্যক্তিগত যোগাযোগের পাশাপাশি লেখার সংযোগও আবিষ্কার করি। গবেষণাপত্রটি রচনা করে ডিগ্রি পাওয়ার পর অভিসন্দর্ভটি প্রকাশের জন্য বাংলা একাডেমিতে জমা প্রদান করি।

কমলকুমার মজুমদারের শতবর্ষ সেমিনারে স্যার ও আমি

২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ আয়োজিত কমলকুমার মজুমদারের শতবর্ষ সেমিনারে দেখা হলে মনজুর স্যার তাঁর সঙ্গে পরে একা দেখা করতে বলেন। দেখা করতে গিয়ে দেখি, থিসিসটি তাঁর হাতে। একাডেমি রিভিউ করতে তাঁর কাছে পাঠিয়েছে। মনজুর স্যার থিসিসটির নানা মতামত বিষয়ে আলাদা নোট নিয়ে রেখেছেন। স্যার নোটটি আমাকে দেন। বলেন, ‘আমি প্রাথমিক কথাগুলো মূল্যায়ন প্রতিবেদনে লিখে পাঠাচ্ছি, তুমি প্রকাশের আগে তোমার কাছে গেলে জায়গাগুলো আবার নতুন করে ভেবে প্রয়োজন মনে করলে পরিমার্জন করে নিয়ো।’ স্যারের সেই সব মতামত ছিল কমলকুমারকে গভীরভাবে পাঠের সাক্ষ্যবাহী। বলা বাহুল্য, সে সময় বাংলাদেশের একাডেমিয়া মহলে কমলকুমার ছিলেন প্রায় অজানা। মনজুর স্যার একাডেমিয়া জগতে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হয়েও বাংলা সাহিত্যের অনেক অধ্যাপকের থেকে অনেক বেশি খবর জানতেন। তিনি ছিলেন এতটাই সর্বগ্রাসী অগ্রসর পাঠক। কমলকুমারের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ ২০১৪ সালে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, স্যার সে অনুষ্ঠানেও কমলকুমার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কথা বলেছিলেন।

তাঁর আপাতগম্ভীর চেহারার ভেতর এক রসিক ব্যক্তি লুকিয়ে আছেন। এই রসবোধ তিনি সম্ভবত পেয়েছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষ সৈয়দ মুজতবা আলীর রক্ত থেকে। ব্যক্তিগত আড্ডায় তাঁর এই তীক্ষ্ণ রসবোধের পরিচয় পাওয়া যেত।

শৈলীবিজ্ঞানে যেমনটি বলা হয়, স্টাইল মেন হিমসেল্ফ। মনজুর স্যারের ব্যক্তিচরিত্রের সঙ্গে রচনাশৈলীরও অদ্ভুত মিল ছিল। তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের মতো লেখার চরিত্রেও একধরনের মৃদুময়তা রয়েছে। সেটা যেমন নিটোল গদ্য অলস দিনের হাওয়ার ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি সত্য কথাসাহিত্যের ভাষার ক্ষেত্রেও। তাঁর বক্তব্য উচ্চকণ্ঠের নয়, মৃদু। কিন্তু তীব্র সঞ্চারী। তাঁর সঙ্গে যাঁরা একান্তে মিশেছেন, তাঁরা একসময় অনুভব করেছেন তাঁর আপাতগম্ভীর চেহারার ভেতর এক রসিক ব্যক্তি লুকিয়ে আছেন। এই রসবোধ তিনি সম্ভবত পেয়েছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষ সৈয়দ মুজতবা আলীর রক্ত থেকে। ব্যক্তিগত আড্ডায় তাঁর এই তীক্ষ্ণ রসবোধের পরিচয় পাওয়া যেত। তাঁর সঙ্গে আমার সম্ভবত সর্বশেষ আড্ডা হয়েছিল কবি আশরাফ আহমদ-ঔপন্যাসিক নাসরিন জাহানের মোহাম্মদপুরের বাসায়। সেই আসরে হুমায়ূন আহমেদের নাটকের একজন বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতাও উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমাদের হাসানোর চেষ্টা করছিলেন, আমরা আনন্দও পাচ্ছিলাম। কিন্তু মনজুর স্যারের সে চেষ্টার দরকার ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছিলেন। কিন্তু কথার ভেতর এমন ছোট ছোট তীক্ষ্ণ রসাত্মক বিষয় একটু করে যোগ করছিলেন, আমরা হাসতে পারছিলাম না, কিন্তু পানাহারের মাঝখানে থমকে যাচ্ছিলাম।

স্যারের ‘ভাষা’ নামক একটি ছোটগল্পের মূল চরিত্র পিতার কথা না শুনেই পিতার সব কথা বুঝতে পারে। চরিত্রটি স্যারের নিজের সৃষ্টি। আমরাও স্যারের একেকটি চরিত্র ছিলাম। তাঁর সব কথা শুনেও কি বুঝতে পেরেছি? উত্তরকালে হয়তো উত্তর পাওয়া যাবে।