‘আচ্ছা, আমি যদি তোমার আগে মরে যাই, এই ঘরে একলা একা কীভাবে থাকবে তুমি?’ এক বিকেলে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে হঠাৎ গোলাম কাদেরের কাছে জানতে চাইলেন নাসিমা সুলতানা। স্ত্রীর এমন অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে খানিকটা ঘাবড়ে গেলেন গোলাম কাদের। তাই তো! কীভাবে থাকবেন তিনি! প্রায় দুই হাজার বর্গফুটের এই বিশাল ফ্ল্যাটে! সম্পূর্ণ একা!
ভাবতে গেলেই চারপাশ থেকে অচেনা এক আতঙ্ক এসে জড়িয়ে ধরতে চায়। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। গোলাম কাদের শীতলদৃষ্টিতে একবার স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তারপর আনমনে চুমুক দিলেন চায়ের কাপে। তাঁর এক হাতে চায়ের কাপ, অন্য হাতে একটি রঙিন ছোট্ট পেপার ওয়েট। হাতের তালুতে মুঠো পাকিয়ে সেটি ধরে রেখেছেন শক্ত করে। কোনো কারণ ছাড়াই। আর তাঁর ঘোলাটে চোখে যেন একরাশ শূন্যতা। নাসিমা সুলতানা তাঁকে একা করে দিয়ে তাঁর আগেই যদি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন, সেই সব অনাগত দিনের বর্ণহীন শূন্যতা গোলাম কাদেরকে খানিকটা অস্থির করে তোলে।
‘কী হলো, চুপ করে আছ কেন?’ উত্তরের জন্য স্বামীকে তাগাদা দেন নাসিমা সুলতানা। একটু নড়েচড়ে বসে এবার পাল্টা প্রশ্ন হাঁকান গোলাম কাদের, ‘হঠাৎ এসব জানার ইচ্ছা হলো কেন?’
‘হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের বয়স কত হয়েছে, সে খেয়াল আছে? তোমার চুরাশি, আমার সাতাত্তর। জীবনের সব দরজা দ্রুত বন্ধ হয়ে আসছে আমাদের। কেবল একটি দরজাই খোলা এখন। মৃত্যুর দরজা। সে দরজায় পা রাখতেই হবে আমাদের। সময় যে আর বেশি নেই!’
গোলাম কাদের থেমে থেমে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। একের পর এক। যেন চা নয়, অপ্রিয় সত্য গিলছেন একটু একটু করে। তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে খানিকটা। তবু নিজেকে শক্ত করলেন তিনি। একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘আমিও তোমার আগে মরে যেতে পারি! তখন তুমিই বা কী করে এই একলা ঘরে থাকবে? কে তোমার পেটে রোজ দুই বেলা ইনসুলিন পুশ করবে? বিকেলে কার সঙ্গে পার্কে যাবে হাঁটতে? প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ঝগড়াই বা করবে কার সঙ্গে?’ বলতে বলতে স্ত্রীর দিকে খানিকটা ঝুঁকলেন গোলাম কাদের। তাঁর কণ্ঠে কৌতুকের সুর। পাল্টা প্রশ্ন হাঁকিয়ে স্ত্রীকে এভাবে জব্দ করতে পেরে মিটমিট করে হাসছেন গোলাম কাদের।
পাল্টা প্রশ্নের জন্য অবশ্য প্রস্তুত ছিলেন না নাসিমা সুলতানা। সহসা চুপসে গেলেন তিনি। ঘরজুড়ে নেমে এল এক অদ্ভুত নীরবতা। দক্ষিণের বারান্দায় ঝুলে আছে শেষবিকেলের একটুকরো নরম রোদ। হঠাৎ সব নীরবতা ভেঙে দিয়ে দক্ষিণের সেই বারান্দা থেকে ভেসে এল একটি সুরেলা ডাক। গোলাম কাদের! গোলাম কাদের! গোলাম কাদের!
সুর করে বাড়ির গৃহকর্তা গোলাম কাদেরকে ডাকছে খাঁচায় বন্দী পোষা ময়না পাখিটা। অবিকল মানুষের মতো সে ডাক। দিনে অসংখ্যবার গোলাম কাদেরের নামটি বেরিয়ে আসে ময়না পাখির মুখ থেকে। কখনো গোলাম কাদের! কখনো নাসিমা সুলতানা! নাম দুটি তার মুখস্থ। সঙ্গে আরও দুটি নাম শোনা যায় পাখিটার কণ্ঠে। সাহেদ! সাহেদ! রুম্পা! রুম্পা! যখন ডাকে, একটানা ডেকে যায় কিছুক্ষণ।
সাহেদ এ বাড়ির বড় ছেলে। গোলাম কাদের ও নাসিমা সুলতানা দম্পতির একমাত্র পুত্রসন্তান। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সে বসবাস করে আমেরিকার ফ্লোরিডায়। দু-তিন বছর পরপর দিন কয়েকের জন্য বাংলাদেশে এসে বৃদ্ধ মা–বাবাকে দেখে আবার আমেরিকায় ফিরে যায়।
রুম্পা সাহেদের ছোট বোন। গোলাম কাদের ও নাসিমা সুলতানার একমাত্র কন্যা। সে বসবাস করে কানাডার ভ্যানকুভারে। স্বামী-সন্তান নিয়ে সে-ও বাংলাদেশে বেড়াতে আসে মাঝেমধ্যে। চার-পাঁচ বছর পরপর। এসে দিন কয়েক থেকে যায় মা–বাবার সঙ্গে। ওই কয়েকটা দিনের জন্য গোলাম কাদের ও নাসিমা সুলতানা অপেক্ষা করেন বছরের পর বছর। আনন্দের দিনগুলো যতটা দ্রুত ফুরিয়ে যায়, অপেক্ষার দিনগুলো ততটা দ্রুত ফুরায় না। অপেক্ষার দিনগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।
স্ত্রীর নীরবতায় গোলাম কাদের এবার শব্দ করে হেসে উঠলেন। ডানে-বাঁয়ে মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘আমাকে জব্দ করতে গিয়ে নিজেই জব্দ হলে। আমি যদি তোমার আগে মরে যাই, তুমি চাইলে তোমার সন্তানদের কাছে গিয়ে থাকতে পারো।’
‘এ বাড়ি ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। নিজেদের একটা বাড়ির জন্য দিনের পর দিন স্বপ্ন দেখেছি। ভাড়া বাসায় থাকার দিনগুলো আমি কখনো ভুলতে পারব না। পানি আছে তো গ্যাস নেই, গ্যাস আছে তো কারেন্ট বিল নিয়ে ঝামেলা, রাত এগারোটার পর গেট বন্ধ, ছাদে যাওয়া যাবে না, বেশি শব্দ করা যাবে না, বছর বছর ভাড়া বৃদ্ধি, বাড়তি ভাড়া না দিলে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ! কী যে বিরক্তিকর সেসব দিন! আমাদের এখন স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। নিজেদের একটা বাড়ি হয়েছে। সবকিছু নিজের মতো করে সাজিয়েছি। এ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে আমি থাকতে পারব না। তা ছাড়া ছেলেমেয়েরা ওদের মতো করে সংসার সাজিয়েছে। ওদের কাছে গিয়ে বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। দু-একবার তো বেড়াতে গিয়ে দেখেছি। ওদের কত কাজ, কত ব্যস্ততা! আমাদের ঠিকমতো সময়ই দিতে পারে না। তার চেয়ে নিজের দেশে নিজের সংসারই ভালো। ওরা মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসে, এ–ই ভালো। আমরা তো ওদের বৃদ্ধ মা–বাবাকে দেখাশোনার দায় থেকে মুক্তি দিয়েছি। থাকুক ওরা ওদের মতো। আমাদের দিন তো প্রায় শেষ হয়ে এল।’
‘হুম, বুঝলাম। কিন্তু আমি যদি তোমার আগে মরে যাই, এই একলা ঘরে একা একা কী করে থাকবে তুমি?’ আবারও স্ত্রীকে একই প্রশ্ন গোলাম কাদেরের।
‘আমি তোমাকে আগে প্রশ্ন করেছি। আমি যদি আগে মরে যাই, তুমি কী করে থাকবে? কে তোমাকে বিকেলবেলায় চা বানিয়ে খাওয়াবে? ওষুধ খাওয়ার কথাই বা কে মনে করিয়ে দেবে? কাজের লোকের হাতে তুমি তো কিছুই খেতে চাও না।’
গোলাম কাদের সহসা কোনো জবাব দিতে পারলেন না। চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার মতো অবশিষ্ট চা-টুকুও আর নেই। তিনি একবার উঠে দাঁড়ালেন। বসার ঘরে এলোমেলো হাঁটলেন কিছুক্ষণ। তারপর আবার বসলেন। তাকালেন স্ত্রীর দিকে। নাসিমা সুলতানাও তাকিয়ে রইলেন স্বামীর চোখে চোখ রেখে।
হঠাৎ গোলাম কাদের দারুণ কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছেন, এমন ভঙ্গিতে বললেন, ‘আচ্ছা, একটা কাজ করলে কেমন হয়?’
‘কী কাজ?’ নাসিমা সুলতানার কণ্ঠে কৌতূহল।
‘আমরা যদি একটা চুক্তি করি, কেমন হয়?’
‘কী চুক্তি?’
‘ধরো, আমার আগে তোমার মৃত্যু হলো! একই দিন তোমার সঙ্গে আমিও যদি পৃথিবী থেকে বিদায় নিই, কেমন হবে?’
‘সেটা কীভাবে সম্ভব?’ নাসিমা সুলতানার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘চাইলেই সম্ভব। তোমাকে ছাড়া এই একলা জীবন বয়ে বেড়ানো সত্যিই আমার জন্য দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। তার চেয়ে আমিও তোমার সঙ্গে চলে গেলাম একই দিনে। দুজন একসঙ্গে। সব সমস্যার সমাধান। ঘুমের ওষুধ তো আমাকে এমনিতেই রোজ খেতে হয়। সেদিন নাহয় একটু বেশি করে খেয়ে চিরতরে তোমার পাশাপাশি ঘুমিয়ে পড়ব। একইভাবে আমি যদি তোমার আগে মরে যাই, তুমিও একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়লে। তাহলেই তো আর আমাদের কাউকে একলা থাকার দুর্বিষহ কষ্টটা সইতে হবে না।’
‘কিন্তু এটা তো আত্মহত্যা!’ নাসিমা সুলতানা রীতিমতো আঁতকে ওঠেন।
‘হুম, আত্মহত্যাও বলতে পারো। আবার স্বেচ্ছামৃত্যুও বলা যেতে পারে। দেখো, মানুষের জীবন কখনো কখনো এতটাই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে যে তখন আত্মহত্যা বা স্বেচ্ছামৃত্যুর পথে পা বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। কত মানুষই তো আত্মহত্যা করে। ভেবে দেখো, এই শেষ বয়সে আমরা দুজন দুজনের ওপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি যে একজন আরেকজনকে ছাড়া একা বেঁচে থাকার কথা ভাবতেই পারি না। সুতরাং একজন চলে গেলে অন্যজন কতটা অসহায় হয়ে পড়ব, সেটা তো বুঝতেই পারছ। তার চেয়ে একই দিন চলে যাওয়াই ভালো না? তা ছাড়া এমনিতেই অনেক বয়স হয়েছে আমাদের। যেকোনো সময় পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। নাহয় কয়েকটা দিন আগেই বিদায় নিলাম।’
নাসিমা সুলতানা চুপ হয়ে গেলেন এবার। সত্যিই তো, তারা দুজন দুজনের ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে একজনকে ছাড়া অন্যজনের পক্ষে একাকী বেঁচে থাকা রীতিমতো অসম্ভব! রোজ যত্ন করে দুবেলা ইনসুলিন পুশ করা, বিকেল হলে স্বামীর সঙ্গে পার্কে হাঁটতে গিয়ে যতটা সম্ভব সুগারের লাগাম টেনে ধরা, অসুখ-বিসুখে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া—এসব তো আছেই। সঙ্গে এত দিনের সংসার জীবনের মায়া-মমতা, দায়বদ্ধতা কোনো কিছুই তো নাসিমা সুলতানা অস্বীকার করতে পারেন না। সত্যিই তো, স্বামীকে ছাড়া কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে তাঁর একলা জীবন, ভাবতে গেলেই শিউরে ওঠেন তিনি। তার চেয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়ে একই দিন চলে গেলেই বরং বেঁচে যান! এই শেষ বয়সে একা থাকার দুঃসহ দিনগুলো দেখতে হবে না আর।
স্ত্রীকে চুপ হয়ে যেতে দেখে গোলাম কাদের বললেন, ‘তোমার কাছে আমার প্রস্তাবটা অদ্ভুত মনে হতে পারে। পাগলামিও মনে হতে পারে। কিন্তু আমরা তো জানি, আমরা একজন আরেকজনকে ছাড়া কতটা অসহায়। তার চেয়ে এটাই তো ভালো। আমরা একই দিন চলে গেলাম! তুমি যদি আমার আগে মরে যাও, তাহলে আমি কিন্তু সত্যিই অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ব চিরদিনের মতো। আর আমি যদি আগে মরে যাই, তবে তুমি চাইলে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারো।’
‘আমাকে এতটা স্বার্থপর আর ভীতু ভেবো না। আমিও একসঙ্গে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেতে পারব। তোমাকে ছাড়া আমার পক্ষেও একাকী থাকা অসম্ভব। সুতরাং আমি তোমার চুক্তি মেনে নিলাম। যদিও আত্মহত্যা মহাপাপ। এ নিয়ে মনের মধ্যে কিছুটা দ্বিধা কাজ করছে। তবু আমাদের একজনকে ছাড়া অন্যজনের একা থাকার দুর্বিষহ দিনগুলো থেকে মুক্তি পেতে আমাদের সামনে এর চেয়ে ভালো কোনো পথ নেই।’ নাসিমা সুলতানার কণ্ঠ হঠাৎ যেন খানিকটা দৃঢ় হয়ে ওঠে। যেন সব রকম দ্বিধা তিনি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন এইমাত্র।
গল্পের ছলে গোলাম কাদের ও নাসিমা সুলতানা দুজনই অদ্ভুত চুক্তিটা মেনে নেওয়ার মাত্র তিন মাস পর এক সকালে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়লেন নাসিমা সুলতানা। রাতে ঘুমাতে গিয়েছিলেন বেশ স্বাভাবিকভাবে। অন্যান্য রাতের মতোই। শরীরে ইনসুলিন নিয়ে, রাতের খাবার সেরে এবং খাবারপরবর্তী উচ্চ রক্তচাপের একটি ক্যাপসুল খেয়ে স্বামীর সঙ্গে সংসারের টুকটাক আলাপ করতে করতে ঘুমিয়েছিলেন। পরদিন সে ঘুম আর ভাঙেনি। নাসিমা সুলতানা মারা গেলেন ঘুমের মধ্যেই। এ যেন চিরশান্তির ঘুম! এমনভাবে তিনি ঘুমিয়ে আছেন যে দেখে মনে হতে পারে, একটু বাদেই তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠবেন। উঠেই গোলাম কাদেরকে ডাকাডাকি করবেন নাশতার টেবিলে। কাজের বুয়াকে এটা-ওটা নির্দেশ দেবেন। ময়না পাখিটাকে খাবার দেবেন।
সকালে অনেক ডাকাডাকির পরও যখন নাসিমা সুলতানা ঘুম থেকে উঠলেন না, তখন অসহায় বোধ করতে শুরু করলেন গোলাম কাদের। একসময় তিনি বুঝতে পারলেন যে তাঁর স্ত্রী চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছেন! চুক্তি অনুযায়ী গোলাম কাদেরের উচিত, এখন অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়া। তিনি অস্থিরচিত্তে স্ত্রীর লাশ বিছানায় রেখে এ ঘর–ও ঘর পায়চারি করতে লাগলেন। কী করবেন তিনি এখন? কী করা উচিত তাঁর এখন?
হঠাৎ দক্ষিণের বারান্দা থেকে ময়না পাখিটা তাঁর নাম ধরে ডেকে উঠল। গোলাম কাদের! গোলাম কাদের! গোলাম কাদের! স্বভাবসুলভ সুরেলা কণ্ঠে তাঁকে পরপর তিনবার ডাকল ময়না পাখিটা। গোলাম কাদের থমকে দাঁড়ালেন। আচ্ছা, একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে তিনিও যদি আজ মরে যান, তবে প্রিয় পোষা ময়না পাখিটাকে খাবার দেবে কে?
গোলাম কাদের আরও বেশি অস্থির বোধ করতে থাকেন। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি স্থির হলো বসার ঘরের সদর দরজার নিচে। আজকের দৈনিক পত্রিকাটা খানিকটা অযত্নে পড়ে আছে সেখানে। একটু আগেই পত্রিকাটা রেখে গেছে হকার। রোজ নাসিমা সুলতানা সেটি তুলে এনে বসার ঘরের ছোট্ট টেবিলটায় রেখে দিতেন। ঘুম থেকে উঠে সেটি টেবিল থেকে হাতে তুলে নেন গোলাম কাদের। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই দৈনিক পত্রিকা পড়ার অভ্যাস তাঁর। যতক্ষণ পড়তে না পারেন, ততক্ষণ তিনি উশখুশ করতে থাকেন। খানিকটা দ্বিধা নিয়ে গোলাম কাদের পত্রিকাটা হাতে তুলে নিলেন।
আচ্ছা, আত্মহত্যা করার আগে পত্রিকাটা একনজর পড়ে নিলে কেমন হয়! নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন গোলাম কাদের। পত্রিকা পড়ার নেশা তাঁকে পেয়ে বসেছে। এ নেশা তাঁর ত্রিশ বছরের পুরোনো। চাইলেই হুট করে ছেড়ে দেওয়া যায় না। পাতায় পাতায় কত রকম খবর!
কিন্তু স্ত্রীর লাশ ঘরে রেখে পত্রিকা পড়া ঠিক হবে কি না, তিনি বুঝতে পারছেন না। আবার পত্রিকা পড়তে না পারলে তাঁর যে ভীষণ অস্থির লাগে। তিনি পত্রিকাটা মেলে ধরলেন চোখের সামনে। আজ যদি অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরে যান, তবে আর কোনো দিন তাঁর পত্রিকা পড়া হবে না। পত্রিকায় কত রকম খবর ছাপে রোজ! আর কোনো দিন এসব খবর জানা হবে না ভাবতে গেলে কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় গোলাম কাদেরের। তিনি অসহায় বোধ করতে থাকেন।
একটু বাদে কাজের মেয়েটা চলে আসবে। চুক্তি অনুযায়ী কেউ আসার আগেই গোলাম কাদেরকে একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিতে হবে। কাজের মেয়েটা চলে এলে নিশ্চয়ই তাঁকে আত্মহত্যা করতে দেবে না। আর সেটি করতে না পারলে স্ত্রীর সঙ্গে করা চুক্তিটি ভঙ্গ হবে। গোলাম কাদেরের এখন কী করা উচিত, তিনি বুঝতে পারছেন না। আচ্ছা, গোলাম কাদের কি ভয় পাচ্ছেন! জেনেশুনে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে যে সাহস লাগে, তবে কি সেই সাহস তাঁর নেই! নয়তো এত কিছু ভাবছেন কেন তিনি! তার তো এখন একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে টুপ করে মরে যাওয়া উচিত।
গোলাম কাদের পত্রিকাটা তুলে নিয়ে মেলে ধরতে গিয়েও একধরনের অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন। চোখের সামনে যেন তাঁর স্ত্রী তাঁকে দেখে মিটমিট করে হাসছেন। উপহাসের হাসি। নাহ, এভাবে পত্রিকা পড়া যায় না। পত্রিকাটা রেখে দিলেন গোলাম কাদের। তারপর শোবার ঘরে এসে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন। নাসিমা সুলতানাকে খুব নির্ভার লাগছে। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, ঘুমের চেয়ে আনন্দদায়ক মুহূর্ত পৃথিবীতে আর কিছু নেই।
গোলাম কাদের টেবিল থেকে ঘুমের ওষুধটা নিতে যাবেন, ঠিক তখনই ময়না পাখিটা আবারও ডেকে উঠল। নাসিমা সুলতানা! নাসিমা সুলতানা! নাসিমা সুলতানা! গোলাম কাদের থমকে দাঁড়ালেন। স্ত্রীর মতো তিনিও যদি একই দিনে মারা যান, তবে তাঁদের প্রিয় পোষা ময়নার কী হবে! এ নিয়ে আগে থেকে স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে নিলে ভালো হতো। তাহলে এখন আর এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হতো না। গোলাম কাদের ঘুমের ওষুধ হাতে তুলে নিয়েও রেখে দিলেন আবার। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলেন নিশ্চুপ। তারপর বারান্দায় গিয়ে ময়না পাখিটাকে খাবার দিলেন অভ্যস্ত হাতে। চুপচাপ খাবার খেতে শুরু করেছে পাখিটা। পাখিটাকে দেখে বড্ড মায়া হচ্ছে তাঁর। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একসময় বসার ঘরে এসে পত্রিকাটা মেলে ধরলেন গোলাম কাদের। একধরনের অপরাধবোধ নিয়েই পত্রিকার প্রথম পাতায় চোখ রাখলেন। কিছুতেই তিনি পত্রিকা পড়ার লোভটা সামলাতে পারছেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, পত্রিকাটা পড়েই আত্মহত্যার ব্যবস্থা নেবেন।
ঠিক তখনই কলবেলটা বেজে উঠল। কাজের মেয়েটা এসে পড়েছে। দরজা না খুলে আর উপায় নেই। গোলাম কাদের ধীরপায়ে উঠে দরজাটা খুলে দিলেন। তিনি কি মনে মনে মেয়েটির অপেক্ষায়ই ছিলেন!
ঘরের ভেতর পা রেখেই কাজের মেয়ে জানতে চাইল, ‘খালাম্মা কই, খালুজান?’
‘শোবার ঘরে আছে। যাও, ভেতরে যাও।’ নির্বিকার কণ্ঠে জবাব দিলেন গোলাম কাদের।
‘খালাম্মা তো এত বেলা করে উঠেন না! খালাম্মার শরীরটা কি খারাপ?’ উত্তরের প্রত্যাশা না করেই বলতে বলতে সে শোবার ঘরের দিকে পা বাড়াল। মিনিট দুয়েক বাদেই তার চিৎকার শুনতে পেলেন গোলাম কাদের। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বাসায় লোকজন ভর্তি হয়ে গেল। গোলাম কাদেরের ঘুমের ওষুধ আর খাওয়া হলো না।
পর্যাপ্ত সময় পেয়েও কেন ঘুমের ওষুধ খেলেন না গোলাম কাদের? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন তিনি। তবে কি তিনি বেঁচে থাকার লোভে পড়েছেন? পৃথিবীকে আরও দেখার লোভ! রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকায় নানা রঙের খবর পড়ার লোভ! বিকেলে পার্কে গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মতিন সাহেব, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আমলা কাসেম সাহেব আর তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের বন্ধু ইমরুল কায়েসের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দেওয়ার লোভ! পোষা ময়না পাখির কণ্ঠে নিজের নাম শোনার লোভ! বিকেলে ছাদে গিয়ে আরাম করে আকাশ দেখার লোভ! এই তো, কদিন আগেই ছাদে একটি নতুন জাতের পেঁপেগাছ লাগিয়েছেন শখ করে। তিনি মরে গেলে গাছটাকে দেখবে কে! নতুন জাতের একটি আমের চারাও লাগিয়েছেন। তিনি না থাকলে সেই গাছের যত্নআত্তি করবে কে! স্ত্রীবিয়োগের শোক সামলে এই সুন্দর পৃথিবীকে আরও কিছুদিন দেখার ইচ্ছাটা গোলাম কাদেরের মধ্যে প্রবল থেকে প্রবলতর হতে লাগল। অবশ্য বেঁচে থেকেও একধরনের অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন তিনি।
নাসিমা সুলতানার মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমেরিকা থেকে তাঁদের একমাত্র ছেলে সাহেদ এসে দিন কয়েক গোলাম কাদেরের সঙ্গে কাটিয়ে গেল। কাদের-নাসিমার একমাত্র মেয়ে রুম্পা কানাডা থেকে নানা ব্যস্ততার কারণে আসতেই পারল না। টেলিফোনের অপর প্রান্তে বসে দিন কয়েক কান্নাকাটি করে মায়ের জন্য চোখের জল ফেলল। সাত সমুদ্রের ওপারের সেই কান্না এপারে এসে যেন মিলিয়ে গেল ক্ষণিকের হাওয়ায়। ছেলে দু-একবার বাবাকে তার সঙ্গে আমেরিকায় যেতে বললেও গোলাম কাদের বুঝতে পারেন, তাতে নিয়ম রক্ষার ভার যতটা, ততটা আন্তরিকতার ছোঁয়া নেই। তা ছাড়া এই শেষ বয়সে এসে বহু কষ্টে বানানো প্রিয় বাড়ি আর জন্মভূমি ছেড়ে কোথাও যেতে গোলাম কাদেরের মন ঠিক সায় দেয় না। নিজের বাড়ি, নিজের দেশ—এ যেন স্বর্গ! এমন স্বর্গ ছেড়ে ভিনদেশে গিয়ে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না।
বিশাল বাসায় আবারও সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলেন গোলাম কাদের। একাকীত্বকেই সঙ্গী করে নিলেন তিনি। তবু যে গোলাম কাদেরকে বাঁচতে হবে! সুন্দর পৃথিবীটা যত দিন সম্ভব দেখা যায়, দেখে যেতে হবে! রোজ সকালে কাজের মেয়েটা এসে সারা দিনের রান্না সেরে টেবিলে সাজিয়ে রেখে যায়। গোলাম কাদের কিছু একটা মুখে দিয়ে যখন-তখন বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। একা একা হাঁটেন। মানুষ দেখেন। গাড়ি দেখেন। বৃক্ষ দেখেন। আকাশ দেখেন। স্ত্রীর জন্য শোক অনুভব করলেও সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে তার কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না।
তবে রাত নামলে ভিন্ন কথা। গোলাম কাদের প্রবল নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকেন, যেন বিশাল পৃথিবীর একমাত্র নাগরিক তিনি। মাঝেমধ্যে ময়না পাখিটা তাঁর আর নাসিমা সুলতানার নাম ধরে ডেকে ওঠে। তাতে অবশ্য খানিকটা নিঃসঙ্গতা কাটে। একসঙ্গে একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার যে চুক্তি তিনি নাসিমা সুলতানার সঙ্গে করেছিলেন, সেটি বেমালুম ভুলে যেতে চান গোলাম কাদের। কিন্তু তাঁর স্ত্রী কিছুতেই ভুলতে দেন না। রোজ একই রকম দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় তাঁর। গোলাম কাদেরের গলা শুকিয়ে আসে। শরীর থেকে ঘাম বের হতে থাকে। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে থাকেন তিনি।
গোলাম কাদের প্রায় রোজ একই রকম স্বপ্ন দেখেন। স্ত্রী নাসিমা সুলতানা তাঁর দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসেন আর তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন, ‘স্বার্থপর! কাপুরুষ! স্বার্থপর! কাপুরুষ!’ ক্রমাগত বলে যান তিনি। বলতেই থাকেন। গোলাম কাদেরের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি বিছানায় বসে বসে রাত পার করে দেন। তাঁর আর ঘুম আসে না। তিনি ভোরের অপেক্ষায় বসে থাকেন। বসে থাকেন আলোর অপেক্ষায়।
হাত বাড়িয়ে প্রায়ই একগাদা ঘুমের ওষুধ তুলে নেন গোলাম কাদের। তাকিয়ে থাকেন ওষুধের দিকে। কিন্তু খেতে পারেন না। যখনই পরদিন খবরের কাগজে রংবেরঙের খবর পড়ার কথা মনে পড়ে, বিকেলে পার্কে ঘুরতে যাওয়ার কথা মনে পড়ে, টিভিতে খেলা দেখার কথা মনে পড়ে, হাঁটতে হাঁটতে আকাশ দেখার কথা মনে পড়ে, ছাদে লাগানো প্রিয় পেঁপেগাছ–আমগাছের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে প্রিয় পোষা ময়নার কথা, অমনি হাত গুটিয়ে নেন গোলাম কাদের। রাতের পর রাত তিনি জেগে থাকেন। নাসিমা সুলতানা তাঁকে ঘুমাতে দেন না কিছুতেই। চোখ বন্ধ করলেই দেখেন, মিটমিট করে হাসছেন নাসিমা সুলতানা। উপহাসের হাসি।
দিনের পর দিন নাসিমা সুলতানা উপহাস করে যেতে থাকেন। গোলাম কাদের পরিষ্কার দেখতে পান স্ত্রীর সেই উপহাসের হাসি। দিনের পর দিন নির্ঘুম কাটতে থাকে তাঁর। ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন গোলাম কাদের। পরিণত হন বদ্ধ উন্মাদে। একসময় যেন ভিন্ন এক জগতের সন্ধান পেয়ে যান তিনি। সে জগতে তিনিই একমাত্র রাজা! নিজের মতো রাজ্য শাসন করতে থাকেন গোলাম কাদের।
তার পর থেকে শহরের মানুষ নিয়মিত দেখতে পান এক প্রৌঢ় লোককে। যেন নগরে এক নতুন অতিথি। হাতে একটা ময়না পাখি নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়ান শহরের রাস্তায়। ঘুরে ঘুরে মানুষ দেখেন, বড় বড় ভবন দেখেন, রাস্তায় সারি সারি গাড়ি দেখেন, বৃক্ষ দেখেন, আকাশ দেখেন। তাঁর গায়ে ছেঁড়া জামা, চুল এলোমেলো, গায়ে দুর্গন্ধ, চোখ দুটো ঘোলাটে, মুখভর্তি দাড়ি–গোঁফ। ক্লান্ত শরীরে তিনি হাঁটেন মাইলের পর মাইল।
গোলাম কাদের আর বাড়িতে ফেরেন না। ফুটপাতে শুয়ে থাকেন। পার্কের বেঞ্চে শুয়ে থাকেন। স্টেশনে শুয়ে থাকেন। রাস্তার আইল্যান্ডে শুয়ে থাকেন, ডাস্টবিনে মানুষের ফেলে দেওয়া পচে যাওয়া খাবার খান বেওয়ারিশ কুকুরদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে। তবু পৃথিবীকে দেখার স্বাদ মেটে না তাঁর।
সারা দিন ঘুরে ঘুরে এক সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে তিনি শহরের একটি পুরোনো পার্কে এসে শুয়ে পড়েন চিত হয়ে। একটি নড়বড়ে কাঠের বেঞ্চে। ধীরে ধীরে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। তাঁর হাত স্থির, তাঁর পা স্থির। তাঁর পুরো শরীর স্থির। তাঁর পাশে খাঁচায় বন্দী ময়না পাখিটা হঠাৎ ডেকে ওঠে, গোলাম কাদের! গোলাম কাদের! গোলাম কাদের...! ডেকে যায় ক্রমাগত।
কিন্তু গোলাম কাদের ময়না পাখিটার ডাকে আর সাড়া দেন না। ময়না পাখিটা ডেকে ওঠার খানিকটা আগেই তিনি চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়েছেন। পার্কের একটি নড়বড়ে বেঞ্চে শুয়ে। চিত হয়ে। তাঁর হাত দুটো দুদিকে ছড়ানো। তাঁর ডান পা ঝুলে আছে মাটির দিকে। বাঁ পা গুটিয়ে রেখেছেন বেঞ্চের ওপর। তাঁর চোখ দুটো খোলা। যেন মৃত্যুর পরও পৃথিবীটা দেখতে চান কিছুক্ষণ!