
জীবদ্দশায় মুনীর চৌধুরীর কোনো গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। তিনি গল্প লিখেছেনও কম। ১৯৪৪ থেকে ’৪৮ সাল—মোটামুটি এই কয়েক বছর তাঁর গল্প লেখার সময়। তাঁর লেখা ৯টি গল্প নিয়ে দু বছর আগে ‘প্রথমা প্রকাশনী’ বের করে মুনীর চৌধুরীর একমাত্র গল্পগ্রন্থ—‘একটি তালাকের কাহিনি ও অন্যান্য গল্প’। বর্তমান গল্পটি উক্ত গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
আত্তাহিয়াতু শেষ করে কেবল সালাম ফিরিয়েছেন, মোনাজাতের জন্য তখনো হাত তোলেননি। বাইরে রাত কেটে আলো ফুটেছে কিন্তু ফিনকি দিয়ে সে আলোর ফালি ছড়িয়ে পড়েনি তখনো। ফজরের নামাজের প্রান্তে মোনাজাতের আদ্যক্ষণে প্রকৃতির সমস্ত সাদা পবিত্রতাকে চিরে, ছিঁড়ে খানখান করে উত্তর বাড়ির প্রাঙ্গণ থেকে আকাশের দিকে উঠে গেল একটা বিকট অশ্রাব্য সম্ভাষণ। চৌধুরী বাড়ির মুন্সি আফজাল সাহেব জায়নামাজের ওপরই একবার মুখ বিকৃত করে ফেললেন সে শব্দে। চেষ্টা করলেন, দুকানকে কিছু না শুনিয়ে শূন্যে এমনি ঝুলিয়ে রাখতে। প্রাণপণ চেষ্টা করলেন জোড়া হাতের প্রশস্ত গহ্বরে মনকে নিমজ্জিত করে আল্লাহর কাছে পৌঁছুতে। পৃথিবী থেকে পালিয়ে সম্পূর্ণ মায়ামুক্ত দিল দিয়ে চাইলেন জলদি জলদি মোনাজাত খতম করতে।
আফজাল সাহেব পরহেজগার মুসল্লি হলেও এমন কিছু সুফি আউলিয়া ছিলেন না, কাজেই মোনাজাত করবার সময়ও উত্তর বাড়ির প্রাঙ্গণ থেকে ছদু মিয়ার কণ্ঠস্বর তিনি সর্বক্ষণ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলেন। ছদু মিয়ার যেমন গলা তেমনি ভাষা। অর্থজ্ঞাপক অঙ্গভঙ্গিও যে নিশ্চয়ই সব সময় ভাষাপ্রয়োগকে টীকা হিসেবে অনুসরণ করে চলছিল, তা-ও আফজাল সাহেব অজু করা রেখাঙ্কিত হাতে স্পষ্ট দেখতে পান।
ছদু মিয়া গালি দিচ্ছে। লক্ষ্যবস্তু বাড়ির কেউ। বেশি দূরে হলেও সে নিশ্চয়ই পাঁচ-দশ হাতের মধ্যেই উপস্থিত আছে; কিন্তু গলার স্বর গ্রামের দূরতম গৃহকোণের গভীরতম নিদ্রায় মগ্ন মানুষকে হঠাৎ উচ্চকিত করে তুলবার পক্ষে যথেষ্ট। আর যে বিষয়বস্তু সে কণ্ঠ দিয়ে নিঃসৃত হচ্ছিল, তার ভাবার্থ হয় না। দ্বিতীয়বার পুনরাবৃত্তিও সম্ভব নয়। যেমন তার বেগ, তেমনি তার আবেগ। সে গালিগালাজ দুপুর অবধি চললেও মনে হবে যেন ছদু মিয়ার নিরবচ্ছিন্ন প্রথম বাক্যটাই ব্যাকরণসম্মতভাবে এখনো শেষ হয়নি। প্রতি উচ্চারণেই সে একটা করে নতুন যৌন সম্পর্ক স্থাপন করছে। এই মুহূর্তে নিজের আপন ভাইকে, মাকে, বউকে, বোনকে সম্বোধন করছে নিজের ঔরসজাত সন্তান বলে। আবার পরমুহূর্তেই এদের প্রত্যেকের আগত এবং অনাগত প্রতিটি সন্তানের দেহসংগত জন্মদাতা বলে নিজের দাবিও জানিয়ে রাখছে নির্বিকার চিত্তে।
তসবির ছড়া লম্বা কোর্তার পকেটে পুরে আফজাল মুন্সি এবার উঠে দাঁড়ালেন। আকাশ ভরে এখন ছদু মিয়ার কণ্ঠস্বর, সে বিষ ঠেলে আরও ওপরের কোনো পুণ্যস্তরে ভক্তের পবিত্র আর্তনাদ হয়তো পৌঁছাবে না। ছদু মিয়ার প্রতিটি স্পষ্ট উক্তি কখন যেন অলক্ষ্যে পিছলে ঢুকে পড়েছে মুন্সি সাহেবের মনের মধ্যেও চকচকে সাপের পিঠের মতো ইচ্ছেমতো কিলবিল করে বেড়াচ্ছে এখন।
চারদিক আবার শান্ত না হলে খোদার কথায় মন দেওয়া মুন্সি সাহেবের পক্ষে সম্ভব নয়। নামাজের পাটি থেকে উঠে খড়ম জোড়া পায়ে দিলেন। পুকুরের ডান পাড় দিয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হলেন উত্তর বাড়ির দিকে। অনেক রকম বিলাপ ও গর্জনের মধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু ছদু মিয়ার কণ্ঠ একাগ্রচিত্তে শুনেছেন। আর তার খণ্ড খণ্ড সূত্র ধরে প্রাণপণে বুঝতে চেষ্টা করছেন পুরো ঘটনাটা।
উত্তর বাড়ির আঙিনায় ঢুকে মুন্সি সাহেব আরও হকচকিয়ে গেলেন। ছদু মিয়া একটা ভাঙা পুরানো নৌকার বইঠা তুলে বারবার চেষ্টা করছে পাশের বন্ধ দরজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। হুংকারে হুংকারে ঘোষণা করছে, হত্যা করার অটল সংকল্প। পাশের মসজিদে যারা নামাজ পড়তে এসেছিল, তারাই ভিড় করে রয়েছে ছদু মিয়াকে ঘিরে।
উত্তর বাড়ির আঙিনায় ঢুকে মুন্সি সাহেব আরও হকচকিয়ে গেলেন। ছদু মিয়া একটা ভাঙা পুরানো নৌকার বইঠা তুলে বারবার চেষ্টা করছে পাশের বন্ধ দরজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। হুংকারে হুংকারে ঘোষণা করছে, হত্যা করার অটল সংকল্প। পাশের মসজিদে যারা নামাজ পড়তে এসেছিল, তারাই ভিড় করে রয়েছে ছদু মিয়াকে ঘিরে। চার-পাঁচজন চেপে ধরে রেখেছে অসংবৃত লুঙ্গিতে আধঢাকা কামিজহীন, ছদু মিয়ার স্ফীত মাংসপেশির ঘর্মাক্ত কালো বলিষ্ঠ দেহটাকে। কেউ তাকে উপদেশ দিচ্ছে, কেউ হুমকি, কেউ অনুনয়ও করছে। কিন্তু ছদু অপরিবর্তিত; শরীরে, আওয়াজে, ভাষায় ভয়ংকর রকম বেসামাল।
মুন্সি সাহেব বুঝলেন, বন্ধ ঘরের মধ্যেই এমন একটি লোক আছে, যাকে ছদু খুন করতে চায়, কিন্তু কেন? আশ্চর্য, আজ উঠানের একটি লোকও মুন্সি সাহেবের শান্ত, সৌম্য, গম্ভীর মুখ দেখে একবারের জন্যও সসম্ভ্রমে সালাম জানাল না। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন দেখেও কেউ একটি পিঁড়ি এনে দিল না। অথচ এই মুন্সি সাহেবের মুখের কথা এ গাঁয়েই শরিয়তের শেষ ফতোয়ার মতো মান্য। উত্তেজনায় এত বেখেয়াল হয়ে আছে সবাই। এমনি নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ আর এমন চাঞ্চল্যকর দৃশ্য দেখা চলে। মুন্সি সাহেবেরও ধৈর্যের সীমা আছে, কৌতূহলের শুরু হয়। একবার মুন্সি সাহেব ইশারা করে একে ডাকেন, আবার ওকে। আদ্যোপান্ত সব ঘটনা জানার জন্য মুন্সি সাহেব ব্যগ্র, চঞ্চল, রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন।
কয়েক মাস আগে ছদু খেতে গেছে ধান নিড়াতে। রান্নার কাজ সেরে তফুরী বিবি ঘরের দাওয়ায় বসে পাটি বুনছিল। স্বামীর কিশোরী ছোট বোন হঠাৎ কোত্থেকে ছুটতে ছুটতে এসে ভাবির গলা জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল। একটা বেতের চাঁছা লতা ঠিক ঘর মতো বসাতে যাবে, এমন সময় ননদের আকস্মিক সোহাগ এসে বাধা দিল কাজে। কৃত্রিম রাগের ঢঙে ধমকে উঠল,
‘এইলা উলালে দেখি একছার বাছছ না আর। তোর কি আইজ হাঙ্গা লাইগছে নি। ছাড়, গলা ছাড়ি দে।’
‘একখানে অ্যাক মজার ছিজ দ্যেই আইছি ভাবি, কইত্যাম না আঁই।’
মজার জিনিস আবিষ্কার করে যে অত উৎফুল্ল হয়ে ভাবির কাছে তা প্রকাশ করতে ছুটে আসে, সে জিনিস সম্পর্কে কিছুই গোপন রাখা যে ফজিলতের উদ্দেশ্য নয়, এ কথা বোঝা পানির মতো সোজা। বরঞ্চ প্রথমে রহস্য সৃষ্টি করে, পরে প্রকাশের ইচ্ছের মধ্যে একটা কিছু স্বার্থ লুকোনো থাকা সম্ভব। তফুরীর কল্পনা মিছে নয়। ভাবিকে চুপ করে থাকতে দেখে ফজিলতই আবার গায়ে পড়ে বলে, ‘এক খাওনের জিনিস, বড় মজার। হুইনলেই জিহ্বাৎ হানি আইব।’
ভাবি তবু বেশি উৎসাহ প্রকাশ করে না। দীর্ঘ নিটোল বাহুতে ঢেউ তুলে বেতলতা ঘরে ঘরে টানা দিতে থাকে। ফজিলত কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে এবার সব বলেই দেয়। এইমাত্র অন্দরের ঘাটলা দিয়ে পানি তুলবার সময় সুপারির খোলের পর্দার ফাঁক দিয়ে সে অমন অতুলনীয় লোভনীয় দ্রব্যটি আবিষ্কার করেছে। মোটা ফুটফুটে এক থোকা ঝুলে থাকা বেতফল, শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে যার প্রতিটি ফল ফুলেফেঁপে নধর হয়েছে, ইচ্ছে করলেই নাকি সেই থোকাটা খুব সহজে এখনই পাড়া যায়। ডাগর কালো চোখ নাচিয়ে ভাবিই এবার ননদকে আদর করতে শুরু করে দেয়। মেটে হাঁড়ির তলার কালি আর বাটা মরিচ নুনে ঝাঁকিয়ে নিলে যে অদ্ভুত স্বাদ আসবে ওই বেতফলের টকে-ঝালে—সেই কল্পনাতে উথলে ওঠে ভাবি। ফজিলতের পরামর্শ কল্পনাকে নিকট বাস্তবে নিয়ে আসে, ‘আঁই আঁকশি বান্ধি ঠিক করি রাইখছি। গেলে অনই উডন লাহগব। হইর কিনারে গোছলের ভিড় জইমলে হেই ওক্তে আর ব্যাত ঝোপের পর্দায় কুলাইত না।’ ভাবিও তৎপর হয়ে ওঠে। ফজিলতের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে ঘাটলার দিকে। কর্মে এত প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ফজিলতের একটা আপত্তি আছে, ‘আঁই ছাট-দেয়ালের হেই কিনারে দিনে-দুফরে গেলে মায়ে হ্যাদাইবো’ একটু থেমে সে-ই আবার প্রশ্ন করে, ‘আইচ্ছা ভাবি, হেইদিন ত হাললম দিন পাড়া চড়ি বেড়াইতাম, এই কদিনেই আঁই এমন কীই-বা ডাঙ্গর হই গেলাম।’ মার উদ্বেগ ও সাবধানবাণীর তাৎপর্য তফুরী বোঝে, ফজিলতের গালে দুটো টোকা মেরে ছন্দ মিলিয়ে, অঙ্গ দুলিয়ে বলে, ‘তোর যে দুই দিন বাদে হাঙ্গা।’
মুন্সি সাহেব বুঝলেন, বন্ধ ঘরের মধ্যেই এমন একটি লোক আছে, যাকে ছদু খুন করতে চায়, কিন্তু কেন? আশ্চর্য, আজ উঠানের একটি লোকও মুন্সি সাহেবের শান্ত, সৌম্য, গম্ভীর মুখ দেখে একবারের জন্যও সসম্ভ্রমে সালাম জানাল না। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন দেখেও কেউ একটি পিঁড়ি এনে দিল না।
বিয়ের কথায় কিশোরী ফজিলত লাল হয়ে চোখ বুজে ফেলে। এটা তো আর ঠাট্টা নয়, এ সত্য কথা। ও নিজেও জানে। হাঁড়ির কালি, বাটা মরিচ, নুন এবং আরও অন্যান্য সরঞ্জাম ঠিক করবার নির্দেশ দিয়ে তফুরী ঘাটলার পথে পা বাড়ায়। ফজিলত তার আবিষ্কৃত রহস্যের চাবিকাঠিটা শেষবারের মতো ছুড়ে মারে, চিৎকার করে। ‘বাইর বাড়ি দি যান ভাবি, হুইর কিনার দি। কাঁডল গাছের হোচ্ছম দি। রেইনলেই সামনে বেত্যার থোব দেইবেন।’ যেতে যেতে মাথা নাড়িয়ে ভাবি আঁকশিটা তুলে নেয়। শাশুড়ির উপস্থিতি হঠাৎ কোনো বিস্ময়কর দুর্যোগ ডেকে না আনে, এই ভয়ে ত্রস্তপদে তফুরী মিলিয়ে গেল ছাট দেয়ালের ওপাশে। যাবার ভঙ্গিটার কথার ফজিলত কিন্তু তখনো ভাবছে। ভাবির রূপ যেন থেমে থাকতে চায় না কখনো। বড় বড় পা, বড় বড় হাত, বড় চোখ, বড় চুল, একটুখানি নড়লেই রূপ যেন সারা সাদা অঙ্গে টলটল করে নাচতে থাকে।
ফজিলত একবার মনে মনে ভাবে, কিসের জোরে ভাবি শ্বশুরবাড়িতেও দিগ্বিজয়ী রানির মতো বেপরোয়া চলাফেরা করে। সে কি শুধুই রূপের জোরে, না আর কারও সোহাগ বর্ম হয়ে ঘিরে রয়েছে ভাবিকে? ছদু ভাই ভাবিকে আর ভাবি ছদু ভাইকে এত ভালোবাসে যে, ফজিলত পর্যন্ত মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায়, তার তৃপ্তিহীন, সীমাহীন, কূলকিনারাহীন উচ্ছ্বাসের কথা কল্পনা করে।
দুটো মাটির হাঁড়ির সরাকে মুখোমুখি উপুড় করে চেপে ধরে ভাবি-ননদে ঝাঁকুনি দিয়ে তৈরি করেছে বেতুই ফলের ভর্তা। ভাবি এত মশগুল হয়ে আছে যে, বেতের কাঁটায় ছিঁড়ে যাওয়া শাড়ির আঁচলটা পর্যন্ত স্বামী বা শাশুড়ির চোখ থেকে আড়াল করার চিন্তাটুকুও নেই। ভাবি-ননদে কাড়াকাড়ি করে খায়। মন্তব্য প্রকাশ করে, কালির ঝুলে বেতফলের কাঁচা কষ কতটা কেটেছে আর কতটা রয়ে গেছে। ফজিলত অল্পক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারে যে ভাবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জেতা তার পক্ষে সম্ভব নয়। গালের মধ্যে মস্ত একদলা ভর্তা আঙুলের পাতা থেকে পাতলা জিবের ডগা দিয়ে ভাবি তুলে নিচ্ছে। তারপর আশ্চর্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ঠোঁট দুটো স্বল্প জোরে সংযুক্ত করেই এক কোণের একটুখানি শিথিল পথ দিয়ে পুট পুট করে একগাদা স্বাদহীন মসৃণ দানা জিব দিয়ে ঠেলে বের করে দিচ্ছে। ঝগড়া শুরু করে দেয় ফজিলত। লাভ হচ্ছে না দেখে জোরাজুরি, তাতেও হেরে যাচ্ছে দেখে এবং ভাবি নির্বিকারচিত্তে নির্মম বেগে খেয়েই যাচ্ছে বুঝে ফজিলত ফুঁপিয়ে শুরু করে তার অপরাজেয় সংগ্রামের প্রথম পাঠ। নাছোড়বান্দা ভাবি ভর্তার সরাসহ ছুটে সরে পড়তে চাইল রণক্ষেত্র থেকে। মরিয়া হইয়া ফজিলত ভাবির ফুলে ওঠা উড়ন্ত আঁচল শূন্য থেকে সাপটে ধরল। চোখের পলকে এক হ্যাঁচকা টানে ফস করে ওর খুদে মুঠো থেকে বেরিয়ে গেল আঁচল, উড়ে চলে গেল ভাবি। শুধু যাবার সময়ের সামান্য অসাবধানতার জন্য মাটির সরাটা পড়ে খান খান হয়ে গেল। শব্দ শুনে হাঁ করে একদিক থেকে বেরিয়ে এল মা, দৈবক্রমে ঠিক সে সময়ে বাহির থেকেও লাঙল কাঁধে আঙিনায় প্রবেশ করল কর্মক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, ক্ষুধার্ত ছদু। সুন্দরী স্ত্রীর পলায়ন গতিটুকু দেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসতে লাগল। মনে মনে মরণক্ষুধার মধ্যেও নিজের খোশনসিবের জন্য খোদার কাছে একবার শোকরগুজারি করল। লাঙলটা উঠানের কিনারে রেখে, বউয়ের উদ্দেশে চিৎকার করে ডাকল। ভাত বাড়ার জন্য জানিয়ে দিল—খিদেয় সে মরে যাচ্ছে। মা তখন ফজিলতকে জেরা করছে, সরা ভাঙল কে? বেতুই ফল পাড়তে খোলা পুকুরপাড়ে গিয়েছিল কে? বউয়ের দুঃসাহস যে কুলটা রমণীর পুকুরপাড় ধরে প্রান্তরে পা বাড়াবার পূর্বাভাসমাত্র, সেটা বেশ জোরে জোরেই তফরীর স্বামীকে শুনিয়ে দিল। একে পেটের মধ্যে খিদে নাভিমূলে মোচড় দিতে দিতে ব্যথা তুলে দিয়েছে, তায় মার ওই রকম সুউচ্চ কণ্ঠের হূৎকাঁপানো মিথ্যে কটাক্ষ। ছদু মিয়ার মেজাজটা গরম দুধে লেবুর মতো রাগে ঝাঁজে ভরে উঠল। আরও বেশি কিছু শুনতে হয়, এই ভয়ে সে তাড়াতাড়ি বাইরের ঘাটলায় হাত-পা ধুতে চলে গেল। কিন্তু শব্দ বাতাসে ভর করে চলে, যত বেশি জোরে সাড়া দেবে, ততই বেশি দূরে ধেয়ে যাবে। মা তখন বউয়ের শাড়ি ছেঁড়ার পর্ব শুনেছে মাত্র। ভস্মীভূত বিষ তাতানো জিব থেকে জলন্ত আগুনের হলকার মতো বেরুচ্ছে। শাড়ি তো আর এমনি সব সময়ে ঘোমটা হয়ে বউয়ের মাথায় পড়ে ছিল না। কাঁটায় যখন শাড়ি একবার আটকে ছিল, তখন নিশ্চয়ই শাড়ির সে অংশটা হয় বউয়ের গায়ের ওপর ছিল, নয় গাছের ওপর ছিল। একই সময় একই শাড়ির আঁচল তো দুজায়গায় থাকতে পারে না। আর গাছে আটকেই তো শাড়ি ছিঁড়ে যায়নি, বউ নিশ্চয়ই তাড়াহুড়ো করে টানাটানি করেছে বলেই ফেড়ে গিয়েছে। গাছে কারও শাড়ির প্রান্ত অভ্যাসভাবে আটকে গিয়ে থাকলে পুকুরপাড় থেকে হয়তো রহিম মোল্লা হাঁ করে মানুষটাকে দেখেছিল, নইলে বউ তাড়াহুড়ো করে হ্যাঁচকা টানে আঁচল ছিঁড়বেই-বা কেন?
ছদু মিয়া রান্নাঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে বউকে আর একবার ডাকল কর্কশ ঝাঁজালো কণ্ঠে। নিছক ক্ষুধাতুর মানুষ—স্বামী নয়, প্রেমিক নয়, যেমন করে তার রাঁধুনিকে ডাকে। মাথায় কাপড় টেনে রক্তিম মুখে মাথা নিচু করে এগিয়ে এল তফরী। এক হাতে সরাটা পরিচ্ছন্ন করে ধোয়া। কিন্তু ঘরে ঢুকেই তফরী থ বনে যায়। চোখ-মুখ তার ফ্যাকাশে হয়ে আসে। হাতের ভালো সরাটাও খসে পড়ে গিয়ে চৌচির হয়ে যায়। ছদু ততক্ষণে ঘরে ঢুকে পড়েছে। সে-ও দেখল ভাত আর তরকারির হাঁড়িটা খোলা পেয়ে পোষা বিড়ালটা আর রাস্তার একটা ঘেয়ো কুকুর নির্বিবাদে মুখ ঢুকিয়ে মাছ আর ভাত ছপছপ করে খাচ্ছে। ছদুর মাথার মধ্যে কোথায় যেন একটা খুব প্রয়োজনীয় রগ বুঝিবা অতিরিক্ত রক্তচাপ সহ্য করতে না পেরে ছিঁড়ে ফেটে পড়ল। তফুরী চোখের পানি ঠেলে রেখে কোনোরকমে একবার বলতে চেষ্টা করল, অল্পক্ষণের মধ্যেই সে কিছু চাল ফুটিয়ে নেবে। এই এক ছিলিম তামাক শেষ না হতেই সে আবার ভাত বেড়ে আনছে। ঠায় অমনি চুপ করে ঠিক কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, তা ছদু নিজেও বলতে পারবে না। আচমকা সে চিৎকার করে উঠল বীভৎসভাবে। রাগে, ক্ষুধায় কাঁপতে কাঁপতে ছদু যা উচ্চারণ করল, তার মর্ম স্পষ্ট। এখন কেন, কোনো দিনই আর এই চুলোয় তফুরীকে ভাত চড়াতে হবে না। সে তাকে মুক্তি দিচ্ছে। তফুরী স্বচ্ছন্দে ফুলকাঁটায় আঁচল আটকে মাথার কাপড় বুকের নিচে ফেলে এখনই পুকুরপাড় ধরে রহিম মোল্লার হাতে হাত রেখে প্রান্তরের পথে পা বাড়াতে পারে। তফুরী চিৎকার করে দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরতে ছুটে এসেছিল। কিন্তু ততক্ষণে চরম বাণী ছদু উচ্চারণ করে ফেলেছে। তালাক। তা-ও সোজা সহজ কিছু নয়, একেবারে তিন তালাক।
উঠান থেকে মা আর মেয়ে আচম্বিত এমন সাংঘাতিক ঘোষণা শুনে শিউরে আঁতকে ভয়ার্ত আর্তনাদ করে দৌড়ে ছুটে আসে। বাইরের প্রাঙ্গণ থেকে ছুটে এল ছোট ভাই ফজু। সঙ্গে আরও দু-একজন প্রতিবেশী। কিছুক্ষণ আগের তুমুল ঝগড়ার কথা মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গিয়ে হায় হায় করে ঘরের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ল মা আর মেয়ে।
তফুরী অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে মেঝের ওপর। ছদু বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সেদিকে। এগিয়ে এসে ওই সোনার শরীরকে স্পর্শ করার সাহসটুকু পর্যন্ত তার উবে গেছে। বাজপড়া মানুষের মতো সে শুধু খাড়া হয়ে আছে। নিশ্চল দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে চোখের পলকে কোত্থেকে কী করে এ কাণ্ড হয়ে গেল। মা-মেয়ে পাড়া-প্রতিবেশিনীর সহানুভূতিসূচক বিলাপ আর কান্নার করুণ ঐকতানের মধ্যে ধীর-শান্ত পদক্ষেপে এগিয়ে এল বয়সে কম কিন্তু বুদ্ধিতে প্রবীণ, ছোট ভাই ফজু। কেবল সে-ই উপলব্ধি করছিল যে ছদুর নিশ্চুপ তন্ময়তা অস্বাভাবিক ও ভয়ংকর। কিছু না বলে সে বড় ভাইকে টেনে বার করে নিয়ে গেল, বহু কান্নার ফোঁপানিতে দম বন্ধ করা ঘরের গুমোট আবহাওয়া থেকে।
নিজের হঠকারিতায়, যে বুকভাঙা ঘটনার সৃষ্টি করেছে, তার জন্য অনুতাপে, শোকে কাহিল ছদু সারা দুপুরে কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। রহিম মোল্লাও সবটা শুনে ফতোয়া দিয়েছে শরিয়ত মোতাবেক। তিন তালাকের কঠিন বিধিনিষেধ ছদু মিয়ার মহব্বতের জন্য শিথিল করে দেওয়া সম্ভব নয়। ঠিক হলো, পরের দিন লোক এসে তফুরীকে তার বাপের বাড়ি নিয়ে যাবে।
তফুরী স্বচ্ছন্দে ফুলকাঁটায় আঁচল আটকে মাথার কাপড় বুকের নিচে ফেলে এখনই পুকুরপাড় ধরে রহিম মোল্লার হাতে হাত রেখে প্রান্তরের পথে পা বাড়াতে পারে। তফুরী চিৎকার করে দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরতে ছুটে এসেছিল। কিন্তু ততক্ষণে চরম বাণী ছদু উচ্চারণ করে ফেলেছে। তালাক।
গভীর রাতে নিদ্রাহীন ছদু মিয়ার বিছানার প্রান্তে এসে ফজু বসল। ফজু থাকে পশ্চিমের ঘরে। এ ঘরের ভাইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক মূলত আর্থিক ও সাংসারিক। নাড়ি আর পরিবারের বন্ধনটাকে গত বছর সে অনেকখানি শিথিল করে দিয়েছে। মেজাজ তার সব সময় একটু রুক্ষ থাকলেও ভেতরে ভেতরে সে ছিল বেজায় রসিক। হপ্তায় হপ্তায় গঞ্জের হাটে, ফুলেল তৈল মেখে, ঢেউ পাটের সিঁথি কেটে একটু গানবাজনা ও ফুর্তির আসরে না বসলে তার চলত না। একবার কিছু সুপারি চুরি করে বেচতে গিয়ে ভাইয়ের কাছে ধরা পড়ে যায়। জোয়ান বড় ভাইয়ের হাতে সেদিন প্রচুর মার খেয়েছিল। তারপর থেকেই নাকি তাকে আর কেউ কোনো দিন কোনোরকম হাসি-তামাশার হল্লায় দেখেনি। এর কিছুদিন পর সে নিজেই উদ্যোগ করে জায়গা-জমি সব ভাগ করিয়েছে। কিন্তু পাড়ার দশজনে মিলে দুভাইয়ের জমির যে ভাগবাঁটোয়ারা করে দিয়েছে, ফজু মিয়ার তা মোটেই পছন্দ হয়নি। তার ধারণা, গ্রামবাসীরা তাকে অপছন্দ করে বলে বড় ভাই তাদের সঙ্গে একজোট হয়ে ষড়যন্ত্র করে তাকে ঠকিয়েছে। বেছে বেছে তার ভাগে ঠেলে দিয়েছে যত পোড়ো, অজন্মা জোলো-জংলা জমিগুলো। লোকে বলে, সে নাকি আব্বার কবরের ওপর দাঁড়িয়ে রোজ রাতে বিড়বিড় করে আজও ভাইয়ের বিরুদ্ধে নালিশ জানায়, গজব দেয়। প্রতিশোধের জন্য ক্ষমতা মাগে। ছদু অবশ্য এসব প্রচারের কিছুই বিশ্বাস করে না। সে দেখেছে ফজু কেমন ধীরে ধীরে সুস্থ, শান্ত, কর্মঠ হয়ে উঠেছে। ছদু ঠিক করেছে, ওকে স্বেচ্ছায় আরও কিছুটা জমি ছেড়ে দেবে।
ফজু মিয়া ভাইয়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল,
‘আঁইনো যদি আঁরে বিশ্বাস করেন, ত একটা কতা কইতাম হারি?’
‘কী?’
‘ভাবিরে এক দিনের লাই বিয়া করি আঁই ছাড়ি দিমু। কারোত্তন কিছু ন কইলেই শাইরবো। একলগে হুইতলেও আল্লার দোহাই।’
ধড়মড় করে লাফিয়ে উঠল ছদু। তার মায়ের পেটের ছোট ভাই। হলোই-বা তালাক দেওয়া বউ, তাই বলে বড় ভাইয়ের অনুরোধে তিন মাস দশ দিন পর একটা লোকদেখানো বিয়ে করতে পারবে না? এক রাত মনভুলানো ঘর তার সঙ্গে পেতে সবার চোখে ধুলো দিয়ে সে পরের দিন তাকে তালাক দিতে পারে না? রাতের বেলায় অর্গল দেওয়া দুয়োরের ফাঁক দিয়ে রহিম তো আর উঁকি দিয়ে থাকছে না! আনন্দে-উল্লাসে ছদু বুকে জড়িয়ে ধরে ছোট ভাইকে। অস্ফুট কণ্ঠস্বরে আবার বুঝিয়েও বলে যে, তালাক তার তো সত্যি সত্যি হয়নি। দিল দিয়ে সে তালাক দেয়নি। কাজেই ফজু যেন বিয়ের রাতেও তফুরীকে ভাবির সম্মান দেখায়। ভাবি, ভাবি, কে না জানে ভাবি মায়ের সমান।
ঠিক তিন মাস দশ দিন পর গত রাতে তিনজন সাক্ষী আর একজন মোল্লা নিয়ে ব্যাপারটা তারা এত চুপচাপ সেরেছে যে মুন্সি সাহেব পর্যন্ত একদম টের পাননি। ফজুর সাথে তফুরীর বিয়ে হয়ে গেছে। ভোররাত থেকেই তিনজন সাক্ষীসহ ছদু প্রান্তের আঙিনায় অপেক্ষা করছিল ফজুর জন্য। সকালবেলা ফজু তালাক দেবে তার নয়া বিবিকে, পুরোনো ভাবিকে। কিন্তু ফজু হঠাৎ ভোরবেলা দরজা খুলেই নাকি ভাইকে দেখে বহুদিন পর তার বাজারের সেই পরিচিত পুরাতন অট্টহাসিতে চমকে দিয়েছে সব্বাইকে। তারপর চিৎকার করে বলেছে, ‘তালাক আঁই দিতানন্য। দিতানন্য। ব্যাক ভালা ভালা জমির টুকরা আঁরে ভাড়াই আননে লই গ্যাছেন, ইয়াদ আছে হেই কথা? হে-হে-হে। আইজ আননের ব্যাকের ন্য ভালা জমির টুকরা আঁই হাইছি। এইডা আঁই ছাড়ুম ক্যা? ছাইড়তান ন্য, আঁই ছাইড়তান ন্য।’
ছদুর শ্রেষ্ঠ সম্পত্তির টুকরো সে যখন আজ একবার মুঠোর মধ্যে পেয়েছে, তখন জান গেলেও ফজু তা ছাড়বে না। সঙ্গে এটুকুও জানিয়ে দেয়, ‘হেই লগে এইডাও হুনি রাখেন ভাইজান, জমির লগে জমির ফসলও যায়, বুইজছেন? আঁর জমিত আমনে ফসল কইল্লান ক্যা হেইডাও আঁই দিতানন্য। গলা টিফি মারি হালাইয়ুম।’ ছদুর অনাগত সন্তানকে পর্যন্ত সে গলা টিপে মেরে ফেলতে চায়। বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে ছদু তখন উন্মাদ হয়ে উঠেছে। হাতের কাছে শক্ত যে জিনিসটা ছিল, সেটা নিয়েই সে ছুটল ফজুকে খুন করতে। সড়াৎ করে ঘরের ভেতর ঢুকে ফজু দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, কয়েকজন এসে চেপে ধরেছে ছদু মিয়াকে। চিৎকারে ছদুর গলা দিয়ে যেন রক্ত বেরুচ্ছে, চোখ যেন উল্টে বের হয়ে আসতে চায়।
সবটা ঘটনা বুঝতে পেরে মুন্সি সাহেবের শুভ্র দাড়ি উত্তেজনায় স্ফীত নাসার সঙ্গে সংগতি রেখে ফেঁপে-ফুলে উঠল। সত্তর বছরের দুর্বল দেহটাকে হঠাৎ টান দিয়ে সিঁটিয়ে শক্ত-সবল করে ফেললেন একঝাঁকুনিতে। তারপর আচম্বিতে পায়ের খড়ম জোড়া হাতে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ছদু মিয়ার ওপর। সকলে হতবাক হয়ে শুনল মুন্সি সাহেবের গালাগালি—অশ্লীল, অকথ্য, অশ্রাব্য। গ্রামবাসীর দৈনন্দিন উত্তেজনার আদিম বুনো পরিভাষা। বলগাহীন, উদ্দামতার স্রোতোবেগ, ‘আরামজাদা, জারুয়া—শরিয়ত তোগো লাইন্য, তোগো লাই শরিয়তন্য। হাইওয়ান জানোয়ারের লাই শরিয়ত হয় ন্য—শরিয়ত হইছে মাইনষের লাই।’
দম বন্ধ করে মুন্সি সাহেবের এই অভূতপূর্ব ব্যবহার দেখতে থাকে সবাই। ছদু নিজেকে খড়মের পিটুনির হাত থেকে বাঁচাতে ভুলে গিয়ে চিত হয়ে পড়ে মুন্সি সাহেবের অস্বাভাবিক চেহারার দিকে চেয়ে থাকে, মুন্সি সাহেব প্রচণ্ড চিৎকারে ফেটে পড়েন, ‘মজুর মান্দার আরামজাদ কোনানকার। আরামজাদ বিয়া কইছত ক্যা? বিয়া করছ ক্যা? এইডাও জানছ না যে হেইড্যা মাইয়া হোলার উপর তালাক লাগে না—হ্যাডে হোলা থাইকলে তালাক অয় না। হেই কথা না জাইনলে তালাক দ্যাছ ক্যা? শরিয়ত মানছ ক্যা? আইজো মানুষ হ। মানুষ হ। শরিয়ত মাইনষের লাই, হাইওয়ান জানোয়ারের লাইন্য।’
মুন্সি সাহেব আর পারেন না। হাঁপাতে থাকেন। ক্ষোভে, ক্রোধে চোখ ভেঙে তার পানি গড়িয়ে আসে। সন্তানবতী নারীকে যে কখনোই তালাক দেওয়া যায় না এই নতুন তথ্য শুনে উত্তর বাড়ির প্রাঙ্গণ হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। সব উত্তেজনাহীন, কোলাহলহীন, নীরব। সব্বাই একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে ছদু মিয়ার দিকে। ঘট করে একটা শব্দ হতেই দরজা খুলে নতুন লাল শাড়ি পরা তফুরী বেরিয়ে এল ঘর থেকে আঙিনায়, এক পা এক পা করে এগুতে লাগল ছদুর দিকে। নিতান্ত অনভিপ্রেত একটা রূপ ভোরের পাকাধানি আলোতে বারবার কম্পিত তার চুলে, চোখে, আঁচলের প্রান্তে। আর ছদু আজ থেকে তিন মাস দশ দিন আগে ঠিক যেমন অর্থহীন মরা চোখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখছিল তফুরীর ভূলুণ্ঠিত অজ্ঞান দেহটাকে, সেই অকম্পিত চোখ জোড়াই সে আজও আবার মেলে ধরল মুন্সি সাহেবের মুখের ওপর মানুষের জন্য, হাইওয়ান জানোয়ারের জন্য—এ কথা তৃতীয়বার মনে হতেই মুন্সি ছদুর চোখের ওপর থেকে নামিয়ে নিলেন নিজের চোখ মাটির দিকে। হাত ছাড়িয়ে স্পর্শ করলেন ভোর থেকে পকেটে পরিত্যক্ত কঠিন পাথুরে তসবির ছড়াটাকে।
গল্পটি বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত আনিসুজ্জামান সম্পাদিত মুনীর চৌধুরী রচনাবলীর চতুর্থ খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত। সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত গল্পসংগ্রহ (ঢাকা, ১৯৬৩) থেকে গল্পটি গ্রন্থভুক্ত করেছেন।