অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

উন্মুক্ত নগরীর মায়াফাঁদে

এডওয়ার্ড সাঈদের পাঁচটি কবিতা

তরজমা ও ভূমিকা : আজফার হোসেন

বিশ শতকের অন্যতম গণবুদ্ধিজীবী এবং উত্তরঔপনিবেশিক তত্ত্বের প্রধান পুরোধা এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ (১৯৩৫–২০০৩) জন্মেছিলেন ফিলিস্তিনের জেরুজালেমে। তাঁর বই ‘ওরিয়েন্টালিজম’ (১৯৭৮) প্রাচ্যবাদ ও ইউরোপকেন্দ্রিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞানের নানা শাস্ত্রকে নতুনভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তবে সাঈদের প্রাসঙ্গিকতা কেবল এই বইতেই সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর অন্যান্য তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিকভাবে লিপ্ত রচনা আজো আমাদের সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রামে সমানভাবে কার্যকর। সেসব রচনার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত সাঈদের বই ‘দ্য কোয়েশ্চেন অব প্যালেস্টাইন’, যা ফিলিস্তিনিদের লড়াইয়ে এখনো জুগিয়ে চলেছে জ্ঞান, অনুপ্রেরণা আর হাতিয়ার।

সাঈদ সারাজীবন লিখেছেন গদ্যেই—কাজ করেছেন মূলত তত্ত্ব ও সমালোচনা নিয়ে—কিন্তু তাঁর মৃত্যুর বিশ বছর পর ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম ও একমাত্র কবিতার সংকলন ‘সংস অব অ্যান ইস্টার্ন হিউম্যানিস্ট’। যদিও কবিতা সাঈদের মূল ক্ষেত্র নয়, তিনি ওই কবিতাতেই লেখক জীবনের একেবারে শুরুতেই খুঁজে পেয়েছিলেন—তাঁর ভাষায় ‘হৃদয়ের সূক্ষ্ম রাজনীতি’। 

সাঈদ সারাজীবন লিখেছেন গদ্যেই—কাজ করেছেন মূলত তত্ত্ব ও সমালোচনা নিয়ে—কিন্তু তাঁর মৃত্যুর বিশ বছর পর ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম ও একমাত্র কবিতার সংকলন ‘সংস অব অ্যান ইস্টার্ন হিউম্যানিস্ট’, যা সম্পাদনা করেছেন তাঁর জীবনীকার টিমোথি ব্রেনান। যদিও কবিতা সাঈদের মূল ক্ষেত্র নয়, তিনি ওই কবিতাতেই লেখক জীবনের একেবারে শুরুতেই খুঁজে পেয়েছিলেন—তাঁর ভাষায় ‘হৃদয়ের সূক্ষ্ম রাজনীতি’। সাঈদের প্রিয় কবিদের মধ্যে আছেন মাহমুদ দারবিশ, রশীদ হুসেইন, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, আইমে সেজার, পাবলো নেরুদা ও ডব্লিউ বি ইয়েটস। আর একসময় সাঈদ গভীরভাবে মগ্ন ছিলেন উনিশ শতকের ইংরেজ কবি জেরার্ড ম্যানলি হপকিন্সে, যাঁর খানিকটা প্রভাব লক্ষ করা যায় সাঈদের তাত্ত্বিক কাজ ও কবিতায়।

সাঈদের কবিতায় তাঁর স্বভাবজাত প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর কখনোই উচ্চকিত নয়; তবে সেখানে প্রতিসরিত হয়েছে ‘হৃদয়ের সূক্ষ্ম রাজনীতি’ই। অবশ্য সাঈদ ছিলেন একইসঙ্গে দারুণ মনীষাসম্পন্ন সংগীতজ্ঞ এবং অসামান্য পিয়ানোবাদক, যিনি সংগীত নিয়ে রচনা করেছেন একাধিক অসামান্য বই। হয়ত সেই কারণেই সাঈদের কবিতায় সংগীতের রূপক ও চিত্রকল্পের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। সেখানে আরও দেখা যায় ভূগোল ও ‘স্পেইস’-এর প্রতি তাঁর সহজাত আকর্ষণ। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে লেখা হয় তাঁর কবিতাগুলো, যখন তিনি ছিলেন পিএইচডির ছাত্র এবং পরে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক। পাঠকের কাছে সাঈদের কাব্যিক জগতের একটুখানি স্বাদ পৌঁছে দিতে তাঁর পাঁচটি কবিতা এখানে তরজমায় নিবেদন করা হলো।

এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ (১৯৩৫-২০০৩)

উন্মুক্ত নগরীর মায়াফাঁদে

১.
ধীরে ধীরে ভোর ফোটাতে থাকে আমাদের নগরীর ধ্বনি সব
শৌর্যবান সংশয়ের সমর্পিত ছন্দে আর সুরে—
একাগ্র সন্ত্রাস থেকে দূরে দাঁড়িয়ে
তার কণ্ঠস্বর গলে যায় চারিদিকে জেগে-ওঠা ঢেউয়ে।
রুটি আর ফলমূলের, মাংস আর দুধের বিক্রেতারা
সাইকেলে-এক্কাগাড়িতে-উটে-চড়া বণিকেরা
ঝুনঝুন শব্দে মেঘেদের বাজিয়ে চলে, এমনকি বাজিয়ে চলে
বিষণ্ন সূর্যের এনামেল, কাঁপিয়ে তোলে তাদের বিক্রির তালে তালে,
ঘোমটা থেকে রেশম ছিনিয়ে এনে।
হুসেইন, মুহাম্মাদ, আলী, আহাম্মাদ, মাহমুদ আর আজিজ—
জেগেছিল এইসব নামের পুরুষ, যারা ছিল সুতো এমনকি কাদিজের কাছে।
ধর্মগুণের ঝাঁকসব বানিয়েছিল পানি থেকে বরফ, আর বরফ থেকে শরবত
আরও শীতল গ্রীষ্মরাতে পান করবে বলে, সঙ্গে নিয়ে কিসমত।

২.
ছোট ছোট ঢাকের সুতীক্ষ্ণ ধ্বনিস্পন্দ
কাঁচা খেজুরের টেনে-ধরা দোলাচল
বালুময় লেকগুলোর
মধুভরা বাদামি আভার চূড়ায়;
 
অনুপম রোশনাই এক,
চোখগুলোর নিঃশব্দ ঝাপটা,
আঁকড়ে-ধরা হাত
টেনে রাখে বিদ্বেষবিহীন।

এখানে ছিল এক পরিচ্ছন্ন বিশুদ্ধতা,
ওপরে এবং আলাদা,
তবু মগ্ন ছিল বারবার ফিরে আসা
এক উন্মুক্ত নগরীর মায়াফাঁদে—
যা দয়ালু দৃষ্টিতে ঝলমল করত
বিস্তীর্ণ সাধু সমতলে।

৩.
আমার জীবনের সুন্দরতম সময়
ছিল, তা ছিল, সন্দেহ নেই কোনো,
মিউজিক হলে
ক্যাঁচক্যাঁচ করা আসনের ওপর।
সেখানে বসে শুনেছিলাম আমি বাঁশিওয়ালার ফুঁ,
একটা ঝাপটা, বাজাতে শুরু করল সবাই—
কেউ ফুঁ দিল, কেউ টানল, কেউ দম নিল
কিন্তু আমি আটকে থাকলাম মাঝপথে
এবং

৪.
ঝোড়ো কোণ আর শূন্য করিডোরগুলো বিনাশের দুঃসহ সওয়াল:
হারিয়ে যাওয়া বাণিজ্যের শেষ সাক্ষী
একটা আধা-ভাঙা মধ্যশরীর
অর্ধেক দুলছে মরুভূমির আগুনে।
অন্ধ অস্বচ্ছতায় আশীর্বাদপ্রাপ্ত,
বিস্মৃত দানবের লাল দাগে ছেয়ে-যাওয়া
এক গলগল-করা অর্ধস্বর গড়গড়িয়ে আসে:
রহস্যময় সাপ আর চাবুক
বিশাল স্মৃতির ছোট ছোট প্রহার—
আর আমার স্বপ্নের শূন্যতা
ঝিকমিক করে।

৫.
কেঁদেছি আমরা একসাথে পরাজিত প্রান্তরে
যেখানে কখনো ছিল না অন্য কেউ,
সকাল কাউকে জানায়নি অভিবাদন কোনো।
এক প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের দৃশ্য
আমাদের হাতধরা চিন্তাগুলোকে দিয়েছিল গতি,
কারণ আমরা কেঁপে উঠে সরে গিয়েছিলাম প্রবহের কম্পনে।
এক উল্লাস কামনা করেছিল আলিঙ্গন
কিন্তু আমরা তোয়াক্কা করিনি;
কেবল আমরা ভেসেছিলাম উলঙ্গ পাত্রের বুকের ওপর।