অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

গল্প

চুরির জামা

গাসসান কানাফানিকে বলা হয় ফিলিস্তিনি ‘প্রতিরোধ সাহিত্যের’ জনক। ১৯৭২ সালের ৮ জুলাই কানাফানিকে বৈরুতে হত্যা করা হয়, বয়স তখন তাঁর ৩৬। ১৯৩৬ সালের ৯ এপ্রিল তিনি ব্রিটিশ অধিকৃত ফিলিস্তিনের আক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। সরাসরি আরবি থেকে, তাঁর আল–কমিসুল মাসরুক গল্পগ্রন্থের নাম–গল্পের মূলানুগ অনুবাদ করেছেন মনযূরুল হক

আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থার গুদাম তাঁবুগুলোর কাছেই। স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারলে নিশ্চয়ই কোনো ফাঁকফোকর গলে গুদামে ঢুকে পড়তে পারবেন। ময়দা আর চালের বস্তা ওখানে স্তূপ করা আছে। এই পয়সা তো কারও জন্যই হালাল না। এটা এসেছে সেখান থেকে, যেখানকার মানুষদের সম্পর্কে আবদুর রহমানের স্কুলের শিক্ষক বলেছিলেন, ‘তারা খুন করে, আর লাশ নিয়ে মিছিল করে।’ তাহলে এক বস্তা ময়দা চুরি করলে কার কী ক্ষতি? দুই বস্তা? দশ বস্তা? আর যদি তিনি এই ময়দা বিক্রি করে দেন এমন কাউকে, যারা চুরি করা জিনিসের গন্ধ শুঁকলেই বোঝে, আবার দরদামেও ভালো?

এই চিন্তা তাঁর ভালো লাগল। তিনি আরও জোরে খানা খুঁড়তে লাগলেন। নিজেকে আবার প্রশ্ন করলেন, কেন এখনই শুরু করছেন না? বৃষ্টিও বেশ, পাহারাদারও ঠান্ডার জ্বালায় অস্থির। ত্রাণ সংস্থার স্বার্থের চেয়ে ঠান্ডা তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে এখনই কেন নয়?

‘কী করছ, আবুল আবদ?’

তিনি মাথা তুলে আওয়াজের দিকে তাকালেন। অন্ধকারে তাঁবুগুলোর সারির মাঝ দিয়ে আবু সামিরের ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে।

‘আমি ময়দা খুঁড়ছি…’

‘কী খুঁড়ছ?’

‘খুঁড়ছি…খুঁড়ছি…একটা খানা…’

আবু সামিরের তীক্ষ্ণ হাসি শোনা গেল, যা তাঁর বকবকানির মধ্যে মিলিয়ে গেল। ‘মনে হচ্ছে তুমি ময়দার কথাই ভাবছ। বিলি–বণ্টন আরও ১০ দিন পর হবে, আগামী মাসের প্রথম ১০ দিনের পর। মানে, প্রায় ১৫ দিন বাকি। তাই এখনই ভেবো না, যদি না তুমি গুদাম থেকে একটা-দুটা বস্তা ধার করতে চাও…’

আবু সামিরের হাত গুদামের দিকে ইশারা করল। তার পুরু ঠোঁটে একটা কুটিল হাসির ছায়া। আবুল আবদ অস্বস্তি বোধ করলেন। তিনি ভাঙা কোদাল দিয়ে মাটি কাটতে লাগলেন।

‘এই নাও একটা সিগারেট…না, থাক। বৃষ্টিতে এটা কাজ করবে না। ভুলে গেছি, আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ছে। তোমার মাথা ময়দার মতো শক্ত হয়ে গেছে, না না পাথরের মতো…’

আবুল আবদের গলায় যেন কিসের দলা পাকিয়ে এল। অনেক দিন ধরেই আবু সামিরকে তিনি দেখতে পারেন না, এই কুটিল বকবকে লোকটাকে তিনি ঘৃণা করেন। ‘এই বৃষ্টিতে তুমি বেরুলে কেন?’

‘বেরিয়েছি…বেরিয়েছি তোমাকে জিজ্ঞেস করতে যে কোনো সাহায্য চাও কি না।’

‘না…শুকরিয়া।’

‘অনেকক্ষণ খুঁড়বে?’

‘অনেক রাত লাগবে।’

‘খানাটা দিনের বেলা খুঁড়লে না কেন? তুমি সব সময় কোথায় যে চলে যাও, জানি না। তাঁবু ফেলে রেখে কোথায় যাও, সুলায়মানের আংটি খুঁজতে নাকি?’

‘না…কাজের খোঁজে।’

আবুল আবদ কোদাল থেকে মাথা তুলে হাঁপাতে লাগলেন। ‘ঘুমোও না কেন গিয়ে, আমাকে একা থাকতে দাও?’

আবু সামির শান্তভাবে কাছে এল। ধীরে ধীরে হাত নেড়ে চাপা গলায় বলল, ‘শোনো, আবুল আবদ, যদি এখন একটা ময়দার বস্তা তোমার সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, কা–উকে বলো না!’

‘কী?’

আবুল আবদের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। আবু সামিরের মুখ থেকে তামাকের গন্ধ আসছে। চোখ দুটি বিস্ফারিত। ফিসফিস করে বলল, ‘রাতে ময়দার বস্তা হাঁটে আর ওদিকে চলে যায়…’

‘কোথায়?’

‘ওইখানে…’

আবুল আবদ দেখার চেষ্টা করলেন আবু সামির কোথায় ইশারা করছে। কিন্তু দেখলেন, তার হাত দুটি শরীরের পাশে ঝুলে আছে, ঘুরছে শুধু চোখ। কণ্ঠে গাঢ় ফিসফিসানি, ‘তুমি তোমার ভাগ পাবে।’

‘কোনো ফাঁক আছে, যেখান দিয়ে ঢোকা যায়?’

আবু সামির মাথা নাড়ল। জিবে চুকচুক শব্দ করল। তারপর আধভাঙা গলায় ফিসফিস করে বলল, ‘ময়দার বস্তা নিজে থেকেই বেরিয়ে আসে…তারা হাঁটে!’

‘তুমি পাগল…’

‘না, তুমিই বেচারা। শোনো, সোজা কথায় আসি। আমাদের কাজ হলো গুদাম থেকে ময়দার বস্তা বের করে ওখানে নিয়ে যাওয়া। পাহারাদার সবকিছু ঠিক করে দেবে। সব সময় তা–ই করে। বিক্রির দায়িত্ব আমার বা তোমার নয়। সংস্থার সেই মার্কিন কর্মী, স্বর্ণকেশী লোকটা, সে–ই বিক্রি করবে। অবাক হয়ো না। সবকিছু ঠিক হয়ে যায় চুক্তির পর। মার্কিন বিক্রি করে, আমি টাকা তুলি, পাহারাদার তারটা নেয়, তুমি তোমারটা নেবে। সব চুক্তিমতে হবে। কী বলো?’

আবুল আবদ বুঝলেন, এটা এক বস্তা, দুই বস্তা বা দশ বস্তা চুরির মতো নয়, তার চেয়েও জটিল। এই লোকটার সঙ্গে লেনদেনের চিন্তায় তাঁর মনে ঘৃণার একটা আঠালো অনুভূতি জন্ম নিল। শিবিরের সবাই একে বলে রক্তচোষা। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর মনে হলো, যদি একদিন তিনি তাঁবুতে ফিরতে পারেন আবদুর রহমানের জন্য নতুন জামা আর তাঁর স্ত্রীর জন্য টুকটাক কিছু জিনিস নিয়ে, এই দীর্ঘ বঞ্চনার পর, তাদের হাসি কত সুন্দর হবে! শুধু আবদুর রহমানের হাসিই এই ঝুঁকি নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু যদি তিনি ব্যর্থ হন? তাঁর স্ত্রী আর ছেলের জন্য কী করুণ নিয়তি অপেক্ষা করছে? তখন আবদুর রহমান জুতা পালিশের বাক্স কাঁধে নিয়ে রাস্তায় বসে থাকবে, তার ছোট্ট মাথাটা নিচু হয়ে থাকবে চকচকে জুতাগুলোর ওপর। কী ভয়ংকর নিয়তি! আর যদি তিনি সফল হন? তাহলে আবদুর রহমান হবে নতুন মানুষ। স্ত্রীর চোখ থেকে সেই ভয়ানক প্রশ্ন মুছে যাবে। সফল হলে, প্রতি বৃষ্টির রাতে এই খানা খোঁড়ার ট্র্যাজেডি আর ভোগ করতে হবে না। তিনি এমন জীবন যাপন করবেন, যা এখন কল্পনাও করতে পারছেন না।

‘কেন এই অভিশপ্ত খানা ছেড়ে দিচ্ছ না? চলো, সূর্য ওঠার আগেই শুরু করি।’

হ্যাঁ, কেন ছেড়ে দেবেন না? আবদুর রহমান তাঁবুর কোণে ঠান্ডায় কাঁপছে। তার শ্বাস যেন আবুল আবদের ঠান্ডা কপালে এসে লাগছে। তিনি খুব করে চান, আবদুর রহমানকে সব দুর্বলতা আর ভয় থেকে মুক্ত করতে।

বৃষ্টি প্রায় থেমে গেছে। আকাশে চাঁদ একটা রুক্ষ পথ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে।

আবু সামির এখনো সামনে দাঁড়িয়ে, যেন কালো ছায়ার দানব। বড় বড় পা দুটি কাদায় গাঁথা। পুরোনো কোটের কলার কানের ওপরে তুলে দেওয়া। এখনো জবাবের অপেক্ষা করছে। এই মানুষটা, যে তার সামনে দাঁড়িয়ে, সঙ্গে করে একটা নতুন, রহস্যময় ভাগ্য নিয়ে এসেছে। তাঁকে প্রলুব্ধ করছে গুদাম থেকে বস্তা তুলে কোথাও নিয়ে যাওয়ার জন্য। প্রতি মাসে সেই মার্কিন আসে, ময়দার স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে তার পরিষ্কার হাত দুটো ঘষে, নীল চোখে হাসে, যেন একটা বিড়াল ইঁদুরের গর্তের সামনে তৈরি হয়ে বসে আছে।

‘কত দিন ধরে তুমি এই পাহারাদার আর কর্মীর সঙ্গে কাজ করছ?’

‘তুমি কি আমার তদন্ত করতে চাও, নাকি ময়দার দামের মধ্যে কতটা তুমি নেবে আর কতখানি ওই শয়তানগুলোকে দিতে হয়, সেটা বুঝতে চাইছ? শোনো, এই মার্কিন আমার বন্ধু। সে গোছানো কাজ পছন্দ করে। সে আমাকে সব সময় সময়ের গুরুত্ব দিতে বলে। দেরি করা পছন্দ করে না। আমাদের এখনই শুরু করতে হবে। তাড়াতাড়ি।’

আবুল আবদ কল্পনা করলেন, সেই মার্কিন ময়দার বস্তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সরু নীল চোখ দুটি হাসছে, নিশ্চিন্ত মনে আনন্দ নিয়ে পরিষ্কার হাত দুটো ঘষছে। আবুল আবদের ভেতর অদ্ভুত এক দমবন্ধ অনুভূতি হলো। মনে হলো, সেই মার্কিন ময়দা বিক্রি করে দিচ্ছে, অথচ ওদিকে শিবিরের ক্ষুধার্ত মানুষদের বলা হচ্ছে, ত্রাণ বিতরণ হবে আরও ১০ দিন পর। তাঁর মনে একটা তীব্র ক্রোধ জাগল। যেন সেই অনুভূতির প্রতিশোধ জাগছে, গতবার যখন তিনি গুদাম থেকে ফিরে স্ত্রীকে ভাঙা গলায় বলেছিলেন, ময়দা বিতরণ ১০ দিন পিছিয়ে গেছে, স্ত্রীর ক্লান্ত, কালো মুখটায় হতাশার ছাপ পড়েছিল, যেন সহস্র হাত তার গলায় চেপে বসেছে। তার হাতে দুলতে থাকা খালি ময়দার বস্তাটার দিকে এমন নীরব চোখে তাকিয়েছিল, যেন ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো লাশ দেখছে সে। সেই চাহনি বলছিল, আরও ১০ দিন তাদের ময়দা–রুটি না খেয়েই কাটাতে হবে। আবদুর রহমানও যেন পুরো ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছিল। সে–ও তাই খাবারের জন্য জোরাজুরি বন্ধ করে দিয়েছিল।

শিবিরের প্রতিটি তাঁবুতে একই হতাশা নেমে এসেছিল। প্রতিটি শিশুকে ১০ দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে রুটি খাওয়ার জন্য। আজ বোঝা গেল, এ–ই তাহলে বিতরণ পেছানোর কারণ। আবু সামির তখনো তার সামনে কাদায় পা গেঁথে কালো ছায়ার মতো দাঁড়ানো। হতে পারে দর–কষাকষির ভাগ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। ওদিকে সেই মার্কিন নিশ্চিন্ত মনে পরিষ্কার হাত দুটো ঘষতে ঘষতে ময়দার স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে সরু নীল চোখে হাসছে।

আবুল আবদ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি কোদালটা তুললেন, যা দিয়ে এতক্ষণ মাটি খুঁড়ছিলেন। সেটা দিয়ে আবু সামিরের মাথায় সজোরে আঘাত করলেন। তারপর কী হলো, তাঁর মনে নেই। তিনি জানেন না, কীভাবে তাঁর স্ত্রী তাঁকে আবু সামিরের দেহ থেকে টেনে সরিয়ে নিয়ে এল। তিনি শুধু ক্রমাগত চিৎকার করছিলেন, ‘এই মাসে ময়দা বিতরণ এক দিনও পিছাবে না।’

নিজেকে আবিষ্কার করলেন তাঁবুতে, বৃষ্টির পানিতে ভেজা, কাদায় জবজব। আবদুর রহমানকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। অবশ্য এখনো তিনি চান, নতুন জামা দেখে তাঁর রোগা ছেলেটার হলুদ মুখে হাসি ফুটুক। তিনি কেঁদে ফেললেন।