
• ভূমিকা ও অনুবাদ: কামরুল ইসলাম
ওরহান ভেলি কনিক (১৯১৪—১৯৫০) তুরস্কের অন্যতম প্রধান কবি ছিলেন। তুর্কি কবিতার আধুনিকায়নে তাঁর ব্যাপক ভূমিকা ছিল। মাত্র ৩৬ বছরের জীবন। গ্যারিপ মুভমেন্টের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এই মুভমেন্টের সঙ্গে আরও ছিলেন তাঁর দুই বন্ধু কবি ওকতাই রিফাত ও মেলিহ চেভদেত আন্দাই। কবিতা ছাড়াও তিনি তাঁর ৩৬ বছরের জীবনে অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। অনেক অনুবাদও করেছেন। কবিতা লেখার পুরোনো নিয়মকানুন ত্যাগ করে তিনি তুরস্কে নতুন স্বাদের কবিতা রচনার দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন। প্রচলিত ছন্দ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি মনে করতেন কবিতায় রূপক, উপমা, হাইপারবোল ইত্যাদি অলংকারের কোনো প্রয়োজন নেই। কবিতার ভাষায় তিনি সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তাঁর ছোট ছোট কবিতাগুলোই বেশি টানে পাঠককে। তাঁর কবিতায় দর্শন আছে, কিন্তু দার্শনিক বিমূর্ততা কিংবা জটিলতা নেই। জীবনের সহজতা ঘিরে আছে তাঁর কবিতার আলো-হাওয়া।
১৯৪১ সালে দুই বন্ধু ওকতাই রিফাত ও মেলিহ চেভদেত আন্দাইয়ের সঙ্গে তাঁর নতুন চিন্তাভাবনায় রচিত কবিতার সংকলন ‘গ্যারিপ’ (স্ট্রেঞ্জ) প্রকাশিত হয়। তাঁরা বললেন, কবিতা রাজপ্রাসাদের নয়, সাধারণ মানুষের ভাষায় লেখা উচিত। ‘গ্যারিপ মুভমেন্ট’ ১৯৪৫-১৯৫০ সময়কালে তুর্কি কবিতায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। গ্যারিপ কবিতা তুর্কি কবিতার জগতে পরশপাথরের মতো গ্রহণ করা হয়েছিল একইসঙ্গে এসব কবিতার ধ্বংসাত্মক ও গঠনমূলক চরিত্রের জন্য। বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে তাঁকে ভাবা হয়। তাঁর লেখায় একধরনের কোমল বিষণ্নতা ও মৃদু হাস্যরস মিশে থাকে, যা তাঁকে অন্যের থেকে আলাদা করেছে।
ওরহান ভেলির বন্ধু কবি ওকতাই রিফাত লিখেছেন, ‘ওরহান তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনে কবিতায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, তা ফরাসি কবিতার কয়েক জেনারেশনের সমতুল্য। তাঁর কলমকে ধন্যবাদ দিতে হয় এ কারণে যে তিনি একাই তুরস্কের কবিতাকে ইউরোপীয় কবিতার সমকক্ষ করে তুলেছিলেন।’ তিনি আরও বলেছেন, সাধারণত কয়েকটি জেনারেশন পরপর কাজ করে কবিতায় যে রূপান্তর ঘটায়, নতুন কিছু অর্জন করে, তিনি সেটা কয়েক বছরের মধ্যেই সম্পন্ন করেছিলেন। বিশেষ করে তুর্কি কবিতার ক্ষেত্রে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সৃজনশীল প্রতিভার প্রাবল্যে, কসমোপলিটন বোধ, ব্যাপক শ্রম তথা গ্যারিপ মুভমেন্টের মধ্য দিয়ে তিনি তুরস্তের কবিতায় যে নতুনত্বের সন্ধান দিয়েছিলেন, তা সারা পৃথিবীর কবি, কবিতা-পাঠক ও কবিতা-সমালোচকদের অভিভূত করেছিল।
তিনি তাঁর ৩৬ বছরের জীবনে অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। অনেক অনুবাদও করেছেন। কবিতা লেখার পুরোনো নিয়মকানুন ত্যাগ করে তিনি তুরস্কে নতুন স্বাদের কবিতা রচনার দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন।
তুরস্কের কবি, সমালোচক এবং প্রথম সংস্কৃতিমন্ত্রী তালাত সাঈত হালমান ওরহান ভেলি কনিকের কবিতা-সংকলনগুলো থেকে বেশ কিছু কবিতা তুর্কি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে ‘আই অ্যাম লিসেনিং টু ইস্তাম্বুল’ নামে একটি নির্বাচিত কবিতা সংকলন প্রকাশ করেন ১৯৭১ সালে। সেই সংকলন থেকে নিচের কবিতাগুলো বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।
আমি কী বোকাই না ছিলাম,
বছরের পর বছর আমি বুঝি নাই
সমাজে সরিষার গুরুত্ব
‘সরিষা ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না’
সম্প্রতি আবিদিন এসব বলে চলছিল
সেই লোকদের যারা সমাধান করেছে
এই গভীরতর সত্যের রহস্য
আমি জানি এটা আসলে খুব প্রয়োজনীয় নয়,
কিন্তু ঈশ্বর কাউকে সরিষা থেকে বঞ্চিত করেন না।
আমরা স্বাধীনভাবে বসবাস করি
বাতাস স্বাধীন, মেঘ স্বাধীন
উপত্যকা ও পাহাড়গুলো স্বাধীন
বৃষ্টি ও কাদা স্বাধীন
গাড়ির বাইরের দিক
সিনেমার প্রবেশপথ
এবং দোকানের জানালাগুলো স্বাধীন
রুটি ও পনিরের দাম দিতে হয়
কিন্তু বাসি পানির কোনো মূল্য নেই
স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে হয়
কিন্তু জেলখানা স্বাধীন
আমরা স্বাধীনভাবে বসবাস করি।
খোলা আবহাওয়ায়
সকালে
চায়ের রং কী মনোহর!
কত সুন্দর আবহাওয়া!
বালকটি কী সুন্দর!
চা-টা কী তৃপ্তিকর!
আমারও যদি কিছু কালো বন্ধু থাকত
অদ্ভুত নামের যা কখনো শুনি নাই।
মাদাগাস্কার থেকে চীন অবধি সমস্ত পথ
যদি তাদের সাথে ভ্রমণ করতে পারতাম।
যদি জাহাজের ডেকের ওপরে একজনকে পেতাম
আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে
প্রত্যেক রাতে গেয়ে উঠতাম ‘হো লু লু’।
প্যারিসের স্বচ্ছ নীলের ভেতর থেকে বেরিয়ে
যদি তাদের একজনের কাছে দৌড়ে যেতে পারতাম।
আমাদের পিতৃভূমির জন্য আমরা কী করি নাই!
আমাদের মধ্যে কেউ কেউ জীবন দিয়েছে;
কেউ কেউ বক্তৃতা দিয়েছে।
আমি যখন প্রেমে পড়ি,
তখন আমি কবিতা লিখি না,
কিন্তু আমি আমার সত্যিকারের মাস্টারপিস রচনা করেছি
যখন আমি উপলব্ধি করেছি যে
সে-ই আমার প্রিয়তম যাকে আমি সবচেয়ে
বেশি ভালোবেসেছি।
সুতরাং আমি প্রথমেই এই কবিতা
তাকে পড়ে শোনাই।
এই সুন্দর আবহাওয়া আমার সর্বনাশ করেছে,
এই রকম আবহাওয়ায় আমি আমার সরকারি চাকরি থেকে
অব্যাহতি নিয়েছি।
এ রকম আবহাওয়ায় আমি তামাকে অভ্যস্ত হয়েছি
আমি এ রকম আবহাওয়ার প্রেমে পড়েছি;
এ রকম আবহাওয়ায় আমি বাসাতে রুটি ও লবণ আনতে ভুলে গেছি;
আমার কবিতা লেখার রোগটা ফিরে এসেছে এ রকম আবহাওয়ায়;
এই সুন্দর আবহাওয়া আমার সর্বনাশ করেছে।
তুমি কি জানো কেন তুমি রাতের পর রাত
স্বপ্নে এসে দেখা দাও,
পবিত্র চাদরের ওপরে শয়তান কর্তৃক
কেন আমি প্রলুব্ধ হই?
তুমি কারণটা জানো
আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসি, আমার সাবেক স্ত্রী।
তুমি এক আলাদা রকমের নারী, তা কি তুমি জানো?
আমি তোমাকে এতটা ভালোবাসতাম না
যদি আমাদের মহল্লায়
তোমার পাশে অন্য একটি বৃক্ষ থাকত।
কিন্তু যদি তুমি জানতে
আমাদের সাথে কীভাবে খেলতে হয়
আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসতাম।
আমার সুদর্শন বৃক্ষ!
যখন তুমি শুকিয়ে যাবে
আমি আশা করি
আমরা সেদিন অন্য মহল্লায় স্থানান্তরিত হব।
আমি বিদায়ী জাহাজের দিকে তাকিয়ে থাকি
আমি নিজেকে সমুদ্রের জলে ছুড়ে দিতে পারি না, পৃথিবী খুব সুন্দর;
আমার মধ্যে পুরুষত্ব আছে, আমি শব্দ করে কাঁদতে পারি না।