গল্প

তিন পিঁপড়ে ভাইবোন

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

কথায় কথায় খেপে যায় মিলু। চেঁচিয়ে বলে, ‘ইমলিঝিমলি কিমলি কাকু, ইমলিঝিমলি কিমলি কাকু।’ তারপর হাতের কাছে যা পায়, তা-ই ভাঙা শুরু করে। আদুরে বোনের রাগ দেখলে ইলু-পিলুর মাথা ঠিক থাকে না। বোনের রাগ ভাঙাতে ওলট-পালট আছাড় খায়। জিমন্যাস্টদের মতো কারিকুরি দেখায়। শরীরের নানা কসরত করে। দুপায়ে লাফায়। তারপর চ্যাংদোলা করে বোনকে দোল খাওয়ায়। দোল খেতে গিয়ে যেই ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগে মিলুর, অমনি মন ভালো হয়ে যায়। মন ভালো না হলে প্যাঁচামুখ করে বসে থাকে মিলু। পিনপিন করে কাঁদে। ঠিক তার ভূত বন্ধুটার মতো। কিছুদিন আগে এক ভূতের বাচ্চার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় মিলুর। নাম মাশায়েখা। প্রথম দিন তার নাম শুনে মিলু বলে, ‘কী নাম বললে, মাখায়ে খা?’ এই কথা শুনে ভূতের বাচ্চাটার শুরু হলো পিনপিনানি। কাঁদছে তো কাঁদছেই। চোখের পানিতে ঘরবাড়ি ডুবুডুবু অবস্থা। ভাগ্যিস ঘটনাটা ঘটল রাতের অন্ধকারে। দিনে হলে একেবারে বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটে যেত!
সে যাক, এই তিন পিঁপড়ে ভাইবোন যে বাড়িতে থাকে, সেই বাড়ির মালিক বাদাম বিক্রি করে। রোজ সকালে তারা বাদামওয়ালার মেয়ের সঙ্গে টিভিতে কার্টুন দেখে আর কুটকুট করে বাদাম খুঁটে খায়। বাদাম ছাড়া তেমন ভালো খাবার পায় না। বাদামওয়ালার বউ বড্ড হিসেবি। কোথাও কোনো খাবার পড়ে থাকতে দেয় না। সবকিছুতে খবরদারি। চিনির বয়ামটা ভুলেও খোলা রাখে না। বিস্কুটের টিনের ঢাকনা দিয়ে তার ওপরে ধুমধাম কিল। মুড়ির কনটেইনারটা পারে না কোলে নিয়ে বসে থাকে; একটু পরপর এদিক-সেদিক নাড়িয়ে রাখে। কিছুদিন আগে সকালে পিঠা বানাল। সবাই বেশ আয়েশ করে খেজুরের রস দিয়ে পিঠা খাচ্ছে। পাশেই পড়ে আছে বয়ামের ঢাকনা। মিলু গিয়ে বসে ঢাকনায়। ওমা, বসতে না বসতেই খপ করে ঢাকনাটা তুলে ঘুরিয়ে লাগিয়ে দেয় বাদামওয়ালার বউ। ভেতরে আটকে যায় মিলু। একটুর জন্য রসে পড়ে যায়নি। ভয়ে চিত্কার দিল। কিন্তু শব্দ বের হয় না বয়াম থেকে। কুটকুট করে বয়ামের গায়ে কামড়াতে থাকে। কিছুই হয় না। কামড় পিছলে যায়। বুঝতে পারে, এখানে মেজাজ খারাপ করে লাভ নেই। তার ভাইদের কসরতের কথা মনে পড়ল। দুভাই মিলুকে নিয়ে একবার শহরে গিয়েছিল। বয়ামে করে। সেই বয়ামভর্তি ছিল পিঠা। বাসের ঝাঁকির সঙ্গে পিঠাগুলো এসে তাদের গায়ের ওপর পড়তে লাগল। দুভাই খুব সাহস করে একটা পিঠা ফুটো করে তার ভেতর মিলুকে ঢুকিয়ে দিল। এরপর তিনজনই খুব আরাম করে পিঠার ভেতরে বসে শহরে চলে গেল। শহরে গিয়ে পিঠার বয়াম থেকে বেরিয়ে পড়ল। সেও অনেক কথা। কিন্তু একদিন তিন ভাইবোন আটকা পড়ল চিনির বয়ামে। সেদিন তারা সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। দুভাই মিলুকে ঢাকনার নিচে কীভাবে কামড়ে ধরে থাকতে হয়, তা শিখিয়ে দিল। মিলু তার ভাইদের কাছ থেকে শেখা সেই টেকনিক এখন কাজে লাগাল। শক্ত করে ঢাকনার তলাটা কামড়ে ধরে আছে। কিন্তু কতক্ষণ থাকা যায় এভাবে? এর ভেতর তার পিঠ চুলকাতে থাকল। পেটের মধ্যে সুড়সুড়ি লাগল। ভাইদের সঙ্গে থাকলে এখন হাসতে হাসতে দম বন্ধ হওয়ার দশা হতো। কিন্তু একাকী তার কিছুই ভালো লাগছে না। বড্ড ভয় লাগছে। বয়ামের গলা পর্যন্ত খেজুরের রস। কিন্তু একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না। সে শুধু বের হওয়ার ফাঁকফোকর খুঁজছে। হঠাৎ কে যেন বয়ামের ঢাকনা পেঁচিয়ে খুলতে লাগল। একটু ভয় পেলেও বাইরের ঠান্ডা বাতাস এসে লাগল গায়ে। মন ভালো হলো কিছুটা। ভয়ে ভয়ে আশপাশ দেখল, ঢাকনাটা ওপরে তুলে কে যেন টুপ করে রসের ভেতর আঙুল ডুবিয়ে তাতে রস তুলে নিল। তারপর আবার আঙুল ডুবাতেই কামড় ছেড়ে দিয়ে ঢাকনার তলা থেকে মাটিতে পড়ল। পড়েই মিটিং দৌড়...।
এদিকে তার দুভাই বোনের খোঁজে দিশেহারা! তারা বড় পিঁপড়াদের কাছে গেল। ইনফরমার পিঁপড়াকে খবরটা দিয়ে এল। সৈনিক পিঁপড়াকে বলল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি থাকতে। বড় ভাই পিলু এসব বলতে বলতে কেঁদেও দিল। ছোট বোনটাকে ছাড়া দুভাইয়ের কিছুই ভালো লাগে না। কাঁদতে কাঁদতে দুজন টিভি রুমে গিয়ে বসে। ঠিক যে জায়গাটায় বসে তিন ভাইবোন কার্টুন দেখে। একটু পর ভিজে চুবচুবে বোন মিলু পাশে এসে বসে। দুভাই তাকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। জিব দিয়ে চেটে তার গায়ে লেগে থাকা আঠালো খেজুরের রস খায়। এর ভেতর বাদামওয়ালার মেয়েটা এসে টিভি ছাড়ে। বাইরে কে যেন ডাকে, ‘নাট মিন্টু বাড়িতে আছে নি গো-ও বউ মা-আ-আ...!’
তিন ভাইবোন বলে, ‘বউ মা না ছাই! যা দস্যি, বাপরে বাপ। যেমন মা, তেমনি হয়েছে মেয়েটাও।’
গ্রামের হাঁটে-ঘাটে আর স্কুল-কলেজে বাদাম বিক্রি করেন মন্টু মিয়া। তাই সবাই তাকে নাট মিন্টু ডাকে। নাট মিন্টুর আপন ছেলেপুলে নাই। বড় বোনের মেয়েকে পোষে। নাম টুকলি। দুজনের কী যে আদর পরের মেয়ের জন্য! পিঁপড়ে ভাইবোন দুচক্ষে দেখতে পারে না আহ্লাদী মেয়েটাকে। সেদিন বাজার থেকে আসার সময় নাট মিন্টু মেয়ের জন্য আচার নিয়ে এসেছিল। টকটক-মিষ্টি আচার। রাতে বিছানায় শুয়ে আচারটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল মেয়েটা। কী বজ্জাত মেয়েরে; একটুও রাখল না প্যাকেটে! একেবারে প্যাকেট উল্টিয়ে ভেতরটাও চুষে খেলো। বাপরে, মেয়ে একটা হয়েছেও ইমলিঝিমলি কিমলি কাকু টাইপের। ইলু-মিলুরা কারও ওপর রাগলে তাকে ইমলিঝিমলি কিমলি কাকু বলে বকা দেয়। দুষ্টু মেয়েটা কোথায় প্যাকেটে মসলা-টসলা একটু রেখে দেবে তা না, বরং চেটেপুটে একেবারে সাবাড়। সকালেও বিছানায় পড়ে আছে প্যাকেটটা। ইলু বলে, ‘অই ইমলিঝিমলি কিমলি মেয়ে, প্যাকেটটা রাখলে কেন। এটাও অ্যাওম-গ্যাওম করে খেয়ে নিতে?’
কিন্তু তাদের কথা কানে যায় না মেয়েটার। সে কার্টুন দেখে আর হাসে! তিন পিঁপড়ে ভাইবোনের ক্ষোভ বাড়ে। বাড়তেই থাকে। জানি না। রেগেমেগে তারা এইবার কী কাণ্ড ঘটায়!