হযবরল এক দেশ

.

‘চশমা’ বানানটা তো আমরা সবাই জানি, তাই না? চ, তালব্য-শ, আর ম আকার মা, হয়ে গেল চশমা—এ তো খুবই সহজ বানান। কিন্তু তোমরা কি জানো, একটা দেশ আছে, সেখানে চশমা বানানটি লেখা হয় চন্দ্রবিন্দুর চ, বিড়ালের তালব্য-শ আর রুমালের মা দিয়ে? একদম হকচকিয়ে গেলে তো?
আজ তোমাদের শোনাব অভূতপূর্ব সেই দেশের কাহিনি। সেখানে সব সময়ই ঘটে চলে নানান ধরনের আজগুবি, উদ্ভট, মজাদার আর অসম্ভব সব কাণ্ডকারখানা। সে দেশে কেউ কখনো বুড়ো হয়ে মরে যায় না। বয়স ৪০ হওয়ামাত্রই সে দেশের লোকজন বয়সটাকে ঘুরিয়ে দেয় বনবন করে। তাই টাকমাথা থুত্থুরে বুড়োর বয়সও সেখানে মাত্র ১৩ বছর। লোকজনের নামও সেখানে উদ্ভট। যদি, বটে, কিন্তু, তবু—এমন সব নামের লোকেদের সেখানে ছড়াছড়ি। শুধু কি তাই? এ নামগুলোও পাল্টে যায় ক্ষণে ক্ষণে।
হিজিবিজবিজ বলে এক লোক আছে সেখানে। সকালবেলায় তার নাম নাড়ুগোপাল, বিকেল হলেই তাকে ডাকতে হয় রামতাড়ু বলে। তো এই হিজিবিজবিজের শ্বশুরের নাম আবার ভারি মুচমুচে আর মজাদার। নাম তার বিস্কুট।
খুব অবাক হচ্ছ তো? অদ্ভুতুড়ে এই দেশটি কিন্তু একেবারেই আমাদের হাতের নাগালে। যেকোনো সময় ইচ্ছে হলেই চলে যেতে পারো সেই ‘সুকুমারের দেশে’। সেখানে যেতে টিকিট বা বাহন কিচ্ছুটির দরকার নেই। দরকার শুধু লাল মলাটের ওপর সবুজ বিড়ালের ছবিওয়ালা একটা বই। নাম সমগ্র শিশুসাহিত্য-সুকুমার রায়। ব্যস, এটুকুই! বইটির মলাট খুলেছ তো আবোলতাবোল ছড়ায়, অসম্ভবের ছন্দে নাচতে নাচতে মন পিছলে কখন যে ঢুকে যাবে জাদুর জগতে। চমকে উঠবে ‘শব্দকল্পদ্রুম’-এর বিকট আওয়াজে।
ঠাস ঠাস, দ্রুম দ্রাম, শুনে লাগে খট্কা—
ফুল ফোটে? তাই বলো! আমি ভাবি পটকা!
শাঁই শাঁই পন পন ভয়ে কান বন্ধ—
ওই বুঝি ছুটে যায় সে ফুলের গন্ধ?
হাত দিয়ে কান চেপে না ধরে কি এ ছড়া পড়া সম্ভব? আরেকটা ছড়ার স্বাদ নেওয়ার জন্য তো খাদ্যরসিক হতেই হবে।
শুনেছ কি বলে গেল সীতানাথ বন্দ্যো?
আকাশের গায়ে নাকি টকটক গন্ধ?
টকটক থাকে নাকো হলে পরে বৃষ্টি—
তখন দেখেছি চেটে একেবারে মিষ্টি।
খেতে যাদের মোটেও ভালো লাগে না, বিকট শব্দে যাদের মাথা ঘোরায়, ভাবছ, তাদের জন্য বুঝি কোনো ছড়া নেই? তা মোটেও ঠিক নয়। ডানপিটের, আহ্লাদীর, কাঁদুনের, নিঃস্বার্থের ছড়া আর হিংসুটেদের গানে ভরা এই দেশ। তাই ‘আমরা ভালো লক্ষ্মী সবাই, তোমরা ভারি বিশ্রী, তোমরা খাবে নিমের পাঁচন, আমরা খাবো মিশ্রি’ বলে গান গেয়ে উঠলেও এখানে কেউ চোখ রাঙাতে আসে না।
ছড়ার রাজ্য থেকে বেরিয়ে গল্পের পাড়ায় ঢুকলেই দেখা মিলবে পাগলা দাশুর। ক্লাস ফোরে পড়া খ্যাপাটে দাশুর কাজই হলো ক্লাসের বন্ধুদের হেনস্তা করা, শিক্ষকদের বোকা বানানো আর বড় ক্লাসের চালিয়াৎ ছেলেদের শায়েস্তা করা। চীনে পটকা আর দাশুর কীর্তি না পড়লে আন্দাজই করতে পারবে না তোমরা কতটা শান্ত আর লক্ষ্মী।

সুকুমার রায়ের অাঁকা গোমরাথেরিয়াম

আর আছেন হেশোরাম হুঁশিয়ার। তাঁর শিকারের অভিযান তো জগদ্বিখ্যাত। অভিযান তাঁর কারাকোরাম জঙ্গলে। শিকারি হেশোরামের সঙ্গে সেই জঙ্গলে ঢুকলে দেখা মিলবে গোমরাথেরিয়াম বা ল্যাগব্যাগর্নিস নামে অদ্ভুতুড়ে জীবজন্তুর। গোমরাথেরিয়াম স্বভাবে গোমড়ামুখো, খিটখিটে আর মেজাজি। তাকে বশে আনার জন্য পাউরুটি বা কলা সাধলে সে নিতান্ত অনিচ্ছায় বিরক্তিভরে তা খেলেও খেতে পারে। কিন্তু পেয়ারার জেলি ওকে ভুলেও দিতে যেয়ো না যেন। এই জেলি তার এতটাই অপছন্দের যে রেগে গিয়ে, সারা গায়ে জেলি মাখিয়ে মাটিতে মাথা ঠুকবে সে। সেই কারাকোরাম জঙ্গলের কাছে কাঁকড়ামতী নদী। সেখানে গেলে দেখা মিলবে চিল্লানোসোরাসের। দেখতে সেটা কিছুটা কুমির, কিছুটা সাপ আর কিছুটা মাছের মতো। এতই সে চেঁচায় যে চিল্লানোসোরাসের চেয়ে ভালো আর কোনো নাম তার হতেই পারে না।
অভূতপূর্ব এই দেশের মজাদার মানুষ আর আজব জন্তুদের উদ্ভট সব কাণ্ডকারখানার পুরোটা জানতে হলে পড়তে হবে সুকুমারসমগ্র। তবে পড়তে পড়তে যদি ঘেমে যাও, আর ঘাম মুছতে রুমাল খুঁজতে গিয়ে যদি দ্যাখো রুমালটা হয়ে গেছে বিড়াল, আর সে বলছে ‘ম্যাঁও’, তাহলে আমাকে যেন দোষ দিতে এসো না আবার।