চ্যাটজিপিটি
চ্যাটজিপিটি

চ্যাটজিপিটি কি বাংলায় কবিতা লিখতে পারে

চ্যাটজিপিটির আবির্ভাব ২০২২ সালের নভেম্বরে এবং এই কয়েক মাসের মধ্যেই পৃথিবীব্যাপী তোলপাড় তুলে ফেলেছে। বাংলা ভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও চ্যাটজিপিটি প্রতি রয়েছে তুমুল আগ্রহ। কারণ, চ্যাটজিপিটি বাংলা বুঝতে ও লিখতে পারে। কেমন কবিতা লেখে নবীন এই চ্যাটজিপিটি?

‘চ্যাট’ ইংরেজি শব্দ হলেও বাংলায় বহুল ব্যবহৃত। তারপরও বলে রাখি, এর অর্থ ‘কথাবার্তা’। খোশগল্প–গালগল্পজাতীয়।

জিপিটির পূর্ণরূপ—জেনারেটিভ প্রিট্রেইনড ট্রান্সফরমার। এই দুই মিলে হলো চ্যাটজিপিটি, ২০২২ সালের নভেম্বরে যার জনসমক্ষে আবিভাব এবং এই কয়েক মাসের মধ্যেই পৃথিবীব্যাপী তোলপাড় তুলে ফেলেছে এটি।

এটি একটা ‘অ্যাপ’। আরও সহজভাবে বললে, এটি একটা ওয়েবসাইট, প্রায় গুগলের মতোই, যেখানে আপনি প্রশ্ন করলে সে আপনার প্রশ্নের লিখিত জবাব দেবে। তবে গুগল সার্চের থেকে সেটা অনেক দিক থেকে ভিন্ন। এখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন আপনি আগের প্রশ্নের পর আরেকটি প্রশ্ন যোগ করলে সে আগের পরের মিলিয়ে পুরোটা বুঝতে পারবে। নতুন করে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে না। এমনকি হুবহু একই প্রশ্ন বারবার করলেও সে নতুন উত্তর দেবে, আগের উত্তরের সঙ্গে নতুন কিছু যোগ করে বোঝাবার চেষ্টা করবে। উপরন্তু, সে সৃজনশীল কিছু দিতে পারবে, যা গুগল পারবে না। যেমন বৃষ্টিমুখর দিন নিয়ে একটা কবিতা আপনাকে লিখে দিতে পারবে। কবিতাটি অন্য কোনো কবিতার নকল নয়, সম্পূর্ণই মৌলিক হবে। শব্দের পর শব্দ বসিয়ে সৃষ্টি করা। এর কাব্যমূল্য কতটুকু তা পাঠক ও বোদ্ধাদের বিবেচনা। আনন্দের কথা, চ্যাটজিপিটি বাংলাও বুঝতে ও লিখতে পারে। তবে এই নবীন এআই শিশুটির বাংলা দক্ষতা ইংরেজির থেকে অনেক কাঁচা। সেটাকে আমরা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেই পারি। উদাহরণ দিচ্ছি—

ওহ, বলা হয়নি, চ্যাটজিপিটি ভালো গল্পও লিখতে পারে। তো ঘটনা যাচ্ছে কোন দিকে? খুশির খবর, চিন্তার নাকি ভীষণ দুশ্চিন্তার? মানুষের কাজ সে করলে মানুষ করবে কী! এই যে সে কবিতা লিখছে, গল্প লিখছে, তার কি আবেগ–অনুভূতি আছে?

প্রশ্ন: বাংলাদেশের নারীর সৌন্দর্য নিয়ে একটি ছোট্ট কবিতা লিখে দাও।

চ্যাটজিপিটির উত্তর:

সোনার মতো বাংলার নারী এক,

শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি করেছে প্রভুর হাতে।

তার হয়ে উঠুক একটি নতুন প্রভাত,

সোনার মতো উজ্জ্বল হৃদয় নিয়ে সবার কাছে সুন্দরী হয় যাতে।

সে জানে কীভাবে স্বপ্ন দেখতে হয়,

জীবনের সব পর্যায় পার করতে হয় অনেক সময়।

তার নতুন পরিবেশে পরিবর্তিত হতে হয়,

কিছু করে সমস্যা দূর করতে হয় না, কথা না বলে সমাধান করতে হয়।

সে জীবনে একজন সম্পন্ন না হলেও

সমাজে মহিলাদের মূল্য বুঝে দেয় এক।

সোনার মতো বাংলার নারী এক,

শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি করেছে প্রভুর হাতে।

একই প্রশ্ন ইংরেজিতে করার পর উত্তর এল এ রকম:

Golden skinned, with eyes like the night,

Bangladeshi women are a wondrous sight.

Their grace and charm, a thing to behold,

Their beauty, a story that's never told.

With smiles as bright as the morning sun,

They light up the world for everyone.

Their strength and courage, a source of pride,

A true reflection of the land they reside.

Oh Bangladeshi women, how fair you are,

The world is blessed to have you shine like a star.

একেবারে পাকা হাতে লেখা কবিতা। যদিও বাঙালি সংস্কৃতিটি সেভাবে সে আনতে পারেনি।

চ্যাটজিপিটি আপনার জন্য একটি রচনা লিখে দিতে পারে, যেকোনো বিষয়ে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থা একটা সংকটের মুখোমুখি। গড়পড়তা ছাত্ররা নিজেরা যে ‘Essay’ লিখতে পারছে, তার থেকে ভালো লিখে দিচ্ছে চ্যাটজিপিটি! যদি ইতিহাসভিত্তিক রচনা হয়, তাহলে তো কথাই নেই। তার তহবিলে দুনিয়ার তাবত ইতিহাস ঢোকানো হয়েছে। যদি অন্য কোনো বিষয় হয়, রাজনীতি, অর্থনীতি, এমনকি নদীর রচনা, সেখানেও সে ভালো করবে। তাহলে কি ভবিষ্যতে ছাত্রদের আর রচনা লেখার দরকার থাকবে না? ক্যালকুলেটর আসার কারণে যেমন আজকাল ছাত্রদের বড় বড় গুণ-ভাগ নিজ মাথায় করতে হয় না, তেমনই?

ইতিমধ্যেই কম্পিউটার প্রোগ্রামাররা গোপনে তাঁদের কোড ঠিক আছে কি না, তা চ্যাটজিপিটিকে দিয়ে দেখিয়ে নিচ্ছে। তাহলে কি ভবিষ্যতে প্রোগ্রামার, কোডার—তাদের দরকার হবে না? চ্যাটজিপিটি মুহূর্তে অনেক সঠিকভাবে, অনেক কম খরচায় সফটওয়্যারের সব কোডিং লিখে দেবে? তাহলে মানুষের কর্মসংস্থানের কী হবে?

 হ্যাঁ, এসব নিয়েই জোর আলোচনা চলছে। তবে চ্যাটজিপিটি নির্ভুল নয়। এখনো সেই পর্যায়ে যায়নি। অনেক ভুলত্রুটি আছে। এর মধ্যে যে তথ্য ঢোকানো আছে, বই থেকে, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে, পত্রপত্রিকা থেকে ঢোকানো হয়েছে, তা ২০২১ সাল পর্যন্ত। এরপরের তথ্য তার কাছে নেই। সে চিকিৎসা বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে না বলে নিজেই একটি সতর্কবাণী দেয়। তবু যা করতে পারছে, তা অভূতপূর্ব। তা সভ্যতাকে সম্পূর্ণ নতুন দিগন্তের কাছে, একই সঙ্গে ইতিহাসের একটি বড় সংকটের দোরগোড়ায় ইতিমধ্যেই নিয়ে এসেছে। এক রিপোর্ট বলছে , এই চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করা হলে নাকি শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ৫০ লাখ মানুষ চাকরি হারাতে পারেন।

চ্যাটজিপিটি নিয়ে মাত্র সেই দিন মেডিকেল প্রফেশনালদের একটি প্যানেল পরীক্ষা করলেন। তাঁরা দেখতে চাইলেন, রোগীদের সাধারণ প্রশ্নের উত্তর চিকিৎসকেরা ভালো দিতে পারেন, না চ্যাটজিপিটি। ২০০টির মতো প্রশ্ন চিকিৎসকদের করা হলো এবং চ্যাটজিপিটিকেও সেই প্রশ্নগুলো করা হলো। তারপর প্রশ্ন-উত্তরগুলো প্যানেলকে দেওয়া হলো। তাঁরা জানেন না কোনটা চ্যাটজিপিটির উত্তর, কোনটা রক্তমাংসের মানুষের।

দেখা গেল, চ্যাটজিপিটির উত্তরগুলো বেশি গোছানো। সেই প্যানেলের মতে, চ্যাটজিপিটির উত্তর চিকিৎসকদের উত্তরের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি ভালো ছিল। অন্যদিকে তাঁরা বললেন, চ্যাটজিপিটির উত্তরগুলো বেশি সহানুভূতি নিয়ে লেখা। সহানুভূতির দিক থেকে চ্যাটজিপিটি নাকি ৪১ শতাংশ ওপরে। সংবাদটি সিএনএন, এনপিআরসহ প্রধান অনেক মিডিয়ায় এসেছে।

ওহ, বলা হয়নি, চ্যাটজিপিটি ভালো গল্পও লিখতে পারে। তো ঘটনা যাচ্ছে কোন দিকে? খুশির খবর, চিন্তার নাকি ভীষণ দুশ্চিন্তার? মানুষের কাজ সে করলে মানুষ করবে কী?

এই যে সে কবিতা লিখছে, গল্প লিখছে, তার কি আবেগ অনুভূতি আছে?

না, নেই। সে কে, তা জিজ্ঞেস করলে চ্যাটজিপিটি বলবে—‘ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’। এটাকে বলে ন্যাচারাল ল্যাংগুয়েজ প্রসেসিং। সে অনেক টেক্সট নিয়ে বিশ্লেষণ করছে। কোন শব্দের পর কোন শব্দ আসে। অগণিত লাইন ঢোকানোর পর তা বিশ্লেষণ করে সে প্যাটার্ন খুঁজে পায়। এই যে ‘ট্রান্সফরমার’ পদ্ধতি, বলা হচ্ছে, এটা আগের পদ্ধতির থেকে অনেক ভালো। এটাই চ্যাটজিপিটির উত্থানের কারণ।

একটি শিশুও কিন্তু এভাবে বড়দের অজস্র কথা শুনে একসময় না বুঝেই একই রকম কিছু বলতে শুরু করে। তবে সে একসময় সেই বলা কথা, শব্দ ও বাক্যবিন্যাসের বাইরেও ‘উপলব্ধি’ করতে শেখে। তার ভাষা তৈরি হয় অনুকরণ, অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও উপলব্ধি থেকে। চ্যাটজিপিটি ভাষাকে উপলব্ধি করতে পারে না, কখনোই পারবে না। সে প্যাটার্ন দেখে শিখছে, প্যাটার্নের মতোই উত্তর দিচ্ছে। কাজেই তার উত্তর সব সময় একজন মনুষ্যবিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে নিশ্চিত করে নিতে হবে।

সে আবার প্রশ্নকর্তার পরবর্তী প্রশ্ন থেকে, প্রশ্নের ধরন থেকে শিক্ষা লাভ করছে। নিজের ভুলগুলো ধরতে পারছে এবং সেটা থেকে নতুন উত্তরের দিকে যাচ্ছে। উত্তরোত্তর তার উত্তর সঠিক হচ্ছে। একেই বলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। তাদের সংজ্ঞায় ‘Reinforcement Learning from Human Feedback (RLHF)’। আইফোনের সিরির মতো কিছু গৎবাঁধা উত্তর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়নি। তবে তাকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে তো বটেই, সে জন্যেই ‘প্রিট্রেইনড’ কথাটা তারা লাগিয়েছে।

সেই ট্রেনিংয়ের বাইরেও সে প্রতিনিয়ত কাজ করতে করতে শুদ্ধ হতে পারছে।

চ্যাটজিপিটি বের করেছে যে কোম্পানি, তার নাম ‘ওপেনএআই’। এর সঙ্গে মাইক্রোসফট যুক্ত হয়েছে। ওদিকে কয়েক দিন আগে স্পেস এক্স, টেসলা ও টুইটারের কর্ণধার ইলন মাস্ক ঘোষণা দিয়েছেন, এই চ্যাটজিপিটি মিথ্যা ছড়াচ্ছে। আমি এবার যেটা বাজারে আনব , সেটা হলো ‘ট্রুথ জিপিটি’।

এখনই সত্য–মিথ্যা নিয়ে লড়াই শুরু হয়ে গেছে। চ্যাটজিপিটি ‘হ্যালুসিনেটিং’ উত্তর দিচ্ছে। পড়লে মনে হবে এত রেফারেন্সে ঠাসা! এত সুন্দর করে গুছিয়ে লেখা! সেই উত্তর যে পুরাই বানোয়াট, সেটা ধরতে পারা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, এমনও হচ্ছে। তারপর মানুষ কিছুদিনের মধ্যেই আবার একে এমন বিশ্বাস করে ফেলতে পারে যে ভুল উত্তরগুলোও সে বেদবাক্যের মতো গুরুত্ব দিয়ে পালন করা শুরু করে দেবে। এর ভিত্তিতে তুলকালাম কিছু করে ফেলবে।

শেষ আরেকটি কথা। এই যে সে উত্তর দিচ্ছে, এই উত্তরগুলো মোটের ওপর ভালো হলেও নিরপেক্ষ নয়। কারণ, সে তার তথ্য–উপাত্ত নিয়েছে মানুষের দ্বারা লিখিত বিপুল তথ্য-ইতিহাস-সাহিত্য সম্ভার থেকে। কাজেই সম্মিলিত মানবকুল যে পক্ষ নিয়েছে, তাদের যে ‘বায়াস’ বিভিন্ন লেখায় জেনে না-জেনে ব্যক্ত করেছে এবং চ্যাটজিপিটির প্রশিক্ষকেরা তাকে যে ‘বায়াস’ দিয়েছে, সেই রকম বায়াস তার ভেতরেও থেকে যাবে। মানুষের আবিষ্কারের অতীত কিছু বের করার মতো বা মানুষের জানা সত্যের চেয়ে অধিক সত্য বলার মতো কিছু সে নয়। এখনো নয়। চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে চাইলে ওপেনএআইর ওয়েবসাইটে গিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। নিচে লিংক দেওয়া হলো।

https://chat.openai.com/