দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে, ভাষা–সংস্কৃতি, আচার–ঐতিহ্যের গণ্ডি পেরিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জীবনের পরিক্রমায় মানুষ মাত্রেই আছে মানবিক এক মন। আর নানান আবেগে সেই মন তার পুরে, আবার পোড়েও। সুখ–দুঃখ, আনন্দ–বেদনা, শোক, রাগ বা অনুরাগ অথবা বীতরাগ কিংবা হাসি–কান্না, বিদ্বেষ–বিচ্ছেদ বা মায়ামমতা—এই সব নানান মানবিক অনুভূতির কোনো জাতি-ধর্ম নেই, নেই কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা কিংবা সময়-কালের বিভাজন। এত সব সর্বজনীন, সর্বকালীন অনুভব ছাপিয়ে বাঙালির বড় একান্ত, বড় নিজস্ব, ভারি অনন্য যে হৃদয়ানুভূতি, তার নাম ‘অভিমান’। বাঙালি আধুনিক হয়েছে, বৈশ্বিক হয়েছে, নাগরিক জীবনের ইঁদুর-দৌড়ে নিত্যনতুন অনেক কিছু শিখেছে আবার নানান কিছু খুইয়েছেও। এই পরিক্রমায় তার চিরায়ত নানান বেদন–সংবেদনে–বোধে এসেছে পরিবর্তন, লেগেছে বিশ্বজনীনতার ছোঁয়া। কিন্তু বাঙালির অভিমান এত সব কিছুর পরেও রয়ে গেছে একান্ত বাঙালির হয়ে, বাঙালির মতো করে। আজও আধুনিক, বিশ্বনাগরিক, কেতাদুরস্ত বাঙালি ইংরেজি কিংবা অন্য কোনো ভাষায় তার একান্ত নিজস্ব অভিমান আর তার বোধকে অনুবাদ করে উঠতে পারেনি, ভাষান্তরে সংজ্ঞায়িত করে উঠতে পারেনি, বলে বোঝাতে পারেনি কেমন করে ‘অভিমানে ফুল ঝরে যায়’!
অভিমান আসলে কী, কী তার অন্তর্নিহিত অর্থ? কেমন তার অনুভব, কীই–বা তার প্রকাশ? এর অভিধা, এর ব্যঞ্জনা বা এর গভীরতাই–বা কী? বাঙালি হয়ে জন্মানোর সহজাত অনুষঙ্গ কিন্তু নয় এই অভিমান। একে বুঝে, জেনে, শিখে বোধে গ্রহণ করি আমরা জীবনচর্চা আর চর্যার পথ ধরে। তাই আমাদের একেকজনের অভিমানের প্রকাশ আলাদা, একে ধারণ করার মনন আর মানস আলাদা। তাই একে একশব্দে সর্বজনীনতায় সংজ্ঞায়িত করা দুষ্কর, প্রায় অসম্ভব। অভিমান রাগ নয়, দুঃখ নয়, ক্ষোভ নয় আবার বিরক্তিও নয়। এ এক অনন্য বহুমাত্রিক অনুভূতি, যা হয়তো শব্দে প্রকাশ পায় না, তাই অভিমানের প্রকাশ বাঙ্ময় নয়; কিন্তু তাই বলে অপ্রকাশও নয়। ভুলে গেলে চলবে কেন যে অভিমান কিন্তু আসলে প্রগাঢ় ভালোবাসার, সুতীব্র প্রেমময়তার গভীর ব্যঞ্জনাময় সাক্ষ্য। কেননা প্রেম থাকলেই অভিমান হয়, ভালোবাসার দাবিতেই কেবল অভিমান করা চলে। তাই অভিমান সরলরৈখিক নয়, এতে আছে ভালোবাসাপ্রসূত নির্ভরতা, প্রত্যাশা, ভরসা আর সঙ্গে আছে প্রাপ্তির অপূর্ণতার নীরব বেদনা। ‘পেয়ে কেন নাহি পাই’ তাই অভিমানের পরম সুন্দর প্রকাশ। আর আমি আসলে অভিমানকে চিনেছি, জেনেছি, ছুঁয়েছি, বুঝেছি নজরুলের গানে, তাঁর লেখায়, তাঁর ‘সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে’।
অভিমান আসলে কী, কী তার অন্তর্নিহিত অর্থ? কেমন তার অনুভব, কীই–বা তার প্রকাশ? অভিমান রাগ নয়, দুঃখ নয়, ক্ষোভ নয় আবার বিরক্তিও নয়। এ এক অনন্য বহুমাত্রিক অনুভূতি, যা হয়তো শব্দে প্রকাশ পায় না, তাই অভিমানের প্রকাশ বাঙ্ময় নয়; কিন্তু তাই বলে অপ্রকাশও নয়।
নজরুলের গানে আমি যেমন শিখেছি কেমন করে ‘গানে গানে ঢাকব আমার গভীর অভিমান’, তেমনি জেনেছি ‘আদর–সোহাগ, প্রেম–ভালোবাসা, অভিমান মাখামাখি’ হয়ে কী অপূর্ব ব্যঞ্জনাময় অনুভূতিতে হৃদয় ছেয়ে যায়! নজরুলের প্রাণস্পর্শী শব্দবন্ধে আমি অনুভব করতে শিখেছি নীরবতারও ভাষা আছে, তাঁর গানের মধ্য দিয়েই বুঝে নিয়েছি ‘এত কথা কি গো কহিতে জানে, চঞ্চল ঐ আঁখি’। তাই আর সবার কাছে নজরুল যখন ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো’ বিদ্রোহী কবি হয়ে অকুতোভয়ে জানান দেন ‘আমি দুর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার…আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!’; তখন আমার কাছে নজরুল কিন্তু চিরকালের সেইজন, যিনি গানে গানে আমার হৃদয়ে বারবার জানান দিয়ে যান ‘কাঁটার ঘায়ে কুসুম ক’রে ফোটাব মোর প্রাণ…আঘাত যত হান্বে বীণায় উঠ্বে তত তান’। এর চেয়ে গভীরভাবে কেই–বা আমায় অভিমানের অভিধার, এর ব্যঞ্জনার সুলুকসন্ধান দিতে পারে। আমার নজরুল তাই অভিমানী নজরুল।
আমার নজরুল উজাড় করে যেমন ভালোবাসতে শেখায়, তেমন করে নীরব কিন্তু প্রগাঢ় অভিমানে ছেয়ে থাকা হৃদয়ের সুরতন্ত্রীতে সুর জাগায়। তাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল যখন বলেন ‘আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ, আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল’—তখন মনে মনে এই আমি ভাবি, হাম্বীর বা ছায়ানট বা হিন্দোলের স্বরবন্ধে কিংবা সুরের গাঁথুনিতে তো রাগ নেই, ক্ষোভ নেই, দ্বেষ নেই, নেই ক্রোধ, বরং আছে গভীরতা, নিবেদনের সুরে প্রচ্ছন্ন বেদনার রেশ। তাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার রূপকল্পে আমি কেবল দ্রোহের উচ্ছ্বাস নয়, বরং আবেগতাড়িত হৃদয়স্পর্শী অভিমানের সুর খুঁজে পাই। আমার কেবলই মনে হয়, নজরুলের বিদ্রোহ আসলে অভিমানেরই স্বতঃস্ফূর্ত মূর্তরূপ; অভিমান তাঁর দ্রোহের জিয়ন–কাঠি। অভিমানের অমন অনন্যমাত্রিকতাও আমার নজরুলের কাছেই শেখা, জানা, বোঝা।
‘আমি কবি হতে আসিনি, নেতা হতে আসিনি। আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী হতে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল যখন বলেন ‘আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ, আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল’—কবিতার রূপকল্পে কেবল দ্রোহের উচ্ছ্বাস নয়, বরং আবেগতাড়িত হৃদয়স্পর্শী অভিমানের সুর খুঁজে পাই; নজরুলের বিদ্রোহ আসলে অভিমানেরই স্বতঃস্ফূর্ত মূর্তরূপ; অভিমান তাঁর দ্রোহের জিয়ন–কাঠি।
কবির অমন লেখার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অভিমানের বেদনা। কিন্তু সেই অভিমানে প্রচ্ছন্ন অনুযোগের সুরও কি নেই? আর সেই সুরে অভিযোগ নেই, ক্ষোভ নেই, আছে বেদনা, আছে হাহাকার, আছে অপ্রাপ্তি। আর এখানেই নজরুল একান্ত বাঙালির হয়ে ওঠেন, যেখানে কেড়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা নেই, আদায় করার অভিলাষ নেই, প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার অভীপ্সা নেই। বরং আছে অভিমানে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার আকুলতা। আমার নজরুল তাই অভিমানী নজরুল, যিনি দ্রোহের আগুন জ্বালাতে গিয়ে বলতে পারেন, ‘আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়…আমি উন্মন মন উদাসীর, আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা হুতাশ আমি হুতাশীর’।
সেই শৈশবে প্রথম ‘অভিমান’ শব্দটা আর তার ব্যঞ্জনা নিয়ে ভাবনাটা মনে গাঁথা হয়েছিল নজরুলের গানেই। মনে আছে, তখন বড়জোর ছয়–সাত বছর বয়স আমার। খুব দুলে দুলে আমারই কাছাকাছি বয়সের এক শিশু মঞ্চে গাইছিল—‘আমার গানের মালা আমি করব কারে দান’। কিন্তু যেই মাত্র আমার কানে এল পরের লাইনখানা—‘মালার ফুলে জড়িয়ে আছে করুণ অভিমান’, তখন মনে হলো এই গান তো এত আনন্দে, স্ফুর্তিতে, হাসিমুখে গাইবার নয়। শিশু সেই আমার অভিমান বোঝার মনন ছিল না তখন, সেটা সত্যি; কিন্তু ‘করুণ’ শব্দের দ্যোতনাযোগে সেই প্রথম, সেই শিশু বয়সে নজরুল আমায় জানিয়ে দিয়েছিলেন অভিমানের রস ‘করুণ’, এই বোধে বেদনার ছায়া দেখা যায়। সেই ছায়াকে বুঝে নিতে হয়, বোধে নিতে হয়। মনে আছে, বাড়ি ফেরার পথে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম অভিমানের সংজ্ঞা, তার শব্দগত আক্ষরিক অর্থ। আর বাবা আমার সেই সেদিন কথায় কথায় অভিমানের বাঙালিয়ানা অথবা বাঙালিয়ানায় অভিমানের অঙ্গাঙ্গি অবস্থানের বোধকে খুঁজে বেড়ানোর প্রয়াসকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন জীবনের ছোট ছোট গল্পে, প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যাসের উদাহরণে। বাড়ি ফিরে বই খুলে ‘আমার গানের মালা আমি করব কারে দান’ গানটি আমার সঙ্গে বসে পড়েছিলেন। ছয় বছর বয়সে খুব যে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলাম, অমন দাবি করব না। বাবাও সেই আশা করেননি, আমি নিশ্চিত। কিন্তু ‘চোখে মলিন কাজল লেখা, কণ্ঠে কাঁদে কুহু কেকা’ এই রূপকল্প আমার সেই শিশুমনে অভিমানের মূর্তপ্রকাশ হয়ে রয়ে গেল চিরকালের জন্য।
দিনে দিনে অভিমানের সকাশে আর তার প্রকাশে যোগ হয়েছে নানান মাত্রা—তা সত্যি! কিন্তু নজরুলের অপূর্ব চিত্রকল্প, তাঁর গভীর বোধের সহজিয়া প্রতিফলনেই অভিমানের রূপের সঙ্গে, অনুভবের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। সময়ের সাথে সাথে যতবার গানখানি পড়েছি, গেয়েছি, ততবার বুঝেছি অভিমানের কত গভীর বোধ থাকলে, কতটা সেই অনুভব ধারণ করলে লেখা যায় ‘কাঁথায় আমার কাঁটার বেদন মালায় সূচির জ্বালা, কণ্ঠে দিতে সাহস না পাই অভিশাপের মালা’। নজরুলের গানেই, তাঁর লেখা কণ্ঠ দিয়ে প্রকাশ করতে গিয়েই মনে হলো এই ‘জ্বালা’টুকু, এই বেদনাটুকু, পেয়েও না পাওয়ার যন্ত্রণাবোধটুকু অনুভব করতে না পারলে, কবির অভিমানে আমার অভিমানের অনুভবের সমাপতন হবে না। কত গভীর প্রেমময়তার সঙ্গে অপ্রাপ্তির আক্ষেপের মিশেল হলে বলা যায় ‘কাঁথায় আমার কাঁটার বেদন মালায় সূচির জ্বালা’! কাঁথার মতো আটপৌরে সাদামাটা সাধারণ জিনিস দিয়েও যে অভিমানের যন্ত্রণাকে আঁকা যায়, তা–ও তো নজরুলের কাছেই জানা হলো। আর সেই জানাতেই এই বোধ গভীর হলো যে অভিমান কোনো তুলায় মুড়িয়ে রাখা দামি আলংকারিক অনুভব নয়, এই অনুভূতি আটপৌরে, নিত্যকার, ছাপোষা সাধারণ বাঙালি জীবনের চিরায়ত অনুষঙ্গ।
আমার অভিমানী নজরুলের গানে গানেই আমার প্রথম জানা হলো ফুল দিয়ে গাঁথা মালাতে কেবল রঙের বাহার, সুগন্ধের মৌতাতই থাকে না, থাকতে পারে ‘করুণ অভিমান’। আর সেই মালায় ফুলের সৌন্দর্য, সৌরভ সব ছাপিয়ে বোধ হয় ‘সূচির জ্বালা’। সেই মালা পরাও হয় না, পরানোও যায় না। তাই কবির গানে যখন খুঁজে পাই ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই কেন মনে রাখো তা’রে, ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে’—এমন বাক্যবন্ধ, তখন বুঝি প্রেমের অপূর্ণতার আক্ষেপ, হৃদয়ক্ষরণের যন্ত্রণা। কিন্তু সেই যন্ত্রণার প্রকাশেও নজরুল লেখেন ‘আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি জানো বা শুনেছ জানি না) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোনো অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবিও নেই’। অভিমানী প্রেমী তাই তার প্রেমকে, প্রেমের অপ্রাপ্তিতে অন্যকে আঘাত করে না। অভিমানের অনুভবে, এর প্রকাশে কোনো প্রকার অভিঘাত নেই, দ্বন্দ্ব নেই, নেই কুৎসা, নেই বিন্দুমাত্র অসূয়াও। অভিমানী নজরুল তাই গভীর প্রত্যয়ে জানান দিতে পারেন ‘অসুন্দর কুৎসিতের সাধনা আমার নয়’–এও তো অভিমান গভীর করে, অনন্য মাত্রায় আমায় চিনিয়ে দিয়ে যায়।
নজরুলের লেখাতেই আমার জানা হয় বিচ্ছেদের বেদনাতেও অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে থাকে অভিমানের সুর। অভিমান প্রগাঢ় হয় বলেই হয়তো বিচ্ছেদ আসে। বিচ্ছেদের সেই অভিমানের অভিব্যক্তিতে ভর্ৎসনা নেই, আছে বেদনাহত অনুযোগ, নীরব আর্তনাদ। তাই যখন গাই কবির কাব্যিক অভিমানী অনুযোগ ‘আমি ফিরি পথে, তাহে কার ক্ষতি, তব চোখে কেন সজল মিনতি?’ তখন বুঝি অমন প্রশ্ন করতে গিয়ে আর্দ্র হয় প্রশ্নকারীর চোখও। সেই সজল চোখেই অভিমানী কবি ভিক্ষা চান ‘দয়া কর, মোরে দয়া কর, আর আমারে লইয়া খেলো না নিঠুর খেলা’। কেননা প্রেমের অপূর্ণতা হৃদয়ে জানান দেয়, মনকে বুঝিয়ে দেয় ‘শত কাঁদিলেও ফিরিবে না প্রিয় শুভ লগনের বেলা’। কিন্তু আবার অমন বাক্যবন্ধই আশ্বস্ত করে, সাক্ষ্য দেয় গভীর ভালোবাসার, অকৃত্রিম প্রেমময়তার। আর অভিমানে যে বিচ্ছেদ হয়, সেই প্রেমের হয়তো ইতি কখনোই টানা যায় না, সে–ও আমার জানা হলো নার্গিসকে উদ্দেশ করে লেখা ১৯৩৭ সালে কবির চিঠিতে। তিনি লিখেছিলেন—
‘তোমার আজিকার রূপ কি জানি না। আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবীমূর্তির মতো আমার হৃদয় বেদিতে অনন্ত প্রেম, অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদি গ্রহণ করলে না। পাষাণ দেবীর মতোই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদিপাঠ…জীবন ভরে সেখানেই চলেছে আমার পূজা আরতি।…দেখা? না-ই হলো এ ধূলির ধরায়। প্রেমের ফুল এ ধূলিতলে হয়ে যায় ম্লান, দগ্ধ, হতশ্রী।…তোমার যে কল্যাণ রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালোবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মান্দারের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের সে আগুন—বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি।’
আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কী গভীর ক্ষত, কী অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি, তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না। আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না…কাজী নজরুল ইসলাম
এই যে অপ্রাপ্তিতে, অপূর্ণতায়, অসম্পূর্ণতাতেও এক অমলিন, অসূয়াহীন, অক্ষয় প্রেমের রূপ, তাতেও মিলেমিশে, জড়াজড়ি করে থাকে অভিমানের এক অনবদ্য রূপ। নজরুলের চোখ দিয়েই আমি দেখেছি, জেনেছি যে ‘চির-সুদূর প্রিয়তম’কে সর্বান্তঃকরণে চেয়েও ‘পেয়ে কেন নাহি পাই হৃদয়ে মম’ আক্ষেপ না হয়ে, অনুযোগ না হয়ে বরং আরও বেশি করে ভালোবাসতে শেখায়। সেখানে ‘মূরতি ধরি তুমি নিরুপম’ ঠিক পাশে এসে না দাঁড়ালেও ‘নিখিলের রূপে রূপে, দেখা দাও চুপে চুপে’। সেই প্রেমকে ছিনিয়ে নেয় , সাধ্য কার! এমনকি সেই ‘তুমি আকাশের চাঁদ’ হলেও ‘আমি পাতিয়া সরসী-ফাঁদ’ অপেক্ষায় থাকি। আর অভিমানেই হয়তো প্রগাঢ় ভালোবাসা তার নীরব কিন্তু প্রবল উপস্থিতি ‘জনম জনম কাঁদি কুমুদীর সম’ বলে জানান দিয়ে যায়। এই কান্নাতে লজ্জা নেই, অনুশোচনা নেই বরং আছে দেদীপ্যমান ভালোবাসা আর অনির্বাণ বিরহ।
অভিমানী নজরুলের গানে গানেই অনুভাবে এল, এমনকি এই চিরবিরহী রূপে অসম্ভব জেনেও আমরা মিলনের প্রতীক্ষায় উন্মুখ থাকি। আর এই প্রতীক্ষা আছে বলেই ‘সদা কাঁপে ভীরু হিয়া রহি’ রহি’’ আর আছে অভিমানের সজল কান্না। শতসহস্র প্রচেষ্টায়ও ভালোবাসাকে ‘বুকে তায় মালা করি’ রাখিলে যায় সে চুরি, বাঁধিলে বলয়-সাথে মলয়ায় যায় সে উড়ি’। কেননা ‘সে থাকে নীল নভে…সাতাশ তারার সতীন-সাথে সে যে ঘুরে মরে’ আর ভাসি ‘আমি নয়ন-জল-সায়রে’। সেই শৈশবে ‘চোখে মলিন কাজল লেখা, কণ্ঠে কাঁদে কুহু কেকা’ শব্দবন্ধে যেমন অভিমানের মূর্তরূপকে চিনে নিতে শিখেছিলাম, যার রূপ ছিল মলিন, ভাব ছিল ‘করুণ’। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৈশোরে যখন প্রেমের সঙ্গে জানাজানি হলো, তখন বুঝলাম অভিমানে কাজল লেখা মলিন হলেও, এতে কোনো মালিন্য নেই, নেই বঞ্চনাবোধ। অভিমানের ‘করুণ’ রসেও আছে ভালোবাসতে পারার অনন্য, অনবদ্য অনুভব। ‘কাজল করি’ যারে রাখি গো আঁখি-পাতে, স্বপনে যায় সে ধুয়ে গোপনে অশ্রু-সাথে’ শব্দবন্ধের গভীরতায় পরম প্রেম আর অভিমান একাকার হয়ে যায়, সেখানে বেদনা হয়ে ওঠে এক জীবন পরিক্রমার সঞ্জীবনী, সৃজনীশক্তি। তাই নজরুল লিখতে পারেন—
‘আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কী গভীর ক্ষত, কী অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি, তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি “অগ্নিবীণা” বাজাতে পারতাম না। আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না…যাক আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষে রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে, তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করো না।’
জোর করে ভালোবাসা আদায় না করে, সরে এসে, ছেড়ে দিয়েও যে আরও প্রবল করে ভালোবাসা যায়, তা–ও আমি জেনেছি নজরুলের গানে, তাঁর কবিতায়, লেখায়। আর এই নিঃশব্দ কিন্তু প্রগাঢ় ভালোবাসা নিঃস্বার্থ, চাহিদাহীন। অভিমানে যেমন নিবেদন আছে, অনুরাগ আছে, ঠিক তেমনি আছে আকাঙ্ক্ষাহীন নিরাসক্তি। কী অপূর্বময়তায় তাই অভিমানী নজরুল সুরের গাঁথুনিতে লিখতে পারেন—
‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে
আমি বাতাস হইয়া জড়াইব কেশ, বেণী যাবে যবে খুলিতে।।
তোমার সুরের নেশায় যখন, ঝিমাবে আকাশ কাঁদিবে পবন
রোদন হইয়া আসিব তখন, তোমার বক্ষে দুলিতে।।’
অবহেলা পেলেই অবহেলা ফিরিয়ে দিতে হয় না আর অবহেলার অভিমান নিয়েও ভালোবেসে যেতে পারলে অনন্য ভিন্নমাত্রিক পূর্ণতা মেলে। তাই ‘অভিমানী গৃহহারা’ কবি লিখতে পারেন ‘জোর করে কেউ বাঁধে না তাই বুক ফুলিয়ে চলিস বিজয়রথে’।
নজরুলের জীবনকে, তাঁর মনন, মানস, বোধকে জানার প্রয়াসে, তাঁকে নিয়ে পড়তে গিয়ে বারবার অনুভব করেছি তাঁর জীবনে বারবার এসেছে দারিদ্র্য, যন্ত্রণা, দুঃখ, মৃত্যুশোক। এত সব যন্ত্রণা কি তাঁকে আরও বেশি করে অভিমানী করে তুলেছিল? এই যে তাঁর কবিতায়, গানে, লেখায় অভিমানের ছায়া চোখে পড়ে, অভিমানকে ভর করে ধূমকেতু হয়ে ওঠবার স্পৃহা নজরে আসে, তা–ও কি সেই পোড় খাওয়া, নানান আঘাতে–অভিঘাতে জর্জরিত জীবনের দান?
‘রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন, “দ্যাখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলির মতো, কিটসের মতো খুব বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে, তুই প্রস্তুত হ”। জীবনে সেই ট্র্যাজেডি দেখার জন্য আমি কত দিন অকারণে অন্যের জীবনকে অশ্রুর বরষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু আমারই জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মতো দগ্ধ। মেঘের ঊর্ধ্বে শূন্যের মতো কেবল হাসি, কেবল গান, কেবল বিদ্রোহ।’
অমন করে যেই কবি বলতে পারেন, তখন বুঝতে বেগ পেতে হয় না যে কী সুতীব্র অভিমানের অনুভব থেকে তিনি গান বেঁধে বলেন, ‘কাঁটার ঘায়ে কুসুম করে ফোটাব মোর প্রাণ’। আর অমন কাঁটার ঘায়ে হৃদয়ে নিয়ত ক্ষরণ হতো বলেই তিনি প্রত্যয়ী হয়ে বলতে পারেন, ‘আঘাত যত হান্বে বীণায় উঠ্বে তত তান’। বারবার অভিমানী নজরুল বলেছেন চরম অসহায়তায়, পরম অপূর্ণতায় গানের মাঝে, গানের সঙ্গলাভে তিনি জিয়ন–কাঠির পরশ লাভ করেছেন, আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তাই তো তিনি বলেন, ‘ভুলতে তোমার অবহেলা, গান গেয়ে মোর কাট্বে বেলা’। গানে গানে তিনি কেঁদেছেন, আবার সেই অশ্রুজলে মনের আগুন নিভিয়ে সুন্দরকে, কল্যাণকে, প্রীতিকে, প্রেমকে খুঁজে গেছেন, মানুষের জয়গান গেয়ে গেছেন। নানান বন্ধকতা এসেছে, পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর পথ। অভিমান ছিল, কিন্তু অভিযোগ না করে, অনুযোগ না এনে ভালোবাসায় ভর করে জীবনকে উপভোগ করেছেন আর আমাদেরও শিখিয়ে গেছেন অপূর্ণতাতে, অপ্রাপ্তিতেও জীবন অর্থবহ হতে পারে, উদ্যাপিত হতে পারে।
কবি চায় না দান, কবি চায় অঞ্জলি। কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয়, যা সুন্দর তাই দিয়ে। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার ধর্ম। তবু বলছি, আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখে চোখ ভরা জলও দেখেছি।
‘বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে’ জন্মগ্রহণ করে কী অনবদ্য দৃঢ়তায় নজরুল বলতে পেরেছিলেন ‘আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলে, শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই; আমি সকল দেশের, সকল মানুষের।’ তাঁকে বিদ্রোহী কবির উপাধি দেওয়া হলেও এতে তাঁর খুব সায় ছিল বলে বোধ হয় না—
‘আমাকে বিদ্রোহী বলে খামখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এ নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনোদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা-কলুষিত-পুরাতন-পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভন্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ও দুটোর কোনটাই নয়।’
আমাকে বিদ্রোহী বলে খামখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা-কলুষিত-পুরাতন-পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভন্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ও দুটোর কোনোটাই নয়।কাজী নজরুল ইসলাম
এই আধুনিকমনস্ক, সর্বজনীন, সত্যিকার অর্থেই আন্তর্জাতিক নজরুলের তাই অভিমান ছিল সামগ্রিক সমাজের ওপর। সেই অভিমান থেকেই রসদ তিনি নিয়েছেন সকল বৈষম্য, বিভেদ, পশ্চাৎপদতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, তিনি নিজেই বলেছেন ‘এ অসাম্য ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম’। এই অভিমানী নজরুল, এই প্রত্যয়ী নজরুল আমার শক্তি আর প্রেরণার উৎসমুখে রয়েছেন আজীবন। তাঁর গানে, তাঁর কবিতায় আমার অভিমান আশ্রয় পেয়েছে, ভাষা খুঁজে পেয়েছে বারবার, বারংবার।
‘আমার কাব্যে সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ ও সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাই না, খ্যাতি চাই না, প্রতিষ্ঠা চাই না, নেতৃত্ব চাই না। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান—বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে। সকলের বাঁচার মাঝে থাকব আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।’
নজরুলের সেই তপস্যা আর সাধনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর পেরিয়ে, কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে আজও বড় প্রাসঙ্গিক। হয়তো আজ আরও বেশি করে তাঁর অভিমানী মন, মনন আর মানসের সুলুকসন্ধান করার প্রয়োজন পড়েছে। নজরুল তাঁর জীবনের শেষ বক্তৃতায় তাঁর সকল অপ্রাপ্তির, অনাদরের, অবহেলার অনুভব থেকে এক চরম অভিমানী আত্মসমর্পণ করেছিলেন, নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছিলেন—
‘যদি আর বাঁশি না বাজে, আমি কবি বলে বলছি নে, আমি আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম, সেই অধিকারে বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন। আমায় ভুলে যাবেন।’
গভীর অভিমানে কবি আমাদের ভুলে যেতে বলেছেন তাঁকে বটে; কিন্তু আমাদের প্রাণের কবি, প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি, অভিমানী কবি নজরুলকে ভোলে, সাধ্য কার!
‘সে চলে গেছে বলে কি গো স্মৃতিও হায় যায় ভোলা
ওগো মনে হলে তারি কথা আজো মর্মে সে মোর দেয় দোলা।’
লেখক: পেশাগত জীবনে একজন শিক্ষাবিদ ড. নিরুপমা রহমান বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদে অধ্যাপনার পাশাপাশি উচ্চতর ও বৈশ্বিক শিক্ষাপদ্ধতি উদ্ভাবন আর তার প্রায়োগিক পরিপ্রেক্ষিত গবেষণায় রত আছেন। দীর্ঘদিন উপমহাদেশখ্যাত গুরুদের কাছে তালিম প্রাপ্ত নিরুপমা নিয়মিত শাস্ত্রীয় সংগীত আর বাংলা গানের নিরলস সাধনা করে চলেছেন। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা গান, তার বাণী ও সুরের মেলবন্ধনকে খুঁজে বেড়ানো, তাকে মননে ও ভাবে ধারণ করার নিরন্তর প্রয়াসই অভিবাসী জীবনে নিরুপমার বাঙালিয়ানার নিরন্তর উদ্যাপন।