
২০ জুলাই ২০২৫-এ আমরা পদার্পণ করেছি ফ্রানৎস ফানোঁর শততম জন্মবর্ষে। মনোবিজ্ঞানী, বিপ্লবী, চিন্তক এবং ঔপনিবেশিক দমন প্রতিরোধ ও প্রতিকারের অনন্য ভাষ্যকার ফ্রানৎস ফানোঁ ইতিহাসের অমোঘ আমন্ত্রণে নিজের কলমকে করেছিলেন অস্ত্র, চিন্তাকে রূপ দিয়েছিলেন লড়াইয়ের হাতিয়ারে।
পুরো আফ্রিকাসহ, আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রামের প্রেক্ষাপটে ফ্রানৎস ফানোঁর লেখাপত্র আজও বিশ্বের নানা প্রান্তে নিপীড়িত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা জোগায়। ফানোঁর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলো হলো—‘ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক’, ‘দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ’, ‘টুওয়ার্ডস আফ্রিকান রেভল্যুশন’ ও ‘ডায়িং কলোনিয়ালিজম’।
ফ্রানৎস ফানোঁ জন্মেছিলেন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ছোট্ট দ্বীপ মার্তিনিকে। মার্তিনিক তখন ফরাসিদের অধিকারে। ফানোঁ বেঁচে ছিলেন মাত্র ৩৬ বছর। এই ৩৬ বছর বয়সেই তিনি রচনা করেছিলেন অসাধারণ সব গ্রন্থ। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর মধ্যে রয়েছে—‘ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্ক’, ‘দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ’, ‘টুওয়ার্ডস আফ্রিকান রেভল্যুশন’, ‘ডায়িং কলোনিয়ালিজম’। এ ছাড়া বর্তমানে তাঁর সাইকোলজিক্যাল প্রবন্ধগুলো নিয়ে কিছু সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে। গভীর বিশ্লেষণ ও অন্তর্দৃষ্টি প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর এসব লেখায়। মোটেই স্বতঃস্ফূর্ততা বা আবেগ দিয়ে লেখেননি ফানোঁ। তাঁর লেখা, চিন্তা ও ক্রিয়াশীলতা তাঁকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বড় বিপ্লবী তাত্ত্বিক ও দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। ফানোঁর লেখা পড়লে বোঝা যায় যে আফ্রিকাকে তিনি কত কাছ থেকে, কত গভীরভাবে বুঝতেন। শুধু আফ্রিকা নয়, ফানোঁ উপনিবেশিত তৃতীয় বিশ্ব এবং এর চলার পথকে যতটা বুঝতেন, বিশ্বের আর কোনো তাত্ত্বিক বা লেখক তেমনটা বুঝতে পারেননি। ফানোঁ শুধু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, দার্শনিক বা লেখকই ছিলেন না, তিনি সশরীর শামিল হয়েছিলেন স্বাধীনতাকামী মানুষের লড়াইয়েও। আলজেরিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধে, আলজেরিয়ায় ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করেছেন তিনি। আলজেরিয়ার বিপ্লবী যোদ্ধাদের চিকিৎসা করেছেন, আলজেরিয়ার মুক্তির লড়াইকে সমর্থন করে আলজেরিয়া লিবারেশন ফ্রন্টের মুখপত্র ‘এল মুজাদ্দেদ’ নামে পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
প্রশ্ন জাগে যে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে ফানোঁ পাঠের তাৎপর্যটা কী? ফানোঁ পাঠের কোনো ফায়দা রয়েছে কি এই সময়ে? কেউ কেউ যেমন দীপেশ চক্রবর্তী, ফানোঁর চিন্তাভাবনা, দর্শন ও কাজকে ‘ইউটোপিক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ফানোঁ প্রত্যাশা করেছিলেন যে একসময়ের উপনিবেশিত দেশে ন্যায্য আর মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক। এই চাওয়া, এই লক্ষ্য হয়তো ইউটোপিক অনেকের কাছে। ফানোঁসহ জগতের আরও অনেক মানুষ যাঁরা এই মানবিক ও ন্যায্য সমাজ প্রত্যাশায় ত্যাগ ও তিতিক্ষা করেছেন, কেউ কেউ বা অনেকেই তাঁদের এই লড়াইকে বলছেন ব্যর্থ এবং অসম্ভব বা ইউটোপিক। বর্তমান সময়ের বিশ্বখ্যাত জীবিত দার্শনিক আলাঁ বাদিউ তাঁর ‘কমিউনিস্ট হাইপোথিসিসে’ বলছেন যে ব্যর্থতাই চূড়ান্ত কথা নয়। এরপরও কথা থাকে, আছে। আজ যে অঙ্ক মিলছে না, কাল যে সেটার সমাধান হবে না, এমনটা তো নয়। বাদিউ তাঁর ‘কমিউনিস্ট হাইপোথিসিসে’ দেখিয়েছেন, কীভাবে আমেরিকা বিশ্বজুড়ে কমিউনিজম ও সমতাভিত্তিক একটি ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠাকে ইউটোপিয়া, অপরাধ ও ব্যর্থ হিসেবে দেখানোর ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়েছে।
আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার সব কটি দেশই এখন ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত। তাহলে ফানোঁ কী কারণে জরুরি হতে পারে? আমি এ প্রবন্ধে বলতে চাই, ফানোঁ এই একবিংশ শতকে এসেও একসময়ের উপনিবেশিত দেশগুলোর জন্য এবং সেই সব দেশের মানুষের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপীয়দের নাগপাশ থেকে উপনিবেশিত দেশগুলো দৃশ্যত মুক্ত হলেও এসব দেশ ও দেশের মানুষের এখনো মুক্তি ঘটেনি। ফানোঁর লেখা ও কর্ম একসময়ের উপনিবেশিত দেশগুলোর, যাকে আমরা তৃতীয় বিশ্ব বলে থাকি, সত্যিকার মুক্তি ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় দিশা দেখায়।
ফ্রানৎস ফানোঁ মূলত তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ১৯৫০-এর দশকে। ফানোঁ বুঝতে পেরেছিলেন যে বিংশ শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশক আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকার দেশগুলো যে জেগে উঠবে, আফ্রিকার মানুষেরা যে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদিতার বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে লড়াই–সংগ্রামে শামিল হবে, তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, ফানোঁ সেটা আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। ১৯৬০-এর দশককে অনেকে বলে থাকেন ‘আফ্রিকার দশক’। এটা বলার কারণও রয়েছে। এর কিছুদিন পূর্বে ১৯৪৫ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরে পঞ্চম প্যান আফ্রিকান কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আফ্রিকার দেশগুলোর বি–উপনিবেশায়ন লড়াইয়ের ক্ষেত্রে এ কংগ্রেস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা ও পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৫০ সালে এশিয়া ও আফ্রিকার ২৯টি দেশ মিলে বানদুংয়ে আফ্রো-এশিয়া কনফারেন্স করেছিল। আর ১৯৫৬ সালে সুদান, তিউনিসিয়া ও মরক্কোর পরাধীন মানুষেরা জেগে উঠেছিল, লড়াই চালিয়েছিল প্রাণপণে। এরই মধ্যে ১৯৫৭ সালে প্রথম আফ্রিকান দেশ ঘানা স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর ১৯৫৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে তিউনিসিয়া। ১৯৬০ সালের মধ্যেই আফ্রিকা মহাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয় ব্রিটেন, ফ্রান্স ও বেলজিয়াম। ফানোঁ তাঁর গবেষণা ও লেখালেখি শুরু করেছিলেন তখনই, যখন সমগ্র আফ্রিকা স্বাধীনতার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষায় ফুটছিল। আফ্রিকার তখন দরকার ছিল এ রকমই একজন তাত্ত্বিক, লেখক ও কর্মীকে।
আফ্রিকার কালো মানুষদের লড়াইয়ে অবশ্য ফানোঁ ছাড়া অন্যান্য লেখকও অবদান রেখেছেন। ত্রিনিদাদে জন্ম নেওয়া আফ্রো–ক্যারিবীয় ট্রোটোস্কোপন্থী ইতিহাসবিদ ও লেখক সি এল আর জেমস ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশ হাইতিতে ফরাসি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়লাভ করা কালো আফ্রিকীয় দাসদের বীরত্বগাথা তুলে ধরে ১৯৩৮ সালে প্রকাশ করেন তাঁর ‘দ্য ব্ল্যাক জাকোবিনস’ গ্রন্থ। সি এল আর জেমসের আগে হাইতির কালো দাসদের বিদ্রোহ এবং তৎপরবর্তী হাইতি রাষ্ট্রের গঠন নিয়ে খুব একটা লেখা হয়নি। মার্ক্সবাদী লেখক এরিক হবসবম তাঁর ‘দ্য এজ অব রেভল্যুশন’, (১৭৮৯-১৮৪৮) গ্রন্থে আঠারো শতকের শেষ ভাগ থেকে উনিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বৈশ্বিক বিপ্লব–বিদ্রোহ নিয়ে লিখেছেন। এমনকি হবসবমের লেখায়ও হাইতির কালো দাসদের বিদ্রোহ গুরুত্বপূর্ণভাবে স্থান পায়নি। ফ্রানৎস ফানোঁর মতোই ক্যারিবীয় অঞ্চলে অবস্থিত ফরাসি উপনিবেশ মার্তিনিকে জন্ম নেওয়া ফানোঁর শিক্ষকস্থানীয় এমে সেজেয়ারও লিখেছিলেন উপনিবেশবাদের মিথ্যা বয়ান এবং ঔপনিবেশিক শোষণ ও নিপীড়নের কথা। এমে সেজেয়ার তাঁর ‘ডিসকোর্স অন কলোনিয়ালিজম’ গ্রন্থে নিপুণভাবে দেখিয়েছেন, ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী এবং এর সমর্থকেরা উপনিবেশবাদকে সভ্যতা ও আধুনিকতা বিস্তারের দোহাই দিয়ে জায়েজ করার যে চেষ্টা করেছেন, তা কতটা ডাহা মিথ্যা। তিনি উপনিবেশবাদের আসল রূপ উন্মোচন করেছেন। আরেক ত্রিনিদাদি প্যান আফ্রিকান নেতা ও লেখক জর্জ পাদমোরও তাঁর লেখায় আফ্রিকায় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের ফলে আফ্রিকার মানুষের ওপর যে দুর্দশা নেমে এসেছিল, তা তুলে ধরেছেন। পাদমোর তাঁর ‘দ্য লাইফ অব নিগ্রো টয়লার্স’ ও ‘হাউ ব্রিটিশ রুলস ইন আফ্রিকা’ বইতে দেখিয়েছেন যে আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক শাসন কতটা বিভীষিকাময় ছিল, কীভাবে আফ্রিকার কালো মানুষদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তাঁদের নিজেদের জমি। ফানোঁর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, ৩৮ বছর বয়সে গুপ্ত হামলায় হত্যার শিকার গায়ানিজ ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক কর্মী ওয়াল্টার রডনির কাজও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। রডনি নানাভাবে প্রভাবিত ছিলেন ফানোঁর কাজ দ্বারা। রডনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন কমিউনিস্ট রাজনীতি এবং আফ্রিকার ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কালো মানুষদের লড়াই–সংগ্রামে। রডনি অবশ্য সেজেয়ার বা ফানোঁর মতো উপনিবেশবাদের নৈতিক বা মনোজাগতিক বিশ্লেষণে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। ওয়াল্টার রডনি তাঁর ‘হাউ ইউরোপ আন্ডার ডেভেলপড আফ্রিকা’ বইয়ে সুচারুভাবে দেখিয়েছেন যে কীভাবে ঔপনিবেশিক দেশগুলোয় অনুন্নয়নের সঙ্গে বর্ণবাদের একটি গভীর সম্পর্ক ছিল। রডনি দেখিয়েছেন উপনিবেশিত দেশগুলোয়, বিশেষ করে আফ্রিকায় বর্ণবাদ সামাজিক অবিচার তৈরি করেছে। রডনি তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন, আফ্রিকার অনুন্নয়নের মূল কারণ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসন এবং পশ্চিমা দাস ব্যবসা।
নিঃসন্দেহে সি এল আর জেমস, জর্জ পাদমোর, এমে সেজেয়ার, ওয়াল্টার রডনিসহ আরও আফ্রিকান ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কালো লেখকেরা পশ্চিমা উপনিবেশবাদকে বুঝতে এবং উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে গুরুপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু আফ্রিকা তো বটেই, বিংশ শতাব্দীর সারা বিশ্বের কথা বললেও ফানোঁ এমন বুদ্ধিজীবী যিনি আফ্রিকাসহ পরাধীন দেশ ও মানুষের লড়াইয়ে দিশা জুগিয়েছেন। শুধু তা–ই নয়, যেকোনো রোগ সারানোর আগে যেমন দরকার কী রোগ হয়েছে, তা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে নির্ণয় করা, ফানোঁর কাজও শুধু পশ্চিমা উপনিবেশবাদের সমালোচনা করেই বা পশ্চিমা উপনিবেশবাদের কারণে ঔপনিবেশিক আফ্রিকার কালো মানুষদের কী ক্ষতি হয়েছিল তা উল্লেখ করেই ক্ষান্ত নয়, বরং ফানোঁ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেন দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে উপনিবেশিত মানুষের মনের মধ্যে যেসব সমস্যা তৈরি হয়েছিল, সেসবও। ফানোঁ তাঁর লেখার মাধ্যমে খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন সেই সব গোড়ামি ও কর্তৃত্ব যা উপনিবেশিত মানুষকে পরাধীন করে রাখে ও নিদারুণ শোষণ করে।
ফানোঁ তাঁর দুটি প্রধান গ্রন্থ ‘দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ’, ‘ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক’সহ অন্যান্য লেখায় অনুসন্ধান করেছেন ঔপনিবেশিক শাসন ও বর্ণবাদের রূপ এবং উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদ কীভাবে উপনিবেশিত মানুষ, এমনকি উপনিবেশ স্থাপনকারীদের মনোজগতেরও ক্ষতি করে। তিনি আরও অনুসন্ধান করেছেন যে কীভাবে এই ক্ষতি কাটিয়ে একটি মানবিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়।
১৯৫২ সালে প্রকাশিত ‘ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্কে’ ফানোঁ সাদাদের রাজ্যে সাদাদের অধীনতায় কালো মানুষদের মনোজগতের এক পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। মনোবিশ্লেষক ও তাত্ত্বিক হিসেবে ফানোঁ অ-ইউরোপীয় মানুষদের মন বুঝতে চেয়েছিলেন। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শক্তিশালী নেগ্রিচুড আন্দোলনকে ফানোঁ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন। সে সময় নেগ্রিচুড আন্দোলন নিয়ে ফানোঁর দৃষ্টিভঙ্গি অনেকেরই পছন্দ হয়নি। এমে সেজেয়ার ও লিওপোল্ড সেঙ্গরসেডোর ছিলেন নেগ্রিচুড আন্দোলনের অন্যতম মুখ্য সংগঠক। ফানোঁর কথা ছিল, আফ্রিকার কালো মানুষদের মাগরেবি আফ্রিকানদের কথাও ভাবতে হবে। প্যান আফ্রিকান আন্দোলনে মাগরেবি আফ্রিকানদের যুক্ত না করায় এবং সাদা বর্ণবাদিতার বিরুদ্ধে যেন পাল্টা বর্ণবাদ আফ্রিকানরা না করে, সে বিষয়ে তিনি নেগ্রিচুড ও প্যান আফ্রিকান নেতাদের সতর্ক করেন। ফানোঁ তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক’–এ লিখেছিলেন, ‘আমরা যাকে কালো আত্মা বলছি, তা মূলত সাদা মানুষের নির্মাণ।’ তাঁর মতে দৃশ্যত কালো মানুষদের আত্মার যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে নেগ্রিচুড আন্দোলনের তাত্ত্বিক ও লেখকেরা বন্দনা করেন, তা মূলত ইউরোপীয় ফ্যান্টাসি। ফানোঁ আরও মনে করেন, আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় সব কালো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্য প্রত্যাশা করা নেগ্রিচুড আন্দোলনের একটি বড় ভুল। ফানোঁর মতে কালো বুদ্ধিজীবীদের আফ্রিকার অতীতে না ফিরে উচিত ছিল আফ্রিকার সাধারণ কালো মানুষের জীবন পরিবর্তনে সাহায্য করা। নেগ্রিচুড আন্দোলনের সমালোচনা করলেও ফানোঁ মনে করতেন যে নেগ্রিচুড আন্দোলন আফ্রিকান বুদ্ধিজীবীদের ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ‘ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক’–এ ফানোঁ মূলত বর্ণবাদের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন, বিশেষ করে ফরাসি–ক্যারিবীয় অঞ্চলে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আলোচনা করেছেন। ফানোঁ দেখিয়েছেন যে কর্তৃত্ববাদী ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি আফ্রিকার কালো মানুষদের সংস্কৃতিকে নিচু হিসেবে দেখাত এবং আফ্রিকান কালো মানুষেরাও আফ্রিকান সংস্কৃতি ও মানুষকে খাটো করে দেখানোকে মেনে নিত। ফানোঁ ‘দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে উপনিবেশের মানুষের সংস্কৃতি অনেকটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে থাকার মতো। উপনিবেশ স্থাপনকারীরা সব রকম চেষ্টাই করে উপনিবেশিত মানুষের সংস্কৃতিকে খাটো করতে। উপনিবেশিত মানুষের সংস্কৃতিকে অসভ্য ও মূল্যবোধহীন হিসেবে উপস্থাপন করতে কোনো প্রচেষ্টাই বাদ রাখেনি উপনিবেশ স্থাপনকারীরা এবং এর সমর্থকেরা। ঔপনিবেশিক শাসকেরা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেন যে উপনিবেশিত মানুষেরা নিজেদের সংস্কৃতিকে ঘৃণা করতে শুরু করে। উপনিবেশিত মানুষের মধ্যে তখন সাদা সভ্যতা, সাদা সংস্কৃতি ও সাদা মানুষকে আঁকড়ে ধরার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। অনেকটা এ রকম যে উপনিবেশিত মানুষেরা নিজেদের সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারলে তারা পশুত্ব থেকে বের হয়ে একটি দারুণ সভ্যতায় প্রবেশ করতে পারবে। অমানুষ থেকে, পশু থেকে মানুষ হতে পারবে। ফানোঁ তাই বলেছেন, উপনিবেশবাদ উপনিবেশিত মানুষকে পশুতে রূপান্তরিত করে। উপনিবেশিত মানুষেরা তাই প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চায় সাদা সভ্যতা ও সাদা সংস্কৃতিকে। ‘ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক’ গ্রন্থে ফানোঁ বাস্তব উদাহরণ টেনে দেখিয়েছেন, উপনিবেশিত আফ্রিকায় নারীরা কীভাবে নিজেদের সাদা পুরুষদের সঙ্গে যুক্ত করতে চাইতেন, কালো আফ্রিকানদের সঙ্গ পরিহার করতেন এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন সাদা মানুষদের কাছে যাওয়ার। ফানোঁ দেখিয়েছেন, ঔপনিবেশিক সমাজ ছিল একটি কম্পার্টমেন্টালাইজড সমাজ। উপনিবেশ স্থাপনকারীরা বাস করতেন ধবধবে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন জায়গায়। আর উপনিবেশিত মানুষের স্থান হয় শহরের ময়লা–আবর্জনায় ভরা জরাজীর্ণ জায়গায়। ফানোঁ দেখিয়েছেন, উপনিবেশের জগৎ একটা মেনিকিয়ান জগতের মতো যেখানে উপনিবেশ স্থাপনকারীরা নিজেদের ঈশ্বর আর উপনিবেশিতদের শয়তান হিসেবে উপস্থাপন করে।
ফানোঁর মতে, উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহিংসতা একটি থেরাপেটিক ব্যাপার। এমন নয় যে সহিংসতা জোর করে আরোপ করা হয়। এটা আপনাআপনি এসে যায়। তবে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা খুব দীর্ঘ। ফানোঁ যেমনটা দেখিয়েছেন, উপনিবেশবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিলেও উপনিবেশিত মানুষের মুক্তি আসে না। উপনিবেশিত মানুষেরা বারবার ধোঁকা খায়। উপনিবেশ চলে গেলেও নব্য উপনিবেশবাদ জারি থাকে। আর একসময়ের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক শক্তিগুলোও ঠিক একই রকম ঔপনিবেশিক কায়দায় তাদের মানুষের ওপর শাসন ও শোষণ জারি রাখে। জাতীয় বুর্জোয়ারা জাতীয় স্বার্থ না দেখে বিদেশি নব্য উপনিবেশবাদী স্বার্থ হাসিল করার জন্য মরিয়া থাকেন। ইউরোপের উপনিবেশ থেকে সদ্য আনুষ্ঠানিক মুক্তি পাওয়া এসব দেশের মানুষের মুক্তি যে কতটা কঠিন, তা নিয়ে ফানোঁ বলেন, ‘সদ্য স্বাধীন দেশগুলো যেকোনো সময় রাষ্ট্র থেকে জাতিগত গোষ্ঠীতে এবং রাষ্ট্র থেকে উপজাতিতে ফিরে যেতে পারে; এ রকম পশ্চাদপসরণ জাতির উন্নয়ন এবং জাতীয় ঐক্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক...আমরা দেখেছি, এসব দেশের শাসকেরা (একসময়ের উপনিবেশিত অনুন্নত দেশের জাতীয় বুর্জোয়াদের) জাতিকে সংহত না করে বরং নব্য উপনিবেশবাদের মুখোশের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রাখেন এবং পুঁজিবাদের কনভেয়ার বেল্ট হিসেবে কাজ করেন।’ আফ্রিকা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের শাসকশ্রেণিগুলোর দিকে তাকালেই এই বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হবে। আফ্রিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশ উপনিবেশবাদ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্ত হলেও এখানকার সাধারণ মানুষের মুক্তি ঘটেনি। এখনো তারা শোষণ ও নিপীড়নের জাঁতাকলে পিষ্ট। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অনেক অধ্যবসায় ও ত্যাগ দরকার। ফাঁনোর মতে, একসময়ের উপনিবেশিত দেশের মানুষকে মুক্তি পেতে হলে বি–উপনিবেশায়নের লড়াইকে হতে হবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। শহরের শিক্ষিত বা আধা শিক্ষিত মানুষ থেকে গ্রামের কৃষকশ্রেণিই এখানে অগ্রগামী ভূমিকা রাখতে পারে। ফানোঁর এই প্রত্যাশিত স্বাধীনতা কোনো ক্ষুদ্র আঞ্চলিক স্বার্থে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি হলো বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, উপনিবেশবাদবিরোধী, হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট–বিরোধী। ফানোঁর এই প্রত্যাশিত স্বাধীনতা এমন একটি মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে যেখানে গরিব মানুষের মানসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক চাহিদাকে পূরণ করবে এবং মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব তৈরি করবে। ফানোঁ যেমনটা বলেছেন, ‘এই স্বাধীন সমাজে নারীকে পুরুষের সমান গুরুত্ব দিতে হবে... প্রাত্যহিক জীবনে, কারখানায়, বিদ্যালয়ে, সমাবেশে এবং সব জায়গায়। যদি জাতীয় সরকার জাতীয় হতে চায়, এটি মানুষের দ্বারা এবং মানুষের জন্য হতে হবে, বঞ্চিতদের জন্য এবং বঞ্চিতদের দ্বারা হতে হবে।’
ফানোঁ বলেছিলেন, ‘বন্ধুরা, এখনই সময় পক্ষ পরিবর্তন করার। আমাদের আচ্ছাদন করে রাখা রাতের অতিকায় চাদরকে ছুড়ে ফেলে আলোর দিকে যেতে হবে। যে নতুন দিনের সূর্যোদয় হবে, এই দিনে আমাদের অনেক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে, আলোকিত থাকতে হবে আর সংকল্পে থাকতে হবে বজ্রকঠিন।’