Thank you for trying Sticky AMP!!

আসামি শনাক্তে গাণিতিক যুক্তিবিদ্যার গুরুত্ব

সম্প্রতি বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের আমন্ত্রণে বিচার প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত বিসিএস ক্যাডারের নতুন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে কিছু বলার সুযোগ হলো, যার জন্য ওই প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাধুবাদ প্রাপ্য। সবচেয়ে ভালো লাগল এই জেনে যে সব কর্মকর্তাই আইন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতক ও উচ্চতর ডিগ্রিধারী।

যাহোক বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা সরকারি আইনজীবী সবাইকে যুক্তি দিয়ে তাঁদের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, অথবা একটি বক্তব্যে বিভিন্ন বাক্যের অসংগতি খুঁজে বের করতে হয়। সাধারণত একটি মিথ্যা বাক্য অন্য সত্য বাক্যসমূহের মধ্যে বসিয়ে দিলে অসামঞ্জস্য তৈরি হয়। সম্ভবত আইন-আদালত ও বিচারব্যবস্থায় এই বিষয়গুলো খুবই সাধারণ এবং চৌকসভাবে তা বের করা হলো এই পেশাজীবীদের একটি কাজ। বাক্যে শব্দের অবস্থা আগে-পরে করে কিন্তু অর্থের পরিবর্তন করা সম্ভব যেমনটি অব্যয় ব্যবহারের মাধ্যমেও। 

ভালো ছাত্ররা সুন্দর পোশাক পরে যথাসময়ে স্কুলে যায়। এবার এই বাক্যের বিভিন্ন শব্দের পরে ‘ও’ অব্যয়টি ব্যবহার করে যে বাক্য তৈরি হবে, তার অর্থও বিভিন্ন হবে। 

তিনি বিএ পাস এবং স্কুলের শিক্ষক। এই বাক্য মিথ্যা হলে সত্য কী? হয় তিনি বিএ পাস নন, না হয় স্কুলের শিক্ষক নন। তিনি বিএ পাস অথবা স্কুলের শিক্ষক। এই বাক্য মিথ্যা হলে সত্য কী? তিনি বিএ পাস নন এবং স্কুলের শিক্ষক নন। যা আমরা ডি মরগ্যানের সূত্র প্রয়োগ করে পাই। ডি মরগ্যানের সূত্র ব্যবহার করে আরও অনেক জটিল বাক্যের বিশ্লেষণ সম্ভব, যা এই সূত্র না জানলে সব সময় সম্ভব হবে না। আইনজীবী এবং বিচারকদের যেহেতু নানা বক্তব্য বিশ্লেষণ করতে হয়, এ জন্য তাঁদের বুলিয়ান লজিক রপ্ত করা উচিত। বুলিয়ান যুক্তি অ্যারিস্টটলের যুক্তিকে উপেক্ষা করে না বরং সম্পূর্ণ গ্রহণ করে তাকে সম্প্রসারিত করে, গাণিতিক শুদ্ধতা দেয়। 

‘যদি তুমি এই বইয়ের সবগুলো সমস্যা সমাধান করো, তাহলে তুমি গণিত শিখতে পারবে। তুমি গণিত শিখেছ।’ 

ওপরের বাক্যগুলো থেকে কী উপসংহার টানা সম্ভব? এখান থেকে কি আমরা বলতে পারি তুমি বইয়ের সবগুলো সমস্যার সমাধান করেছ? নিশ্চয়ই নয়। সব সমস্যা সমাধান করা হলো গণিত শেখার পর্যাপ্ত শর্ত, প্রয়োজনীয় নয়। 

একজন আইনজীবী কিংবা বিচারককে বাদী, বিবাদী, উকিল, সাক্ষীদের প্রদত্ত বাক্যাংশগুলোর শুদ্ধতা যাচাই করতে হয়, তার অসংগতি খুঁজে বের করতে হয়, মিথ্যা ও সত্য মিলিয়ে বললে তা বের করতে পারতে হয়। এখানেও কিন্তু বুলিয়ান লজিকের নীতিমালা ব্যবহার করে অসংগতিগুলো খুঁজে বের করতে হয়। দুটি বাক্য অসত্য হয়েও সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে। যেমন, ‘আব্রাহাম লিংকন আমার মা। আব্রাহাম লিংকন তোমারও মা।’ 

বাক্য দুটিতে কোনো অসংগতি নেই, তবে বাক্য দুটি সত্যও নয়, যেহেতু আব্রাহাম লিংকন একজন পুরুষ। তবে কোনো একটি বাক্যে যদি মা শব্দটির পরিবর্তে বাবা লেখা হতো, তাহলে অসংগতি তৈরি হতো। 

‘আমাকে নির্বাচিত করলে করের হার কমিয়ে দেব। করের হার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আমাকে নির্বাচিত করা হয়েছে।’ এখানে আমাকে নির্বাচন করা করের হার কমানোর পর্যাপ্ত শর্ত, প্রয়োজনীয় নয়। সুতরাং সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। 

দেখা যাচ্ছে আমাদের সাধারণ যুক্তি দিয়ে ওপরের বিষয়গুলোতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে একজন আসামি কিংবা বাদীর জবানবন্দি কিন্তু দু-চারটি বাক্যে সীমাবদ্ধ নয়। তার থেকে নিয়ম অনুসরণ করে অসংগতি খুঁজে বের করা সহজসাধ্য নয়। এমনকি কম্পিউটার ব্যবহার করেও অসংগতি বের করা সময়সাধ্য হতে পারে। কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভাষায়, এটিকে স্যাটিসফাইয়াবিলিটি সমস্যা বলে। 

মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা ও জনসংখ্যার দেশে কিছু দুষ্টজন নানাভাবে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ নিরীহ মানুষকে তার ন্যায্য পাওনা, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ খুঁজবেই। এর ফলে তাদের মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। আমরা যদি তাদের জবানবন্দি, বক্তব্য যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি, তাহলে নিশ্চয়ই অসংগতি খুঁজে পাব। আর এর জন্য প্রয়োজন আমাদের আইনজীবী এবং বিচারকদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন। ডিসক্রিট ম্যাথমেটিকসে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এই বিষয়ে পাঠদান করা হয়। আমার মনে হয় আইনশাস্ত্রের সিলেবাসে এ ধরনের একটি কোর্স সন্নিবেশিত করা খুবই প্রয়োজন। 

একটি সমস্যা দিয়ে লেখাটি শেষ করি, যার সমাধানে গাণিতিক যুক্তিবিদ্যার প্রয়োগের প্রয়োজন হবে। 

পুলিশ অনুমান করছে শালু, যদু ও উমেশের মধ্যে কেউ চৌধুরী সাহেবকে হত্যা করেছে। সন্দেহভাজনদের কেউ জবানবন্দি দিয়েছে যে তারা কেউ এই হত্যা করেনি। শালু বলেছে, চৌধুরী সাহেব যদুর বন্ধু ছিল এবং উমেশ তাকে অপছন্দ করত। যদু বলল, সে চৌধুরী সাহেবকে চেনে না এবং চৌধুরী সাহেবের হত্যার দিনে সে শহরেই ছিল না। উমেশ বলল, হত্যার দিন সে শালু ও যদুকে চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখেছিল এবং হয় শালু অথবা যদু অবশ্যই চৌধুরী সাহেবকে হত্যা করে থাকবে। এবার হত্যাকারীকে কি বের করা সম্ভব হবে যদি একজন দোষী হয়, দুজন নির্দোষ সত্য কথা বলে কিন্তু দোষী ব্যক্তি সত্য কিংবা মিথ্যা কথা বলতে পারে? নির্দোষ মিথ্যা কথা না বললে কি দোষীকে শনাক্ত করা সম্ভব হবে? 

বাস্তবিক পক্ষে মামলার বিষয়গুলো ওপরের সমস্যাগুলো থেকে অনেক জটিল, বাদী-বিবাদীর একজন নয়, অনেকের কথাতেই অসংগতি ছড়িয়ে পড়তে পারে, শুধু তা-ই নয়, এমনকি নিরপরাধও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অসত্য ভাষণ দিতে পারে। এই জটিল পরিস্থিতিতে সত্যানুসন্ধান আরও দুরূহ। গাণিতিক যুক্তিবিদ্যার প্রয়োগে বাস্তব পরিস্থিতি থেকে সত্যানুসন্ধান সম্ভব হলেও তত্ত্ববিহীন বিশ্লেষণ কখনো সিদ্ধান্তের প্রতি আমাদের আস্থাবান করতে পারবে না। 

পত্রিকান্তরে প্রকাশ, আমাদের দেশের মামলা-মোকদ্দমার সংখ্যার কাছে আইনজীবী এবং বিচারকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এই মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আমাদের বিচারব্যবস্থাকে যেমন কম্পিউটারায়ন করে বিচারক এবং উকিল উভয় পক্ষকেই উপাত্ত ও প্রয়োজনীয় আইনকানুনের ধারা দিয়ে সমৃদ্ধ করা উচিত, ঠিক একইভাবে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য আমাদের বিচারক ও আইনজীবীদের কোর্স কারিকুলামে গাণিতিক যুক্তিবিদ্যা যোগ করা উচিত।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস