Thank you for trying Sticky AMP!!

কোয়ারেন্টিন না মানা: দোষ কি শুধুই বাঙালির?

দোষ যেন শুধুই বাঙালির। বিশেষ করে প্রবাসফেরত বাঙালির। তাঁরা সেলফ কোয়ারেন্টিন মানছেন না, হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন, বেড়াতে বের হচ্ছেন—এগুলোই এখন সামাজিক গণমাধ্যমে সবচেয়ে আলোচিত সংবাদ। আর এসব সংবাদের নিচে কমেন্টে ঘৃণার ছড়াছড়ি, ‘বাঙালির মতো নিকৃষ্ট জাতি আর নেই, এদেরকে গুলি করে মারা উচিত, ক্রসফায়ারে দেওয়া উচিত’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এসব ঘৃণামূলক পোস্টের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাগুলো: আমাদের প্রস্তুতিতে এত ঘাটতি কেন? বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না কেন? জনসমাগমের স্থানগুলো বন্ধ করা হচ্ছে না কেন?

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশিদের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি আছে। রোগের কোনো লক্ষণ না থাকায় তাঁরা নিজেদের সুস্থ দাবি করছেন এবং সেলফ কোয়ারেন্টিনে থাকতে চাইছেন না। কিন্তু এই চিত্র কি শুধু বাংলাদেশের? মোটেও না। বিশ্বের প্রায় সব দেশে কমবেশি একই চিত্র। আমরা যে শুধু বাংলাদেশিদেরই দোষারোপ করছি, তার কারণ হচ্ছে আমাদের ‘অ্যাভেইলেবিলিটি বায়াস’। আমরা বাংলাদেশি, আমাদের পত্রিকাগুলো তাই বাংলাদেশের ঘটনাগুলোই রিপোর্ট করছে, আর সে কারণে আমাদের ধারণা হচ্ছে বিশ্বের অন্য কোথাও সম্ভবত এ ধরনের ঘটনা ঘটছে না, কেবল বাংলাদেশেই ঘটছে।

অথচ গুগলে সার্চ করলেই দেখা যাবে, তথাকথিত উন্নত বা সভ্য দেশেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। কোয়ারেন্টিন থেকে সন্দেহভাজন রোগীর পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে ফিলিপাইনে (খালিজ টাইমস, মার্চ ১৪), রাশিয়ায় (মস্কো টাইমস, ফেব্রুয়ারি ১৩) এবং যুক্তরাষ্ট্রেও (সিয়াটল টাইমস, মার্চ ১৪)। ইতালিতে ৯ জন বাংলাদেশি পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছেন; এই সংবাদ বাংলাদেশে খুব ফলাও করে প্রচারিত হলেও আড়ালে রয়ে গিয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ অন্য একটি সংবাদ। সেখানে কোয়ারেন্টিনের নির্দেশ আসতে পারে শুনে হাজার হাজার মানুষ পালাতে শুরু করে এবং দেশব্যাপী বিশৃঙ্খলা ও আতঙ্কের জন্ম দেয় (গার্ডিয়ান, মার্চ ৮)।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ অমান্য করে বাইরে ঘোরাঘুরি করা, স্কুল-কলেজ বন্ধের সুযোগে বেড়াতে যাওয়ার ঘটনাও কেবল বাংলাদেশে ঘটছে না। আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে মানুষকে দল বেঁধে বারে, ডিজে পার্টিতে, সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে দেখা গেছে (ইনসাইডার, মার্চ ১৬)। জার্মানিতেও দেখা গেছে একই চিত্র। গত সপ্তাহ পর্যন্তও বার্লিনের ক্লাবগুলোকে জমজমাট দেখা গেছে (নিউইয়র্ক টাইমস, মার্চ ১২)।

প্যানিক বায়িং এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্য মজুত করার প্রবণতাও বাংলাদেশিদের একার নয়। ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্রেও সুপার মার্কেটগুলো একনিমেষে খালি হয়ে গেছে। মানুষ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরিমাণে টয়লেট পেপার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং মাস্ক কিনে জমা করা শুরু করেছে। অস্ট্রেলিয়ায় সুপার মার্কেটের ভেতর টয়লেট পেপারের জন্য দুই নারীর মারামারির ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে গেছে (ইনডিপেনডেন্ট, মার্চ ৮)। যুক্তরাষ্ট্রে এক ব্যক্তি একাই ১৭ হাজার হ্যান্ড স্যানিটাইজার জমা করে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন (নিউইয়র্ক টাইমস, মার্চ ১৪)।

সুতরাং বাঙালি খুব খারাপ—এ ধরনের দাবির খুব জোরালো ভিত্তি নেই। নিজের ওপর বিপদ এসে না পড়া পর্যন্ত সেটাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ না করাটা যেকোনো দেশের মানুষেরই সাধারণ প্রবৃত্তি। আর সে কারণেই মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর গণসচেতনামূলক কার্যক্রম এবং আইনি ব্যবস্থা, বাংলাদেশে এ দুটোরই ঘাটতি আছে।

বাংলাদেশে সরকারের মন্ত্রীদের অতি আত্মবিশ্বাসী বক্তব্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু সেলিব্রিটি ও চিকিৎসকের বক্তব্য এবং কিছু ধর্মীয় বয়ানও এ ক্ষেত্রে ঋণাত্মক ভূমিকা পালন করেছে। অনেকেই প্রচার করেছেন, করোনা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই, এটা সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো, মৃত্যুর হার খুবই কম, ‘মাত্র ২%’, গরম পড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে, অথবা দোয়া পড়ে বের হলেই ভাইরাস পালিয়ে যাবে। তাদের এ ধরনের বক্তব্যেও অনেকে একধরনের ভ্রান্ত আত্মবিশ্বাস পেয়েছে। ব্যাপারটা হালকাভাবে নিয়েছে।

সমস্যা আছে আমাদের প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থায়, আইনে এবং আইনের প্রয়োগেও। বিশ্বের অনেক দেশই বিদেশ থেকে আসা সন্দেহভাজন রোগীদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করেছে। যাদের কোনো লক্ষণ নেই, তাদের সেলফ কোয়ারেন্টিনের পরামর্শ দেওয়া হলেও তাদের ওপর নজরদারি করেছে এবং কোয়ারেন্টিন ভঙ্গ করামাত্র গ্রেপ্তার এবং জরিমানা করেছে। এ রকম ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্র (সিএনএন, মার্চ ১৮), নিউজিল্যান্ডসহ (নিউজহাব, মার্চ ১৭) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ইতালি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র কোয়ারেন্টিন কার্যকর করার জন্য পুলিশ দিয়ে পাহারা দেওয়াচ্ছে। কোয়ারেন্টিন না মানলে জেল–জরিমানার বিধান রেখেছে।

জনগণের যত্রতত্র ঘোরাফেরা বন্ধের জন্য আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে তিউনিসিয়া। মাত্র ২৫ জন রোগী ধরা পড়ার পরেই তারা সব ধরনের জনসমাগমের স্থান বন্ধ করে দিয়েছে এবং সন্ধ্যা ছয়টা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা করেছে। আরব আমিরাত, কুয়েত, লিবিয়া, সৌদি আরবসহ (দুই পবিত্র মসজিদ ছাড়া) মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্র মসজিদগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। মুসল্লিদের ঘরে রাখার জন্য তারা আজানের মধ্যে ‘সাল্লু ফি বুইয়ুতিকুম’ তথা ‘তোমাদের ঘরে সালাত আদায় করো’ ঘোষণাটি উচ্চারণ করছে।

বিশ্বের কোনো দেশের জনগণই নিজে থেকে সম্পূর্ণ কোয়ারেন্টিন মেনে চলে না। চললে ইউরোপের ‘সভ্য’ রাষ্ট্রগুলোতে আইন প্রণয়নের দরকার পড়ত না। কাজেই এই মুহূর্তে আমাদের যেটা প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে জনগণকে দোষারোপ না করে কীভাবে তাদের মধ্যে থাকা ভুল ধারণাগুলো অপসারণ করে তাদের আরও সচেতন করে তোলা যায় এবং কীভাবে তাদের কোয়ারেন্টিনে থাকতে বাধ্য করা যায়, সে ব্যাপারে আলোচনা করা।