প্রতিবাদের ভাষা

চলমান হরতাল কি বৈধ?

বাস পুড়িয়ে হরতাল পালনের রাজনীতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে
বাস পুড়িয়ে হরতাল পালনের রাজনীতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে

একসময় হরতাল ছিল প্রতিবাদের সর্বোচ্চ ও চরম ভাষা। আর এখন ডালভাত, ‘কোনো কিছু ঘটিবামাত্র দিতে বাধ্য থাকিব’র মতো বিষয়। সঙ্গে অন্তহীন জনদুর্ভোগ, সহিংসতা, নাশকতা, ক্ষয়ক্ষতি আর অগণিত হতাহত ফ্রি। নাশকতার নমুনা হিসেবে পরিবহন খাতের সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত টানছি: হরতাল ও রাজনৈতিক সহিংসতায় গত নভেম্বর থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত সময়ে সারা দেশে প্রায় ৪০০ যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়। প্রায় তিন হাজার যানবাহন ভাঙচুর করা হয়। রেলের ওপর হয় ৯২টি হামলা। (প্রথম আলো, ২৭ মার্চ, ২০১৩)

আমরা জানি, আমাদের উচ্চ আদালত হরতালকে বৈধতা দিয়েছেন। কিন্তু হরতাল পালন-দমনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও নৈরাজ্যের যে সংস্কৃতি হরদম চলছে, তাতে উদ্ধারহীন সাধারণ মানুষের কাছে ওই বৈধতা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তাদের মনে বাজছে, উচ্চ আদালত আমাদের সর্বশেষ আশ্রয়, সেই আদালত কি এই হরতালকেই বৈধতা দিয়েছিলেন? ‘ঐতিহাসিক গণতান্ত্রিক অধিকারের’ নামে আদালত কি এই নাশকতাকেই অনুমোদন দেন? ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’র নামে আদালত কি এই জ্বালাও-পোড়াওকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন? প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা যাক।

১৯৯৯ সাল। আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায়। বিপরীতে বিএনপির নেতৃত্বে যখন তখন হরতাল, ঘেরাও আর অবরোধ কর্মসূচিতে বিপর্যস্ত জনজীবন। এরূপ পরিস্থিতিতে ১৫ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মো. গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি মো. লতিফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ক ধারাবলে একটি স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) রুল জারি করেন। পত্রিকায় প্রকাশিত হরতালের সংবাদের ভিত্তিতে করা ওই রুলে আদালত হরতালের পক্ষে ও বিপক্ষের কার্যক্রমকে আমলযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ফৌজদারি আদালত ও পুলিশকে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চান।

তার পরও ১৮ এপ্রিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল ফের হরতালের ডাক দেয়। তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তখন খন্দকার মোদারেস ইলাহী নামের এক আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। তাতে আদালত ১৩ এপ্রিল আরেকটি রুল দিয়ে হরতালকে কেন বেআইনি ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা স্বরাষ্ট্রসচিবসহ চার শীর্ষ নেতার কাছে জানতে চান।

ওই বছরের ১৩ মে শুনানি শেষে সুয়োমোটো রুলের বিষয়ে রায় হয়। রায়ে হাইকোর্ট হরতালকারী ও হরতালবিরোধীদের অপতৎপরতাকে আমলযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ গণ্য করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। রায় গড়ায় আপিলে। চূড়ান্ত রায় ২৭ নভেম্বর, ২০০৭। রায়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. রুহুল আমিনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ হাইকোর্টের রায়টি বাতিল করেন। আদালতের যুক্তি, হরতালের পক্ষে ও বিপক্ষের সহিংস কার্যক্রম প্রচলিত আইনেই দণ্ডনীয় অপরাধ, এগুলোকে নতুনভাবে অপরাধ গণ্য করে আলাদা ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন নেই।

তবে হরতালের বৈধতা প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘বলপ্রয়োগে কার্যকর যে হরতাল সহিংসতা ছড়ায়, মৃত্যু ঘটায় এবং নাগরিকের জানমালের ক্ষতি সাধন করে, সে হরতাল কেবল অবৈধই নয়, তা ঘৃণিত এবং প্রচলিত আইনে দণ্ডযোগ্য’ (অনুচ্ছেদ-৩৫)। ২৮ বিএলডি (আপিল বিভাগ) ২০০৮, পাতা ৫৪-৬০ এ সন্নিবেশিত ওই রায়ের ৪৫ অনুচ্ছেদে বিষয়টি আরও জ্বলজ্বলে: ‘বলপ্রয়োগ বা বলপ্রয়োগের ভয় কিংবা সহিংসতা বা সহিংসতার ভয় দেখিয়ে কার্যকর হরতাল কেবল অবৈধ নয়, দণ্ডবিধিসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য ফৌজদারি আইনেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’ আপিল বিভাগের ওই রায় হরতালকে গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বটে কিন্তু সেটা শর্ত সাপেক্ষে—হরতালে যোগ দিতে কাউকে জোর-জবরদস্তি বা বাধ্য করা যাবে না। হরতাল পালনে ভয় দেখানো বা ত্রাস সৃষ্টি চলবে না। হরতাল হবে অহিংস। এ কাজে শুধু উদ্বুদ্ধকরণ বা তদবির চলবে (অনুচ্ছেদ-৩৫)। অর্থাৎ কেবল তদবিরপ্রসূত অহিংস হরতালকেই আদালত এখানে গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন।

আপিল বিভাগের রায়ে এ বিষয়ে খন্দকার মোদারেস ইলাহী বনাম বাংলাদেশ [২১ বিএলডি (হাইকোর্ট বিভাগ) ২০০১, পাতা-৩৫২] মামলার প্রসঙ্গ টানা হয়। আগেই বলেছি, হরতালের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট হয়। যার রায় হয় ২৫ অক্টোবর, ২০০০ তারিখে। রায়ে হাইকোর্ট বলেন, ভয়ভীতিমুক্ত থাকলে কেবল হরতাল ডাকাটা অবৈধ নয়। কিন্তু জোরপূর্বক কার্যকর বা বাধ্যতামূলকভাবে পালন করানোর চেষ্টা করা হলে তা অবৈধ। একই সঙ্গে জনগণের ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ (অনুচ্ছেদ-১৬)।

হরতাল পালনের ধরন সম্পর্কে বলা হয়, হরতাল ডাকাটাই কেবল গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু তার পালন হবে অবশ্যই শান্তিপূর্ণ এবং বেআইনি কার্যকলাপমুক্ত (অনুচ্ছেদ-৩০)। 

হরতাল মতপ্রকাশের একটা মাধ্যম। যার সাংবিধানিক ভিত অনুচ্ছেদ ৩৯(২)(ক)। হরতালের সঙ্গে এই অনুচ্ছেদের সীমারেখা টেনে রায়ে বলা হয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপভোগ আইন আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষেই কেবল চলবে। তা ছাড়া বলপ্রয়োগ বা তার ভয় দেখিয়ে জনগণকে স্বাভাবিক কাজ-কর্ম থেকে বিরত রাখা প্রচলিত দণ্ডবিধি অনুযায়ী অপরাধ (অনুচ্ছেদ-৪৯)।

অন্যদিকে, সংবিধানে বর্ণিত সমাবেশের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৩৭) এবং সংগঠনের স্বাধীনতাও (অনুচ্ছেদ-৩৮) বারিত ও সীমাবদ্ধ প্রকৃতির অধিকার, যার আইনানুগ উপভোগের সঙ্গে হরতালের অনাচার কোনোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

সংবিধানের তৃতীয় ভাগে চলাফেরার স্বাধীনতা, পেশার স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, যোগাযোগের স্বাধীনতাসহ ১৮টি মৌলিক অধিকারের (শিরোনাম হিসেবে) কথা বলা আছে। এর মধ্যে এক হরতালের অধিকার চর্চায় জনজীবন যেভাবে বিপর্যস্ত হয় তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় সব মৌলিক অধিকারেরই কম-বেশি লঙ্ঘন ঘটে। এ বিষয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাফ কথা: ‘কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠীবিশেষের মৌলিক অধিকারের দাবির কাছে সর্বসাধারণের মৌলিক অধিকার নতজানু হতে পারে না’ [এআইআর ১৯৯৮ সুপ্রিম কোর্ট ১৮৪]।

উপরিউক্ত বিচার-বিশ্লেষণ থেকে বলা যায়, আমাদের সর্বোচ্চ আদালত কেবল অহিংস, শান্তিপূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্ত হরতালকে বৈধতা দিয়েছেন। চলমান সহিংস ও আরোপিত হরতালকে নয়। আদালত প্রয়োজনে কেবল ‘হরতাল ডাকা’কেই অধিকার হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু পালনে অশান্তিপূর্ণ ও বেআইনি কিছু যোগ হওয়ামাত্রই তা অধিকারের মুকুট হারায়। পরিণত হয় শাস্তিযোগ্য অপরাধে। অতএব, চলমান জ্বালাও-পোড়াও হরতাল কোনোভাবে সংবিধান বা উচ্চ আদালতের রায়সম্মত নয়। জনগণকে গিনিপিগ বানিয়ে হরতালের নামে যে নৈরাজ্যের চর্চা চলছে, তাও আইন অনুমোদিত নয়। তা ছাড়া রাজনৈতিক অধিকার চর্চার নামে ঘন ঘন হরতাল ডাকার সংস্কৃতিও জনগণের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

আফতাব উদ্দিন সিদ্দিকী: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

aftabragib@yahoo.com