রাজধানী ঢাকা

জটে-জ্যামে অচল জীবন

তীব্র যানজটের কবলে রাজধানীবাসী
তীব্র যানজটের কবলে রাজধানীবাসী

নেদারল্যান্ডস রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক ছিল ১০ জুলাই, বেলা তিনটার সময়, গুলশানে, তাঁর অফিসে। আমি আসাদগেটের বাসা থেকে রওনা দিলাম বেলা একটা ১৫ মিনিটে। লেক রোডটি বন্ধ (মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কারণে বন্ধ থাকে), প্রথমে হোঁচট খেলাম, ভেতরের রাস্তা ধরে যখন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের কাছে এলাম, তখন দুইটা ৩০ বাজে। আমি তো নার্ভাস হয়ে গেলাম, যে রাস্তা দিয়ে ১৫ মিনিটের কম সময়ে যাওয়া যায়, সেখানে তিন ঘণ্টা লাগবে, এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। যা হোক, মিটিং হলো ৩০ মিনিটের জায়গায় ১০ মিনিট। আরেক শুক্রবার গুলশানে আড়ংয়ের সামনে দিয়ে হাতিরঝিলের রাস্তা ধরে সোনারগাঁওয়ের সামনে দিয়ে এসে পান্থপথ দিয়ে আসাদগেটে আসব। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় রওনা দিয়ে রাত সাড়ে নয়টায় বাসায় এলাম। যাওয়ার সময় লেগেছিল মাত্র ১৫ মিনিট।
যাব এফবিসিসিআইয়ে, মিটিংয়ে। আসাদগেট থেকে রওনা দিলাম বৃহস্পতিবার দিন, যেতে লাগল দুই ঘণ্টা আর আসতে তিন ঘণ্টা। বাসায় আমার ছেলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্স পড়ছে, শেষ বর্ষে। আমার ছেলের কাছে জার্মানির এক মেয়ে এসেছে। নাম কালটেরিন। আমি এনসিসি ব্যাংকের হেড অফিসে যাব। তাকে বললাম, চলো, আমাদের কমার্শিয়াল এলাকা দেখবে। ধানমন্ডি ১৫ নম্বরে একটা কাজ সেরে ওকে নিয়ে মতিঝিলে আসতে আমাদের দুই ঘণ্টা ১০ মিনিট সময় লাগল। ও তো অস্থির। ও পড়ছে Netherlands Mustich University-তে। বাড়ি জার্মানির মিউনিখে। ওর যেতে লাগে ট্রেনে করে মাত্র তিন ঘণ্টা।
এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কালটেরিন তো খেপে আগুন। বলল, ‘তোমরা সিনিয়ররা করছটা কী এত বছরে? তোমাদের জেনারেশন তো শেষ হয়ে যাবে এই জ্যামে, এখানে কোনো ইনভেস্টর আসবে না, কোনো টুরিস্ট আসবে না, আর যারা এখানে আছে, তারাও কাজ করতে পারবে না। আমি ভাবতে পারছি না আমার পাশে অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে সাইরেন বাজাচ্ছিল, তোমাদের ইমার্জেন্সি রোডে অ্যাক্সিডেন্ট করলে গাড়ি সরাবে কে, ফায়ার হলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাবে কী করে।’ নুরুল আমিন সাহেব কিছুই বললেন না। কারণ, বারিধারা থেকে আসতে তাঁরও দুই ঘণ্টা সময় লাগে।
কালটেরিন বলবে কী; আমার প্রতিদিন রাস্তায় জ্যামে কাটে পাঁচ ঘণ্টা। বাবার বাসা ধলপুরে। আমি আসাদগেট থেকে ওই বাসায় যাই রাত ১১টার পরে বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার বাদ দিয়ে যাই। ফিরি রাত দুইটার দিকে, ফেরার সময় মাত্র ২১-২২ মিনিট সময় লাগে।
আমার অফিস, ল্যাবরেটরি সাভার ইপিজেডে। সেখানে আমার যেতে লাগে সাড়ে তিন ঘণ্টা ও আসতে লাগে চার ঘণ্টা। ধানমন্ডি অফিস থাকতে বাসা থেকে অফিসে হেঁটে গেলে মাত্র ১৫ মিনিটের রাস্তা। কিন্তু গাড়ি দিয়ে যেতে লাগে এক ঘণ্টা।
ধানমন্ডি, গুলশানকে ঢাকা শহরে ফ্ল্যাটের বস্তি বলা চলে। দিনে স্কুল, ইউনিভার্সিটি, দোকানপাট, হাসপাতাল আর রাতে সব ডাক্তারের রোগী দেখা আর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, কোনো এলাকায় শান্তি নেই। সাভার ইপিজেডের কাছে অফিস। প্রথম যখন ল্যাবরেটরি করি তখন সর্বোচ্চ ৫০ মিনিট যেতে সময় লাগত। এখন তিন থেকে চার ঘণ্টা লাগে। আমি দুই ঘণ্টা অফিস করে ওখানেই থেকে যাই।
এই জ্যামে আমার প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টা করে যায়, দুই ঘণ্টাও অফিশিয়াল কাজ করতে পারি না। আমার বয়স এখন ৫১ বছর। জীবনের প্রথম ইউনিভার্সিটি সেশন জটে পাঁচটি বছর খেয়ে ফেলল (’৭৯-৮৮), সেখানে ২৪ বছরে জীবন শুরু করার কথা, সেখানে ৩০ বছর বয়সে কর্মক্ষেত্রে এলাম, জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় চলে গেল। আবার পিএইচডি করে যখন কাজ শুরু করলাম তখন ৩৪ বছর। আমি মাত্র ১৭-১৮ বছর কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সুতরাং আমার ৩০ বছর সবচেয়ে বেশি কর্মের সময়ে আমি কাজ করার সুযোগ পেলাম মাত্র ১০ বছর (ঘুমের সময় বাদ দিয়ে)।
আমি যদি হিসাব করি, আসলে পুরো ১০ বছরও আমাকে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। প্রতিদিন দিনের বেলায় চার-পাঁচ ঘণ্টা ইলেকট্রিসিটি থাকে না। আমার ল্যাবরেটরিতে আমি বসে থাকি, জেনারেটর বেশিক্ষণ লোডও নিতে পারে না।
আমি দুঃখিত, লজ্জিত, রাগান্বিত হয়ে মাঝেমধ্যে নিজের কপাল চাপড়াই—কেন জন্মালাম এই দেশে? আমি সন্ত্রাস, ছিনতাইয়ের ভয়ে একা হেঁটে বের হতে পারি না। আমি জ্যামের জন্য সময়, তেল, গ্যাস, এনার্জি, কর্মঘণ্টা সব নষ্ট করছি। আমি বিদ্যুতের অভাবে দিনে-রাতে কোনো সময় কাজ করতে পারি না, ঘুমাতে পারি না। আমার কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা ঘুমানো দরকার।
কিন্তু যতবার বিদ্যুৎ থাকে না, সে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। সকালে ৪০ মিনিট হাঁটার কথা। আমি তাও পারি না। কী করে সম্ভব সকাল-সন্ধ্যায় ছিনতাইয়ের ভয়। ফুটপাত অসম্ভব নোংরা-দুর্গন্ধ অথবা দোকান, নির্মাণসামগ্রী, থুতু-প্রস্রাব—কী-ই বা নেই এখানে।
আমাদের আজ এই অবস্থার জন্য দায়ী কে, প্রশ্ন করুন? আমরা নিজেরাই গত ৪২ বছরে, আমরা নিজেরা এমন কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান তৈরি করতে পারিনি যে সারা দেশকে মালয়েশিয়া অথবা কলকাতা বানাবে।
আমার পাশে জ্যামের মধ্যে সোনারগাঁও মোড়ে রং সাইড দিয়ে মন্ত্রীদের গাড়ি পুলিশ হুইসেল বাজিয়ে নিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর জন্য রাস্তা আটকে যায়। ভিআইপি পাড়ায় ইলেকট্রিসিটি যায় না। সচিবালয়ে কর্তাব্যক্তিরা আসার এক ঘণ্টা আগে এসি-লাইট সব ছেড়ে রাখা হয়। তিনি এয়ারকন্ডিশন গাড়ি থেকে নেমেই যেন এয়ারকন্ডিশন অফিসে ঢুকতে পারেন। একটি মিটিংয়ে বা বাইরে গেলেও এটা বন্ধ হয় না, স্যার আবার আসবেন তো, রুমটা ঠান্ডা করতে হবে। আমরাই এর জন্য দোষী। আমরা নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ওয়াসার পানি দুর্গন্ধ, কেউ বা ঠিকমতো পানিও পায় না, গ্যাস পাওয়া যায় না। আবার কী অদ্ভুত দেশ! বৈধ গ্যাস-সংযোগ দেয় না। অবৈধ সংযোগ হলে কানেকশন দেয়। সোলার কোম্পানির হয়ে ইলেকট্রিক কর্তাব্যক্তিরা কাজ করে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে। সোলার না লাগালে ইলেকট্রিক সংযোগ দেয় না। অদ্ভুত উটের পিঠে চলছে স্বদেশ। প্রতি নির্বাচন শেষে আমরা একবার জ্বলন্ত আগুন থেকে তপ্ত কড়াইতে পড়ি। আমাদের নেতা-নেত্রী, মন্ত্রীরা, বিরোধী দল নিজেদের ছাড়া কিছু বোঝে না। আমরা জানি, সমালোচনা করি, তবু ভোট দেওয়া বন্ধ করি না। এত অসুবিধা সত্ত্বেও আমরা ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করি না। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থা দক্ষিণখানে, এয়ারপোর্টের সামনে থেকে যেতে ভাঙা রাস্তা পাড়ি দিতে আরও কত লোক প্রতিবন্ধী হয়, তবু আমরা এদের ভোট দিই, মন্ত্রী বানাই।
হীরক রাজার দেশের মতো আমাদের মগজ ধোলাই করে দুই দল নারকেলের দুই অংশের মতো আমাদের ভাগ করে ফেলেছে।
আমাকে এসএমই ঋণ দেওয়া হয় না আমার বয়স ৫০ বছর পার হয়েছে বলে। মাননীয় কর্তাব্যক্তিরা, এটাই কি আমার দোষ?
পাঠক, দুই দল নির্বাচন নিয়ে আবার খেলায় মেতেছে। এতে আপনার আমার কিছুই হবে না। ওরা নির্বাচন করুক। আমরা শুধু বলি জ্যাম ফ্রি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ দিতে পারোনি। তোমরা কেড়ে নিয়েছ আমার জীবন, আমার পরিবেশ, আমার নদী, আমার নৈতিকতা, আমার মাধুর্য ও মানবিকতা। তাহলে কেন তোমাদের আমরা ভোট দেব?
ড. ফেরদৌসী বেগম: উদ্ভিদ প্রযুক্তিবিদ, নির্বাহী পরিচালক, ডেবটেক।
ferdousi@debtec.org