কেন? কারণ, দুর্নীতির প্রভাব বুঝতে আপনাকে পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, চোখ মেলে আশপাশে একটু তাকিয়ে জ্ঞানের ব্যবহার করে নিলেই পারবেন। ধরুন, আপনার এলাকায় একটা রাস্তা হবে। রাস্তা করতে সব মিলিয়ে প্রকৃত মোট ব্যয় হবে ৫০ লাখ টাকা, যার মধ্যে ঠিকাদারের মুনাফার অংশও (ধরা যাক, সেটা মূল ব্যয়ের ওপর অতিরিক্ত ২০ শতাংশ) রয়েছে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সেই ব্যয় ধরা হবে ৬০ লাখ টাকা। কাজ দেওয়া হবে কোনো এক রাজনৈতিক নেতার আশীর্বাদপ্রাপ্ত স্থানীয় ছোটখাটো নেতাকে। যিনি কাজ বণ্টন করবেন এবং যাঁর পরামর্শে করা হবে, দুজন মিলে ১০ লাখ টাকার মালিক বনে যাবেন খুব সহজেই। এবার ছোটখাটো নেতা ১০ লাখের সঙ্গে নিজের জন্য নগদ পাঁচ লাখ টাকা যোগ করে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে সেটা দিয়ে দেবেন একজন ঠিকাদারকে। তাহলে ঠিকাদার ৬০ লাখ টাকার কাজ পাওয়ার জন্য দিলেন ১৫ লাখ টাকা।
ঠিকাদার তাঁর সঞ্চয় থেকে ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। একজন ঠিকাদার ১৫ লাখ টাকা খরচ করে যদি একটা কাজ আদায় করেন, তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি যে তিনি সেই কাজ থেকে আরও ১৫ লাখ টাকা মুনাফা আশা করেন। কারণ, তাঁর সঞ্চায়িত টাকার মূল্য, তাঁর বর্তমান শ্রম, সময়ের মূল্য—সব মিলিয়ে তিনি এটা আশা করতেই পারেন। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, তিনি ১০ লাখ টাকা মুনাফা করবেন। তাহলে মূল কাজের জন্য তিনি ব্যয় করবেন ৩৫ লাখ টাকা।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ৫০ লাখ টাকার মধ্যে প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ওপর ২০ শতাংশ অতিরিক্ত ধরা হয়েছে ঠিকাদারের লাভের জন্য। তাহলে মূল কাজের ব্যয় দাঁড়ায় ৪০ লাখ টাকার ওপরে। অর্থাৎ, ৪০ লাখ টাকার ওপরের কাজ এখন করা হবে ৩৫ লাখ টাকায়। ধরলাম, ঠিকাদার সময়মতো ৩৫ লাখ টাকায় কাজ শেষ করে সরকারকে বুঝিয়ে দিলেন। সরকার খুশি, আমাদের মধ্যে কিছু মানুষও খুশি। কারণ দুর্নীতি হলেও কাজ তো হয়েছে।
এখন যাদের কিছুটা সাধারণ জ্ঞান আছে, তাদের চোখ দিয়ে পুরো ব্যাপারটা পরখ করে দেখা যাক। চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যাক, কোথায় কোথায় দুর্নীতি হয়েছে এবং তার প্রভাব কী? দুর্নীতি এক, ৫০ লাখ টাকার প্রকল্প যখন ৬০ লাখ টাকায় ব্যয় করা হয়, তখন অতিরিক্ত ১০ লাখ টাকা আসলে কিছু প্রভাবশালী মানুষের পকেটে গেল। টাকাটা গেল সরকারের কোষাগার থেকে। জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স হিসেবে নেওয়া অর্থ কিছু মানুষ তাদের ক্ষমতার বলে নিয়ে গেল, এটার নাম দুর্নীতি। আমানতের খেয়ানত হলো, এটার নাম দুর্নীতি।
দুর্নীতি দুই, যে ১০ লাখ টাকা দুর্নীতিবাজেরা আত্মসাৎ করল, সেটা সরকারের কোষাগারে থাকলে কি করা যেত? এক হতে পারে, সরকার ১০ লাখ টাকা দামের আরেকটা উৎপাদনশীল খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রকল্প হাতে নিতে পারত। এবং সেখানে যদি দুর্নীতি রোধ করা যেত, তাতে দেশের জাতীয় উৎপাদন বাড়ত, মানুষের আয় বাড়ত। অথবা, সেই ১০ লাখ টাকা হয়তো গরিব, দুস্থ এবং গ্রামীণ বয়স্ক মহিলাদের জন্য নেওয়া প্রকল্পে ব্যয় করা যেত। তাতে সামাজিক খাতে উন্নয়ন হতো। এই যে কিছু লোকের চুরির কারণে সম্ভাব্য উন্নয়ন থেকে দেশ বঞ্চিত হলো, যা আমরা এখন চোখে দেখছি না—এটার নাম দুর্নীতি।
দুর্নীতি তিন, ৪০ লাখ টাকার ওপরে নির্ধারিত একটা প্রকল্পের জন্য ব্যয় করা হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা। তাহলে আমরা ধরে নিচ্ছি, সেই প্রকল্পের মান বজায় রাখা হয়নি। অন্যভাবে বলা যায়, রাস্তার মান ভালো হয়নি। নির্ধারিত টাকা বরাদ্দ দেওয়া সত্ত্বেও প্রকল্পের মান ঠিক না রাখার নাম হচ্ছে দুর্নীতি।
দুর্নীতি চার, প্রকল্পের মান ভালো না হওয়ার পরিণাম কী? যে রাস্তা চার বছর ব্যবহার করার জন্য বানানোর কথা, খারাপ মানের কারণে সেটা দুই বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যাবে। হয় সরকারকে আবার টাকা খরচ করে রাস্তা বানাতে হবে, অথবা খারাপ রাস্তা দিয়ে মানুষকে আরও দুই বছর চলাচল করতে হবে। যদি সরকার নতুন করে রাস্তা বানায়, তাহলে একই কাজের জন্য দুবার সরকারকে টাকা খরচ করতে হলো। এতে সম্পদের অপচয় হবে। এই টাকা অন্য খাতে খরচ করে যে উৎপাদন বাড়ানো যেত, সেখান থেকেও দেশ বঞ্চিত হচ্ছে। আর যদি রাস্তা নতুন করে না বানানো হয়, তাহলে খারাপ রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী মানুষদের উৎপাদনশীলতায় ব্যাঘাত ঘটবে, পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে। সময়ের অপচয় হবে। এ সবই দুর্নীতি!
দুর্নীতির পক্ষে সবচেয়ে পরিচিত যুক্তিটি হচ্ছে, দুর্নীতি নাকি সরকারের কাজকর্মের গতিশীলতা বাড়ায়। তাতে নাকি দ্রুত প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয় এবং উন্নয়নকাজও দ্রুত হয়। এর উত্তরে মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, দ্রুত কাজ হওয়া কি এটা নিশ্চিত করে যে, প্রকল্পের মান ঠিক ছিল? তা তো না। মান ঠিক না থাকলে কী হয়, সেটা তো একটু আগেই আলোচনা করেছি। একটা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তাহলে এসেই যায়: দ্রুত কাজের লোভে কি নিম্নমানের প্রকল্প করা ঠিক, নাকি ধীরগতিতে দুর্নীতিহীন ভালো মানের প্রকল্প করা উচিত? আমরা সকলেই বোধ হয় সব সময় পরেরটাই আশা করব।
দুর্নীতিবাজদের প্রতি সদয়বান মানুষেরা এটাও যুক্তি দেখাতে পারেন, দুর্নীতির টাকা নিয়ে তো তাঁরা কবরে যাবেন না, বরং বিভিন্ন খাতে ব্যয় করবেন। অভিজ্ঞতা আমাদের কী বলে? অধিকাংশ দুর্নীতির অর্থই চলে যায় বিদেশে। মাঝে মাঝে কিছু পাওয়া যায় তোশকের ভেতরে! অর্থনীতির মৌলিক সেক্টরের মধ্যে যায়, জমি ও ফ্ল্যাট কিনতে। আরও কিছু যায় শেয়ার মার্কেটে। ফলাফল কী? ঢাকা শহরের ফ্ল্যাটের দাম নিউইয়র্কের ফ্ল্যাটের দামের কাছাকাছি, যেখানে ঢাকা শহরের মানুষের গড় আয় নিউইয়র্কবাসীর গড় আয়ের ৫০ ভাগের এক ভাগ হবে কি না সন্দেহ! অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণে সৎ মানুষের কষ্টার্জিত আয় দিন দিন কেবল মূল্যহীন আয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে। আর শেয়ার মার্কেটের কাহিনি আর না-ই বা বললাম। সাধারণ জ্ঞান না থাকলেও এই দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে জানে, শেয়ার মার্কেট কী করে তাদের সর্বস্বান্ত করে।
এই আলোচনায় যতটা সম্ভব ব্যষ্টিক অর্থনীতিবিষয়ক চিন্তাগুলো নিয়ে কথা বলা হয়েছে। যাঁরা প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দুর্নীতির সম্পর্ক খুঁজে পান না, তাঁদের চোখ বন্ধ করে ব্যষ্টিক চিন্তাগুলোকে সামষ্টিক অর্থনীতির সঙ্গে মেলানোর জন্য পরামর্শ দিচ্ছি। তাহলে ঠিক ঠিক উত্তর মিলবে। অকারণে একই বিষয়ে পরবর্তী আরেকটা লেখার হাত থেকে মুক্তি মিলবে।
গোলাম মোর্তজা: অর্থনীতি গবেষক।