দুর্যোগ মোকাবিলায় হাসপাতালের প্রস্তুতি

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, প্রথম আলোর আয়োজনে এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও পিএসটিসির সহযোগিতায় ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় হাসপাতালের প্রস্তুতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, প্রথম আলোর আয়োজনে এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও পিএসটিসির সহযোগিতায় ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় হাসপাতালের প্রস্তুতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, প্রথম আলোর আয়োজনে এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও পিএসটিসির সহযোগিতায় ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় হাসপাতালের প্রস্তুতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

আলোচনায় সুপারিশ

* হাসপাতাল নির্মাণের সময় ফায়ার সেফটি ও বিল্ডিং কোড অনুসরণ করতে হবে

* পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতালের ক্ষেত্রে নতুন হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করতে হবে

* নিয়মিত দুর্যোগের মহড়া (মক ড্রিল) অনুশীলন করা জরুরি

* ডাক্তার ও হাসপাতালের কর্মীদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দক্ষ করে তোলা

* হাসপাতালের আইসিইউ ও সিসিইউগুলো প্রথম বা দ্বিতীয় তলায় থাকা জরুরি

* ভূমিকম্প, বন্যা, আগুন—বিভিন্ন দুর্যোগের ধরন অনুযায়ী হাসপাতালের প্রস্তুতি থাকা

* হাসপাতালের গ্যাসলাইনের প্রতি সতর্ক থাকা

* হাসপাতাল তৈরির সময় সামনে যথেষ্ট খোলা জায়গা রাখা

* প্রতিটি হাসপাতালে ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকারী যন্ত্র থাকা দরকার

* রোগীর দুর্যোগ–পরবর্তী মানসিক অবস্থার প্রতি লক্ষ রাখা জরুরি

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

আজকের আলোচনার বিষয় দুর্যোগ মোকাবিলায় হাসপাতালের প্রস্তুতি। কিছুদিন আগে সোহ্‌রাওয়ার্দী হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সৌভাগ্যক্রমে সেখানে কোনো প্রাণহানি হয়নি। হাসপাতালে থাকা রোগীদের অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

দুর্যোগ যেকোনো সময়েই হতে পারে। তার জন্য আমাদের হাসপাতালের প্রস্তুতি থাকা জরুরি। হাসপাতালে দুর্যোগে আক্রান্ত হওয়া রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে। একই সঙ্গে হাসপাতালকে দুর্যোগ থেকে রক্ষা করা জরুরি।

যেকোনো দুর্যোগে হাসপাতাল প্রশাসন যেন প্রস্তুত থাকে, সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কী উপায়ে এটা করা যায়, এ বিষয়ে আজকের আলোচনা। এখন আলোচনা করবেন আলী আহম্মদ খান।

আলী আহম্মদ খান

আলী আহম্মদ খান

বর্তমানে দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ হচ্ছে। ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক ও গ্যাসলাইন অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
হাসপাতালগুলো দুর্যোগের মধ্যে পড়লে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এমন একটি দুর্ঘটনা আমাদের উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে দিতে পারে। এ জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও জনগণকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
কিছুদিন আগে আমরা ফায়ার সেফটি পরীক্ষা করেছি। দুর্যোগ মোকাবিলায় অবস্থা অনুযায়ী হাসপাতালগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল—ঝুঁকিপূর্ণ, বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও খুবই সন্তোষজনক। এর মধে্য খুবই সন্তোষজনক অবস্থায় খুব কম হাসপাতাল পাওয়া গেছে।
দুর্যোগ মোকাবিলায় ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের একটা পরিকল্পনা আছে। সেই অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালগুলোতে দুর্যোগ মহড়ার ব্যবস্থা করা হবে। ফায়ার সার্ভিসের ৭-৮ তলা ভবন থেকে রোগী নামানোর জন্যও মই আছে। কিন্তু আমাদের হাসপাতালগুলোর সামনে পর্যাপ্ত জায়গা নেই। অগ্নিনির্বাপণের জন্য ভবনের সামনে জায়গা থাকা খুবই জরুরি।
দুর্যোগ মোকাবিলায় হাসপাতালের নিজস্ব কিছু পরিকল্পনা থাকতে হবে। আগুন লাগলে রোগীদের কীভাবে ভবন থেকে বের করে আনা যায়, কর্মচারীদেরও সে দক্ষতা থাকতে হবে। এ রকম পরিকল্পনা সফল করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা দরকার।
বর্তমানে আমরা কাঠের আসবাবের পরিবর্তে বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করি। এগুলোয় আগুন লাগলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কাঠের আসবাবে এত তাড়াতাড়ি আগুন ছড়াতে পারে না। সে ক্ষেত্রে অনেক সময় আগুন লাগলে নিরাপদে বের হওয়ার সুযোগ থাকে।

আমাদের এখানে ফায়ার সেফটি ও বিল্ডিং কোড না মানার প্রবণতা আগের তুলনায় বেড়েছে। বাসাবাড়ির নিচে গোডাউন করা হচ্ছে। সেখানে কেমিক্যাল রাখা হচ্ছে। এগুলো অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়িয়েছে।

আইসিইউ, সিসিইউগুলো নিচের তলায় রাখতে হবে, এতে আগুন লাগলে রোগীদের বের করে আনা যাবে। এ ছাড়া হাসপাতালে ফায়ার ডোর থাকতে হবে। এগুলো ধোঁয়া রোধে সক্ষম হতে হবে। হাসপাতাল সাজানোর জন্য ব্যবহৃত জিনিসপত্র সতর্কতার সঙ্গে নির্বাচন করতে হবে।

এ ধরনের জিনিস খুব দাহ্য হয়ে থাকে। অল্পতেই আগুন ধরে যায়। এদিকেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে।

ইমামুল আজম শাহী

ইমামুল আজম শাহী
বিশ্বের দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম সারিতে রয়েছে। প্রতিবছর এখানে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভূমিকম্প অন্যতম। ঢাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। এর ফলে অনেক প্রাণহানি ঘটবে। দুর্যোগের পর যারা বেঁচে থাকবে, তারা বিভিন্ন ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

জানমালের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে। অন্যান্য ভবনের মতো আমাদের হাসপাতালগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ। সেগুলো ভূমিকম্পের সময় কতটা টিকতে পারবে, সেটা ভাবার বিষয়। হাসপাতাল একধরনের বিশেষ প্রতিষ্ঠান। একে বাইরের অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করতে হয়। ওষুধ, পানি, বিদ্যুৎ বাইরে থেকে সরবরাহ করা হয়। তাই ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের ফলে বাইরের এই সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

সে সময় আমাদের হাসপাতালের সেবা দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে না। এ ছাড়া দুর্যোগের সময় সবাইকে সাহায্য করার জন্য ডাক্তার, কর্মকর্তা–কর্মচারীরা কতটুকু প্রস্তুত, তা–ও ভেবে দেখতে হবে।

ঢাকা শহরে বড় মাত্রার কোনো ভূমিকম্প হলে যেসব ভবন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে হাসপাতালগুলো অন্যতম। এর অনেক কারণ আছে৷ আমাদের হাসপাতালের ভবনগুলো অনেক ক্ষেত্রে দুর্বল। এগুলো ভূমিকম্প সহনশীল নয়। এ ছাড়া এগুলো অনেক আগের তৈরি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় একটা বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। আগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দুর্যোগ–পরবর্তী কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে আমরা দুর্যোগপূর্ব, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ–পরবর্তী কার্যক্রমকেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছি।

এটা ইতিবাচক। কিন্তু এই পরিবর্তনের ফলে গ্রাম এলাকা অনেকটা সফলতা পেয়েছে। শহরাঞ্চল তেমন সফল হতে পারেনি।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ফলে আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ করেছি। এই এলাকার আশপাশের হাসপাতালগুলোর মধ্যে একমাত্র এনাম মেডিকেল কলেজ রোগীদের চাপ নিতে সক্ষম হয়েছিল।

এ ছাড়া অন্য কোনো হাসপাতাল এই দুর্যোগে রোগীদের চাপ নিতে পারেনি। এর কারণ, তাদের সেই পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না।

এটি প্রমাণ করে, দুর্যোগের সময় রোগীদের চাপ নিতে পারার জন্য আমাদের অনেক হাসপাতালই প্রস্তুত নয়।

মনজুরুল হক খান

মনজুরুল হক খান
প্রতিটি হাসপাতালে ধোঁয়া শনাক্তকারী যন্ত্র থাকা উচিত। ধোঁয়া শনাক্তকারী যন্ত্র ভবনে ধোঁয়া হলেই সাইরেন বাজাবে। এর মাধ্যমে সবাই বের হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাবে। একই সঙ্গে ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণযন্ত্রও রাখতে হবে, আগুন লাগলেই যেন নেভানো যায়।

ঢাকা শহরের পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলা প্রয়োজন। এই জায়গায় নতুন ভবন তৈরি করতে হবে৷ ভবন তৈরি করার সময় আগুন ও ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের বিষয়ে ভাবতে হবে। এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম, এমন বাড়ি তৈরি করতে হবে। হাসপাতাল করার সময়ও এদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। হাসপাতালে আসা রোগীরা মুমূর্ষু ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। দুর্যোগের সময় তারা সাধারণ মানুষের তুলনায় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এ সময় রোগীদের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। ডাক্তার ও কর্মচারীদের এ বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে।

দুর্যোগ থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখার জন্য সচেতনতা তৈরি করা জরুরি। স্কুলপর্যায়ে বাচ্চাদের এ বিষয়ে শেখানো উচিত। এ ক্ষেত্রে জাপান আমাদের আদর্শ হতে পারে। সেখানে স্কুলে পড়তে আসা শিশুদের প্রথমেই রাস্তা পারাপার শেখানো হয়।
আমাদের দেশেও নিরাপদ থাকার সংস্কৃতি চালু করা দরকার।

নাসিমা সুলতানা

নাসিমা সুলতানা
দুর্যোগের ধরন অনুযায়ী হাসপাতালে রোগী আসবে। বন্যা হলে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হবে। হাসপাতালগুলোকে দুর্যোগের ধরন অনুযায়ী প্রস্তুত থাকতে হবে। দুর্যোগের সময় নারী ও শিশুরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। এ সময় তাদের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।

দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে আমাদের সবাইকে নিয়ম মেনে চলতে হবে। এ ছাড়া সাধারণ মানুষকে সচেতনও করতে হবে।

 দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য প্রচার–প্রচারণা চালানো দরকার। বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে দুর্যোগের পরিমাণ বাড়ছে। আগে আমরা তেমন রাসায়নিক ব্যবহার করতাম না। গ্যাস ব্যবহার করতাম না। এখন এগুলো ব্যবহারের ফলে অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা বাড়ছে।

নূর মোহাম্মদ

নূর মোহাম্মদ
আমাদের হাসপাতালের মাত্র ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত আছে। অর্থাৎ বেশির ভাগ হাসপাতালই দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত নয়। আগুন ও ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ আমাদের ভোগাতে পারে।

যারা হাসপাতালে আসে, তারা এমনিতেই কোনো সমস্যার শিকার হয়ে আসে। এর ওপর যদি আরেকটি দুর্যোগের মধ্যে পড়ে, তবে তাদের খুবই করুণ পরিণতি হতে পারে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দুর্যোগপূর্ব, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ–পরবর্তী পদক্ষেপগুলোয় সমান গুরুত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া নিয়মিত ঝুঁকির পরিমাপ–সম্পর্কিত জরিপ করতে হবে। সেই অনুযায়ী ভবনগুলো মূল্যায়ন করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলোকে আগে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের হাসপাতালগুলো কী অবস্থায় আছে, তা জানা জরুরি। সরকারি হাসপাতালে কিছুটা হলেও জায়গা আছে। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো খুবই অল্প জায়গায় গড়ে উঠছে। এগুলো হাসপাতালের উপযোগী নয়।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেকোনো ভবনই হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডসহ অন্য যেকোনো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকা দরকার।

বেসরকারি হাসপাতালগুলোর তা নেই। আমাদের নিয়মিত ‘মক ড্রিল’ (দুর্যোগ মহড়া) করা উচিত। এর মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ড থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারব।

মক ড্রিলে আমাদের অনেকেরই অনাগ্রহ রয়েছে। দেখেছি, মক ড্রিল চলাকালীন লোকজন এটাকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা আগ্রহ প্রকাশ করে না। কিন্তু মক ড্রিল হলে আমাদের তাতে অংশ নেওয়া উচিত। এতে নিজেদের দুর্যোগের সময় করণীয় সম্পর্কে সবার সক্ষমতা তৈরি হবে।

আমাদের অনেক ভবনে ধোঁয়া শনাক্তকরণ যন্ত্র নেই। পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণযন্ত্রও নেই। অনেক ভবনে মেয়াদ উত্তীর্ণ অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র ঝুলতে দেখা যায়। অনেক সময় এই যন্ত্রগুলো অব্যবহৃত থেকে যায়। আমরা মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার আগে যন্ত্রটি দিয়ে ড্রিল করে দেখতে পারি। আমাদের হাসপাতালগুলো নিবিড় পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলতে হবে।

এমন কিছু হাসপাতাল আছে, যেগুলো ভেঙে নতুন হাসপাতাল বানাতে হবে। এগুলো মেরামত করে কোনো লাভ হবে না; বিশেষ করে ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলো বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

মোস্তাক হোসেন

মোস্তাক হোসেন
সোহ্‌্‌রাওয়ার্দী হাসপাতাল এবং চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের দেখিয়েছে, অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিকম্পের মত দুর্যোগের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক প্রস্তুতি নিতে হবে। ভূমিকম্পের ফলে ঘটা অগ্নিকাণ্ড বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির জন্য দায়ী। এদিকে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।

ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো পুরান ঢাকার অনেক জায়গাতেই যেতে পারে না। সেখানকার রাস্তাগুলো খুবই সরু। এমনকি নতুন ঢাকায়ও অনেক জায়গায় যেতে পারে না। আমাদের বিকল্প উপায় খুঁজতে হবে। এখন ফায়ার বল ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র পাওয়া যাচ্ছে। আগুনে বল ছুড়ে দিলেই আগুন নিভে যাবে।

স্বয়ংক্রিয় বন্ধকরণ যন্ত্র আগুন লাগলে গ্যাসের লাইন বন্ধ করে দেয়। দুর্যোগ মোকাবিলায় এই নতুন প্রযুক্তিগুলো নিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি।

নিয়মিত দুর্যোগ মহড়া (মক ড্রিল) আমাদের অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচাতে পারে। এর মাধ্যমে হাসপাতালের ডাক্তার–কর্মচারীরা দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম হয়ে ওঠেন। সোহ্‌রাওয়ার্দী হাসপাতাল এর উদাহরণ। মক ড্রিল করার কারণে তারা সহজে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছিলেন।

রেজাউল করিম

রেজাউল করিম
দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করতে কিছু কাজ হয়েছে। ইদানীং কিছু হাসপাতালে মক ড্রিল হয়েছে। তবে তা যথেষ্ট নয়। এ বিষয়ে সরকারের আরও উদ্যোগী হতে হবে।

মক ড্রিল করার জন্য বাজেট দরকার। সেদিকেও সরকারকে লক্ষ রাখতে হবে। সরকার, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, জনসাধারণ—সবাই না চাইলে হাসপাতালের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা বাড়ানো যাবে না।

হাসপাতালগুলোর বছরে অন্তত একটি মক ড্রিল করা উচিত। দুটি করতে পারলে আরও ভালো হয়। আমাদের এখানে চিকিৎসাশাস্ত্রে ম্যাস ক্যাজুয়ালটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পড়ানো হয়। সেই অনুযায়ী অনেক ডাক্তার প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন।

এর মাধ্যমে প্রশিক্ষিত কিছু ডাক্তার বের হচ্ছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আমাদের এদিকে নজর দেওয়া উচিত। দুর্ঘটনা কখন ঘটবে, আগে থেকে কেউই আমরা এটা বলতে পারব না। কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি থাকা দরকার। তা হলে যেকোনো দুর্ঘটনা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।

সাউদিয়া আনোয়ার

সাউদিয়া আনোয়ার
বর্তমানে দুর্যোগের সংখ্যা বেড়েছে। এর ফলে দুর্যোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। আমাদের হাসপাতালগুলো এই রোগীদের সেবা দিতে কতটা প্রস্তুত?

এ ছাড়া দুর্যোগের ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। বর্তমানে রাসায়নিক দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। এই নতুন দুর্যোগগুলোও আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। এর জন্য যথেষ্ট সম্পদ, লোকবল ও অবকাঠামো দরকার, যা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের নেই। দুর্যোগের ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানসিক অবস্থারও অবনতি ঘটে।

এটা দুর্যোগের একটা বড় প্রভাব। এই মানসিক অবস্থার অবনতির ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বাভাবিক জীবনে আসতে অনেক সময় লাগে। রোগীর দুর্যোগ–পরবর্তী মানসিক অবস্থার দিকে আমাদের নজর দিতে হবে।

হাসপাতালগুলো ঠিক রাখা খুবই জরুরি। হাসপাতাল আমাদের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভূমিকম্প থেকে ভবনগুলো রক্ষা করার একটা উপায় হলো রেট্রোফিট করা। কিন্তু এটা খুবই ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া।

আমাদের এখানে যদি চার–পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে অনেক জেলা–উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে রেট্রোফিট করতে হবে। নতুন হাসপাতালগুলোর দিকে আমাদের নজর বাড়াতে হবে। ভবনগুলো বিএনবিসি কোড মেনে হচ্ছে কি না, তা আমাদের দেখতে হবে।

হাসপাতালের ভবনগুলো যেন বিএনবিসির কোড মেনে চলে, এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

উত্তম বড়ুয়া

উত্তম বড়ুয়া

দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে অন্যান্য ভবন থেকে হাসপাতাল একটু আলাদা। এ সময় দুই দিকে ভূমিকা রাখতে হয়। প্রথমত, হাসপাতালে দুর্যোগের সময় নিজেকে ঠিক থাকতে হয়।
দ্বিতীয়ত, দুর্যোগের ফলে ঘটা বিপর্যয় সামাল দিতে হয়। আগত রোগীদের চিকিৎসা দিতে হয়। সুতরাং দুর্যোগ মোকাবিলায় অন্যান্য ভবন থেকে হাসপাতালকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারি দপ্তরগুলোকে এদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। অধিকাংশ হাসপাতালে ফায়ার অ্যালার্ম ও হিট ডিটেকটর নেই। হাসপাতালে এই জিনিসগুলো রাখতে সরকারের পরিকল্পনা দরকার। এর মাধ্যমে হাসপাতালগুলোর দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা বাড়বে।

হাসপাতালে যথেষ্ট জায়গা থাকতে হবে। আগুন নেভানোর জন্য জায়গা একটা বড় বিষয়। আমাদের সোহ্‌রাওয়ার্দী হাসপাতালে পর্যাপ্ত  জায়গা ছিল। এর জন্য আগুন নেভানো সহজ হয়েছিল। ফায়ার সার্ভিস আসার আগেই আমরা আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছিলাম। আগুন লাগলে ধোঁয়া বের হওয়ার জন্য খালি জায়গা দরকার। আমাদের পর্যাপ্ত জায়গা ছিল বলেই সহজে আগুন নেভানো গিয়েছিল।

আমাদের দেশে যেকোনো দুর্যোগে সাধারণ জনগণের সাহায্য–সহযোগিতা অনুপ্রাণিত করে। জগন্নাথ হল, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আমরা সাধারণ মানুষের ব্যাপক সহযোগিতা পেয়েছি। আমাদের হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায়ও জনগণের দিক থেকে একই রকম সাড়া পেয়েছি। যেকোনো জায়গায় আগুন লাগলে সেটা যেন দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে জন্য সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসলে যেকোনো দুর্ঘটনা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।

মোতাহার হোসেন

মোতাহার হোসেন
ভূমিকম্প হলে প্রথমে লোকজন হাসপাতালে যাবে। তাই আমাদের দেখতে হবে হাসপাতালগুলো প্রস্তুত আছে কি না।]  হাসপাতালগুলোকে তাই ভূমিকম্প সহনশীল হতে হবে। এ ছাড়া দুর্যোগে আক্রান্ত বিশালসংখ্যক রোগীকে সেবা দিতেও সক্ষম হতে হবে। দেখার বিষয়, আমাদের হাসপাতালগুলোর সেই প্রস্তুতি আছে কি না।

অগ্নিকাণ্ডের ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। আগে বেশির ভাগ আগুনই শর্টসার্কিটের মাধ্যমে শুরু হতো। এরপর তা পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ত।  কিন্তু এখন বিস্ফোরণের মাধ্যমে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। বাসাবাড়ি, অফিস, যানবাহন—সব জায়গায় আমরা গ্যাসভর্তি সিলিন্ডার নিয়ে চলাফেরা করছি। এর ফলে খুব অল্প সময়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। আগের তুলনায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হচ্ছে।

ভূমিকম্প হলে আমাদের সারা শহরে আগুন ধরবে। আমাদের শহরে প্রচুর পরিমাণে গ্যাসের লাইন আছে। ভূমিকম্প হলে গ্যাসের লাইনগুলো যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়, এমন প্রকল্প অনেক আগেই নেওয়া হয়েছে। তবে এর বাস্তবায়ন হয়নি।

আমাদের কিছু হাসপাতাল আছে, যেগুলো ১৫ তলার বেশি। এসব উঁচু ভবনে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস সেখানে পৌঁছাতে পারবে না। এ ছাড়া হাসপাতালগুলোতে শক্ত গ্লাস ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো খুব সহজে ভেঙে ভেতরে ঢোকা সম্ভব নয়।

হাসপাতালে গ্যাসের বিভিন্ন লাইন থাকে। আগুন লাগলে এই লাইনের মাধ্যমে খুব সহজেই তা পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে।

মো. মোয়াজ্জেম হোসেন

মো. মোয়াজ্জেম হোসেন

নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আমরা যারা কাজ করছি, তাদের তথ্যপ্রাপ্তির কিছু সমস্যা আছে। এ ধরনের আলোচনা আমাদের তথ্যের চাহিদা পূরণ করে। এতে আমাদের নীতিমালা তৈরি করতে সুবিধা হয়। আজকের আলোচনায় অনেক সমস্যা এসেছে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে কাজ করব।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের বড় দুর্যোগগুলোর দিকে লক্ষ করলে আমরা তা বুঝতে পারি। আমাদের দেখতে হবে কীভাবে দুর্যোগ মোকাবিলা করতে পারি।

আমরা দুর্যোগ রোধ করতে পারব না, তবে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারি। মানবসৃষ্ট দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে পারি। এ জন্য সবাইকে একসঙ্গে এর মোকাবিলা করতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় হাসপাতালগুলোর নিজস্ব একটা পরিকল্পনা থাকা উচিত। সেই অনুযায়ী কাজ করা উচিত।

নিয়মিত মক ড্রিল করতে হবে। এর জন্য বাজেট দরকার। তাই হাসপাতালগুলোকে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় নিজেদের সচেতনতাও জরুরি।
আমাদের সবার দুর্যোগ মোকাবিলায় বড় ভূমিকা রয়েছে। সাধারণ মানুষ দুর্যোগ মোকাবিলায় অনেক বড় সাহায্য করে থাকে। তাই তাদের প্রশিক্ষিত করে একটা স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করা যায়।

আব্দুল কাইয়ুম

দুর্যোগ মোকাবিলায় হাসপাতালগুলোর কী ভূমিকা হওয়া উচিত, আজকের আলোচনায় সে বিষয়গুলো এসেছে। সরকারের উচিত এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। আশা করছি সরকার এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।

আজকের আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য সবাইকেপ্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

যাঁরা অংশ নিলেন

মো.মোয়াজ্জেম হোসেন: অতিরিক্ত সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়

আলী আহম্মদ খান: মহাপরিচালক, ফায়ার ব্রিগেড ও সিভিল ডিফেন্স

নাসিমা সুলতানা: অতিরিক্ত মহাপরিচালক, প্রশাসন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

উত্তম বড়ুয়া: পরিচালক, সোহ্‌রাওয়ারর্দী মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল

মনজুরুল হক খান: অধ্যাপক, পেশা ও পরিবেশ স্বাস্থ্য, নিপসম

সাউদিয়া আনোয়ার: ক্যাপাসিটি বিল্ডিং স্পেশালিস্ট, ইউএনডিপি

মোস্তাক হোসেন: হিউম্যানিটারিয়ান ডিরেক্টর, সেভ দ্য চিলড্রেন

ইমামুল আজম শাহী: কর্মসূচি প্রধান, দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ

নূর মোহাম্মদ: নির্বাহী পরিচালক, পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার

মোতাহার হোসেন: সভাপতি, ইলেকট্রনিক সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন

রেজাউল করিম: পরামর্শক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা

সঞ্চালক

আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো