
গণ-অভ্যুত্থানের পর আমরা এখন গণতন্ত্রে উত্তরণের পর্যায়ে রয়েছি। কিন্তু এ রকম পর্যায় আমরা আগেও কয়েকবার অতিক্রম করেছি; এমনকি নির্বাচনী গণতন্ত্রও টেকসই করে ফেলেছিলাম। গণতন্ত্রে উত্তরণে আমরা কেন বারবার হোঁচট খাচ্ছি, তা নিয়ে লিখেছেন কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান।
এক বছর আগে সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হলেও গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন ঘটে। এখন প্রশ্ন হলো, এই অভ্যুত্থান আমাদের কী বার্তা দিয়ে গেল?
এই অভ্যুত্থানের প্রধান বার্তা হলো, জুলুম, নির্যাতন ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ নির্মাণের জন্য গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ তৈরি করা। কিন্তু গণতন্ত্রে উত্তরণ কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে? এখানেই টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন।
২.
বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোয় স্বৈরাচার বা কর্তৃত্ববাদের যে চরিত্র ছিল, সেখানে পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। এখানে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য ছিল না। নির্বাহী বিভাগ একচ্ছত্রভাবে বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগের নিয়ন্ত্রক ছিল।
স্বৈরাচারী শাসনামলে আমিত্ব বা একক ব্যক্তির প্রাধান্য সার্বিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে নির্ধারণ করত। সংস্কৃতি কখনো কখনো রাজনৈতিক সুবিধার জন্য আরোপিত হতো। সিন্ডিকেটের হাতে ছিল সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। সমাজের বেশির ভাগ লোকের নির্লিপ্ততা এই রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছিল।
বৈষম্য একটি কাঠামোগত শব্দ এবং এটি বন্ধনীর মধ্যে আবদ্ধ। হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে দেখা যায় যে মানুষ সব সময় এই কাঠামোগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কিন্তু এই বৈষম্যবিরোধী লড়াই খুব কম সমাজেই পরিবর্তন এনেছে। আরও ট্র্যাজেডি হলো, পৃথিবীর ইতিহাসে এই ন্যায়প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইকারীদের কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে জুলুমবাজ হয়ে উঠেছে। এর ফলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই বারবার ফিরে এসেছে; এই জনপদে ‘অন্যায়’ ও ‘জুলুম’ শব্দকে ব্যবহার করে লড়াই হয়েছে অনেক আগে থেকেই।
গণতন্ত্র এখন একটি জটিল ও সংশয়পূর্ণ প্রপঞ্চে রূপ লাভ করেছে। এর প্রধান কারণ হলো, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী শক্তির সিন্ডিকেট।
এই জনপদে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আগ্রহ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি লাভের আকাঙ্ক্ষা থেকে।
বাংলাদেশে এখনো শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক চক্র, রাজনৈতিক মেরুকরণ ও জনসচেতনতার অভাবের মতো চ্যালেঞ্জগুলো রয়ে গেছে।
৩.
ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও রিফরমেশন–পরবর্তী আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অন্যায় থেকে মুক্তিলাভের সঙ্গে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে একাকার করে দেখা হয়েছে। এ কারণে বর্তমান লড়াইয়ের উত্তরাধিকার হিসেবে ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে পাঠ নেওয়া জরুরি। তবে আমরা ইতিহাসের আরেকটু পেছনে ফিরে দেখতে পারি।
মার্টিন লুথার, লেওনার্দো দা ভিঞ্চি ও ম্যাকিয়াভেলি ইউরোপীয় ধর্ম, নৈতিকতা, শিল্প ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে নতুন সভ্যতা (যাকে আমরা আধুনিক বলি) নির্মাণের যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেটা পর্যায়ক্রমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপ লাভ করে। এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ইউরোপীয়।
ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠাকারী দেশগুলোর অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা রোধ করার জন্য ক্ষমতাকাঠামোর ধারাবাহিক পরিবর্তন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হিসেবেই বিকশিত হয়েছিল। এটা পরবর্তী সময়ে ইংরেজ, ফরাসি, রুশ ও মার্কিন বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানবিকতা, সর্বজনীনতা এবং প্রান্তিক মানুষের অধিকার অন্তর্ভুক্ত করার অভিপ্রায় প্রকাশ করে এবং একটি বৈশ্বিক বন্দোবস্তে রূপ লাভ করে। এই ব্যবস্থার আবেদন বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হতে থাকে।
এখানে বলে রাখা ভালো যে বৈশ্বিকভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ ঔপনিবেশিক দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির ‘স্ট্যাটাস ক্যু’ (স্থিতাবস্থা) বজায় রাখার জন্যই। তবে শিল্পবিপ্লব, কাঁচা টাকার বিকাশ, শিল্পমুনাফায় উদ্বৃত্ত ও ব্যক্তিমালিকানার নিরাপত্তা প্রয়োজনীয়তাও এই ব্যবস্থার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় মানবতা, মানুষের অধিকার ও প্রান্তিক মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার বৈশ্বিক বন্দোবস্তের ফলে অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুধু ইউরোপ ও আমেরিকায় নয়, সদ্য স্বাধীন ঔপনিবেশিক দেশগুলোয় বিস্তৃত হতে থাকে।
৪.
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে বৈষম্য থেকে মুক্তিলাভের জন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে সমাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পুঁজিবাদে ব্যক্তিগত আয়েশ প্রাধান্য পায়, তাই সমাজতন্ত্রের তুলনায় পুঁজিবাদের প্রতি মানুষের আবেদন বেড়ে যায়।
গত শতাব্দীর ৯০-এর দশক থেকে সমাজতন্ত্র অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ফলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে, পুঁজিবাদ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র হাত–ধরাধরি করে পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত হতে থাকে এবং এটাই মানুষের মুক্তিলাভের উপায় হিসেবে গণ্য হয়ে ওঠে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে এই গণতন্ত্র বিশ্বব্যাপী একমাত্র রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ রকম প্রেক্ষাপটেই দ্য এন্ড অব হিস্টরি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান বইয়ে ফ্রান্সিস ফুকোয়ামা বলেছিলেন, গণতন্ত্রই যে শেষ কথা। যদিও চীনসহ বেশ কিছু কর্তৃত্ববাদী দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির অভূতপূর্ব বিকাশের কারণে কর্তৃত্ববাদ নাকি গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের ঝোঁক বেশি, সে বিষয়ে বারবার তাঁর মতামত পরিবর্তন করেছেন। এই প্রসঙ্গেই ফরিদ জাকারিয়া ‘ইলিবারেল ডেমোক্রেসি’র ধারণাও তুলে ধরেছেন।
গণতন্ত্র এখন একটি জটিল ও কনফিউজড (সংশয়পূর্ণ) প্রপঞ্চে রূপ লাভ করেছে। এর প্রধান কারণ হলো, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী শক্তির সিন্ডিকেট, পপুলিজমের (জনতুষ্টিবাদ) বিকাশ এবং জনতুষ্টিবাদী সরকারের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর নেক্সাস। এ ছাড়া দুর্বল ও ছোট দেশগুলোর রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর বৈশ্বিক শক্তিগুলোর পাশাপাশি আঞ্চলিক শক্তিগুলোর প্রভাব এখনো অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে ‘ডিজিটাল ডিক্টেটরশিপ’-এর অনুশীলনও প্রধান কারণ।
এসব সত্ত্বেও কিছু দেশে টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর কথা বলা যায়। তা ছাড়া ভঙ্গুর অবস্থা থেকে পূর্ণ গণতন্ত্রে প্রবেশের সাম্প্রতিক উদাহরণও আছে। এ ক্ষেত্রে চিলির কথা বলা যায়।
৫.
সার্বিকভাবে ভারতীয় ভূখণ্ডে, এমনকি বাংলাদেশ নামক এই জনপদে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আগ্রহ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে মুক্তিলাভের আকাঙ্ক্ষা থেকেই। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েমের মধ্যে দিয়ে এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি, বরং কাঠামোগত বৈষম্য নতুন রূপ লাভ করে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করলেও শাসকের চরিত্রের সামান্যই বদল হয়েছিল। এর ফলে গণতান্ত্রিক শাসনের মধ্য দিয়ে জুলুম থেকে মুক্তি পাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা, তা অধরাই রয়ে যায়।
দীর্ঘ সামরিক শাসনের অবসানের পর ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ অবস্থার পরিবর্তন প্রত্যশা করা হয়েছিল। কিন্তু সেবারও জনপ্রতিনিধিরা মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেননি, অধিকাংশ মানুষের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারেননি। তবে এটুকু হয়েছিল যে অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতাকাঠামো পরিবর্তনের একটা বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
কিন্তু সে ব্যবস্থাও বেশি দিন টেকসই হলো না। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের মধ্য দিয়ে প্রথমে একটি কর্তৃত্ববাদী এবং পরবর্তী সময়ে একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হলো। এর ফলে রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে ওঠে; চব্বিশের জুলাই-আগস্টে আমরা সেটাই প্রত্যক্ষ করি।
৬.
এখন প্রশ্ন হলো, গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পার হওয়ার পর টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্মাণের কতটা অগ্রগতি হলো? কিছুই যে হয়নি, তেমনটা বলা অন্যায় হবে। একটি কর্তৃত্ববাদবিরোধী সরকার গঠিত হয়েছে এবং এই সরকার ধীরে হলেও গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে।
টেকসই রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য কতগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং এখন ঐকমত্য কমিশন চূড়ান্তভাবে কাজ করছে। তারা একটি খসড়া তৈরি করেছে। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তি খুবই কম।
গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময় অর্থাৎ গত সেপ্টেম্বর থেকে আমি ‘টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করে আসছি। আমরা প্রায়ই টেকসই উন্নয়ন বা শাসনের কথা শুনেছি, কিন্তু টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের এখানে তেমন কোনো আলোচনা নেই।
বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গণতন্ত্রকে টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিবেচনা করেই আমাদের সামনে এগোতে হবে। টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যা দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকতে এবং মূল কার্যাবলি বজায় রাখতে পারে। এটা একই সঙ্গে সামাজিক–সাংস্কৃতিক কল্যাণ ও পরিবেশগত সুরক্ষাকে উৎসাহিত করে।
এর জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও পরিবেশগত অখণ্ডতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন। এ ছাড়া রয়েছে জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণের মতো সুশাসনের নীতিগুলো অন্তর্ভুক্ত করা; সেই সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষেত্রের মধ্যে টেকসই সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
একটি টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূলনীতি হিসেবে দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি, আন্তপ্রজন্মীয় সমতা, অভিযোজনক্ষমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতা এবং অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তির মতো বিষয়গুলো প্রাধান্য পেতে পারে। তবে একটি টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্মাণ করতে হলে এই নীতিমালার ভিত্তিতে তৈরি একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে সুশাসন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, শক্তিশালী নাগরিক সমাজ, টেকসই অর্থনৈতিক মডেল, পরিবেশ সুরক্ষা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, শিক্ষা ও সচেতনতা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপাদানও থাকতে হবে।
৭.
আমরা জানি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চারটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। আমরা বর্তমানে দ্বিতীয় স্তরে আছি। আমাদের এখানে রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে। এখন আমরা গণতন্ত্রে উত্তরণের পর্যায়ে আছি। কিন্তু এ রকম একটি পর্যায় আমরা আগেও কয়েকবার অতিক্রম করেছি; এমনকি নির্বাচনী গণতন্ত্রও টেকসই করে ফেলেছিলাম।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড বিথামের অনুমান ছিল যে পরপর তিনবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তন হলেই নির্বাচনী গণতন্ত্র টেকসই হয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রেও একটি ব্যতিক্রম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনেক তত্ত্ব ভ্রান্ত প্রমাণ করে দেশটির আবার তার পুরোনো পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, যে পর্যায় হলো গণতন্ত্রে উত্তরণের পর্যায়।
এ পর্যায়ে প্রধান কাজ হলো, যাঁরা অন্তর্বর্তী সরকারে থাকেন, তাঁরা সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। জবাবদিহির অধীন হবে, এমন একটি নির্বাচিত কর্তৃপক্ষের কাছে যত দ্রুত সম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তর করা এখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ।
তবে বাংলাদেশকে যেহেতু বারবার একই স্তর অতিক্রম করতে হচ্ছে, তাই এ দেশের জনগণ আগের মতো শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। ভবিষ্যতে আর কখনো যেন কর্তৃত্ববাদের বিকাশ না হয়, সে কারণে টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্মাণের জন্য রাষ্ট্র সংস্কারে ন্যূনতম ঐকমত্যে পৌঁছার বিষয়েও দাবি উঠেছে।
৮.
পরিবর্তনশীল সমাজে রাজনৈতিক শৃঙ্খলা কেন প্রয়োজন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন তা দ্য পলিটিক্যাল অর্ডার ইন চেঞ্জিং সোসাইটিজ বইয়ে দেখিয়েছিলেন। আমি মনে করি, স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারলে জবাবদিহির অধীন থাকবে, এমন সরকার গঠন করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান ও সদস্যদের শপথভঙ্গের জন্য কঠোর শাস্তি বাস্তবায়নের ব্যবস্থা থাকতে পারে।
তবে এখনো শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক চক্র, রাজনৈতিক মেরুকরণ ও জনসচেতনতার অভাবের মতো চ্যালেঞ্জগুলো রয়ে গেছে। গণতন্ত্রে উত্তরণের ক্ষেত্রে আমাদের মূল সমস্যা হলো ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তন। আশা করছি, এবার অন্তত গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটাতে পারব এবং জবাবদিহিমূলক শাসন নিশ্চিত করতে পারব।
● কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
*মতামত লেখকের নিজস্ব