ধর্ম

আনন্দ-বেদনার স্মারক আখেরি চাহার শোম্বা

বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের প্রতিটি কাজ মানবমাত্রেরই অনুকরণীয়। রাসুলকে ভালোবাসা ইমানের শর্ত। নবীপ্রেম মোমিনের পরিচয়।

রাসুলে করিম (সা.)-এর জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সাহাবায়ে কিরামকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নবী মোমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর এবং তাঁর পত্নীগণ তাদের মাতা।’ (সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৬)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মোমিন হবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার সন্তান অপেক্ষা, তার পিতা অপেক্ষা এবং সব মানুষ অপেক্ষা বেশি প্রিয় না হই।’ (বুখারি শরিফ, প্রথম খণ্ড, ইমান অধ্যায়, হাদিস: ১৩-১৪ ই. ফা.)।

‘আখেরি চাহার শোম্বা’ মানে শেষ বুধবার। ‘আখেরি চাহার শোম্বা’ কথাটি ফারসি। ইসলামের ইতিহাসে সফর মাসের শেষ বুধবার ‘আখেরি চাহার শোম্বা’ নামে পরিচিত। প্রসিদ্ধ মতে, দিনটি ছিল সফর মাসের ২৬ তারিখ।

বর্ণিত আছে, হজরত নবী করিম (সা.) ইহজগৎ থেকে বিদায় নেওয়ার পূর্ববর্তী সফর মাসের শেষ সপ্তাহে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর তিনি এই মাসের শেষ বুধবার কিছুটা সুস্থ হয়ে গোসল করে, কিছু পানাহার করে মসজিদে নববিতে গিয়ে নামাজের ইমামতি করেছিলেন। এতে উপস্থিত সাহাবিরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন।

নবীজি (সা.)-এর অসুস্থতা, অসুস্থতাকালীন অবস্থা, কর্ম, উপদেশ ও তিরোধান ইত্যাদি বিশদভাবে বহু হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। সেসব বর্ণনায় নির্দিষ্টভাবে দিন, তারিখ বা সময় পাওয়া যায় না। তাই তাঁর অসুস্থতা সম্পর্কে বিভিন্ন মত হয়েছে।

প্রখ্যাত তাবিয়ি ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (১৫১ হিজরি মোতাবেক ৭৬৮ খ্রিষ্টাব্দ) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে অসুস্থতায় ইন্তেকাল করেন, সে অসুস্থতার শুরু হয়েছিল সফর মাসের শেষ কয়েক দিন থাকতে, অথবা রবিউল আউয়াল মাসের শুরু থেকে।’ (আস সিরাহ আন নাববিয়্যাহ, ইবনে হিশাম, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ২৮১)।

প্রিয় নবীজি (সা.)–এর অসুস্থতা কী বারে শুরু হয়েছিল, সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। অসুস্থ অবস্থাতেই ইন্তেকালের কয়েক দিন আগে তিনি গোসল করেছিলেন বলে সহিহ্‌ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত ইমাম বুখারি (রা.) সংকলিত হাদিসেও তা উল্লেখ আছে। (ইমাম ইবনু হাজার আসকালানি, ফাতহুল বারি শরহু বুখারি, খণ্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ১৪১)।

নবী করিম (সা.)-এর এই দিনের গোসলই জীবনের শেষ গোসল ছিল। এরপর তিনি পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এই অসুস্থতাতেই তিনি ইন্তেকাল করেন। এ জন্যই এই দিনে তাঁর সর্বশেষ সুস্থতা ও গোসলস্মৃতি পালন করা হয়ে থাকে। এই দিনে অজু-গোসল করে ইবাদত–বন্দেগি করা হয় এবং নবী করিম (সা.)-এর প্রতি দরুদ শরিফ পাঠ করে সওয়াব রেছানি করা হয়। বিশেষত, নবীজি (সা.)-এর সুস্থতার খুশির স্মরণে সাহাবিগণের নীতি অনুসরণ ও অনুকরণে দানখয়রাত ও খাদ্য বিতরণ করা হয়ে থাকে।

নবীয়ে আকরাম (সা.)-এর জীবনে অনেক আনন্দের দিন বা মুহূর্ত এসেছে, যখন তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন, শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য আল্লাহ তাআলার দরবারে সিজদাবনত হয়েছেন। কোনো কোনো ঘটনায় তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবিগণও বিভিন্নভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। নবীজি (সা.)-এর সুস্থতার খুশিতে অনেক সাহাবি অনেক দানখয়রাতও করেছিলেন বলে জানা যায়।

ধর্মীয় উপলক্ষগুলো শুধু দিবস পালনেই সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নবীজি (সা.)-এর আদর্শ অনুকরণ ও অনুসরণ করতে হবে, তবেই ইমান পরিপূর্ণ হবে। রাসুলে আকরাম (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য মহব্বত করে ও আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে এবং আল্লাহর জন্য দান করে ও আল্লাহর জন্য বিরত থাকে; অবশ্যই তার ইমান পূর্ণ হলো।’ (আবু দাউদ: ৪০৬৪)।

প্রিয় নবীজি (সা.)-এর ভালোবাসায় আখেরি চাহার শোম্বা অত্যন্ত তাজিমের সঙ্গে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মাধ্যমে পালন করা হয়, যা আমাদের আমলে ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটায়। নবীজি (সা.)-এর জীবনের ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক দিকগুলো এবং তাঁর অনুপম আদর্শ সামনে নিয়ে এলে তা আমাদের সমাজ ও সভ্যতার জন্য পরম উপকারী হবে। মানুষ দুনিয়ার শান্তি ও পরকালে মুক্তির দিশা খুঁজে পাবে।

  •  মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

    smusmangonee@gmail.com