
বৃষ্টিদিনে মনে পড়ে ছোটবেলার দিনগুলোর কথা। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি বৃষ্টি পড়ছে, টিনের চালে, গাছের ডালে। সেকি ধুন্ধুমার বৃষ্টি। উঠান ভেসে যাচ্ছে পানির ধারায়। এমন অন্ধকার হয়ে আছে চারপাশ। আজ রেনি ডে। আজ আর স্কুল হবে না। তবু সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বৃষ্টি খানিকটা হয়তো ধরে এল। আম্মা রান্নাঘর থেকে ভাতের গামলা আঁচলে ঢেকে ছুটে এলেন এই ঘরে, গরম ভাত নাকেমুখে গলিয়ে একটা পলিথিন ব্যাগে বইপত্র ঢুকিয়ে মাথায় ছাতা চাপিয়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে রওনা হলাম স্কুলের দিকে। সেই স্যান্ডেল কাদা ছিটায়, প্যান্টের পেছনের দিকটায় তৈরি করে কাদার ছিট-দাগ। শ্যামাসুন্দরী খালের মুখের স্লুইসগেট বোধ হয় খুলে দেওয়া হয়েছে, পানির প্রবল স্রোত দুকূল উপচে ছুটে চলেছে। তারই মধ্যে ব্রিজ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাড়ার দুষ্টু ছেলের দল। আতিয়ার ভাই একটা ছাতা মাথায় খালের পাশে বাঁশের মাচা পেতে জাল পেতে বসে আছেন। সারা দিন বসে থাকবেন। মাছে ভরে উঠবে তাঁর খালুই। মাঠভরে বৃষ্টি। জলস্রোত নামছে নালা দিয়ে পুকুরে। আর যত ডানকিনে মাছ খলবল করে উজিয়ে উঠে ভরে ফেলেছে মাঠটাই।
বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কোনোমতে পৌঁছানো গেল স্কুলে। ক্লাসের ৫০ ছাত্রের মধ্যে হয়তো ৭ জন এসেছে।
রংপুর জিলা স্কুল ১৮৩২ সালে প্রথম স্থাপিত হয়। কড়ি-বর্গা খিলানের পুরোনো ভবন। বৃষ্টি হলে চুন-সুরকির ছাদ চুইয়ে ক্লাসরুমের ভেতরে পানি পড়ে। ক্লাসে গিয়ে দেখা গেল সব কটি বেঞ্চ ওলটানো। ‘কে করেছে?’ ক্লাসটিচার মুস্তাফিজ স্যার বেত উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। তাহের আলী উঠে দাঁড়াল। ‘আমি করেছি, স্যার।’ ‘কেন করেছিস?’ ‘স্যার, কাল বিকেলে স্কুল থেকে যাওয়ার সময় দেখলাম আকাশে মেঘ। বুঝলাম, রাতে বৃষ্টি হবে। ভাবলাম, বেঞ্চগুলো সোজা থাকলে ভিজে যাবে। তাই উল্টিয়ে রাখলাম। এত বৃষ্টি হবে, তা তো ভাবিনি।’ স্যার বেত নামিয়ে হেসে ফেলে বললেন, ‘উকিল তো ভালোই ধরছিস। যা, তোকে মাফ করি দিলাম।’
খানিক পরে চলে এল ডাবল টিফিন। আমাদের খুশি দেখে কে। তারপর ছুটির ঘণ্টা! চলো মাঠে। কাদাপানিতে ফুটবল খেলা হবে।
আহা, আমাদের শৈশব। গ্রীষ্মের তপ্ত বিকেলে একদিন আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল। তারপর বৃষ্টি নেই। আকাশে রংধনু। আর মাঠ ভরে গেল হলুদ কোলাব্যাঙে। গলার দুপাশে দুটো গোল বেলুন ফুলিয়ে তারা শুরু করল ডাকাডাকি। ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। এত ব্যাঙ কোথায় ছিল! বৃষ্টি হওয়ামাত্রই তারা কোত্থেকে কার নোটিশ পেয়ে এল ছুটে! ব্যাঙের মহাসমাবেশে পুরো মাঠ হলুদ হয়ে গেছে।
কত দিন ব্যাঙ দেখি না। কত দিন ব্যাঙের ডাক শুনি না। এই ঢাকা শহরে কি আর একটা কোলাব্যাঙও নেই? কই গেল ঢাকার ব্যাঙেরা? কীটনাশকের কারণে মরে গেল? নাকি কীটনাশকের কারণে কীটপতঙ্গ না থাকায় ব্যাঙগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেল? নাকি ব্যাঙের ঠ্যাং রপ্তানি করতে গিয়ে ব্যাঙ ধরে ধরে শেষ করে দিয়েছি?
কত দিন জোনাকিও তো দেখি না! ঢাকা শহরে কি কোথাও জোনাকি দেখা যায়! ঝিঁঝির ডাক শোনা যায়!
মনে পড়ে, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে থাকার সময়ের একটা ঘটনা। সামনে পরীক্ষা। তাই পরীক্ষা প্রস্তুতির ছুটি চলছে। সবাই দরজা-জানালা বন্ধ করে মন দিয়ে পড়ছে। রাত একটা কি দুইটা হবে। হঠাৎ শোনা গেল, নজরুল ইসলাম হল থেকে বেরিয়ে একজন শহীদ স্মৃতি হলের পেছনে ঢিল ছুড়ছে। কী সমস্যা? ব্যাঙ ডাকছে। তাই পড়াশোনায় অসুবিধা হচ্ছে। তখন দুই হলের সব ছাত্রের মনে হলো, তাই তো! ব্যাঙ ডাকছে। ব্যাঙগুলো বড় জ্বালাচ্ছে। আরও কয়েকজন পরীক্ষাতাড়িত পাগল ব্যাঙ তাড়ানোর জন্য ছুটে গেল দুই হলের মধ্যবর্তী একটুখানি খোলা জায়গাটাতে। হেই, ভাগ ভাগ। চুপ চুপ।
কোথায় গেল ঢাকা শহরের ব্যাঙগুলো? কোথায় জোনাকি? শিয়ালের ডাক শোনার প্রশ্নই আসে না এই শহরে! বেজি তবু মাঝেমধ্যে দেখা যায়। শিয়াল মোটেও দেখা যায় না।
করোনার কারণে সমুদ্রসৈকতে ভিড় কমেছে। কক্সবাজারের সৈকতেও দেখা যাচ্ছে লাল কাঁকড়া। ডলফিনও দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ঢাকা শহরে কোলাব্যাঙ নেই। ব্যাঙের ডাক নেই। জোনাকি নেই। ঝিঁঝি নেই।
আগে কৌতুক ছিল, এই শহরের বাচ্চাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, মাছ থাকে কোথায়? উত্তর: ফ্রিজে। সেদিন শুনলাম, এক বাচ্চা জানে না যে ইলিশ মাছ গোটা হয়। তার ধারণা, ইলিশ মাছ সব সময় টুকরো টুকরোই থাকে!
তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। মাছ বাজার থেকে কিনে প্রথমেই আমরা তা কাটতে বলি। আস্ত মাছ বাসায় আনলে তা কাটবে কে?
বর্ষাকালের আরেকটা স্মৃতি হলো, বাড়িজুড়ে আম আর কাঁঠালের গন্ধ। বড় বড় নীল রঙের মাছি ভনভন করছে। বাড়ির পেছনে আস্তাকুঁড়ে কাঁঠালের হলুদ ভুতি। তখন সব তরকারিতেই কাঁঠালের বিচি—কাঁঠালের বিচি ভর্তা, কাঁঠালের বিচি ভাজি, কাঁঠালের বিচি ঝিঙে দিয়ে, কাঁঠালের বিচি মাছে কিংবা মাংসে। আম আঁটি ছোড়া হচ্ছে এদিক-ওদিক। তারপর লাল লাল পাতা মেলে গজাল আমগাছের চারা। সেই চারা তুলে আম আঁটিটা দেয়ালে বা গাছের বাকলে ঘষে ওপরের কালো খোসাটা ছাড়ালেই বেরিয়ে এল হালকা সবুজ আম আঁটির ভেঁপু। চলল অবিরাম বাজানো।
এই শহরে কি কোনো বালক আর আম আঁটির ভেঁপু তৈরি করবে? এই শহরে কি কোনো বাউন্ডুলে কলাগাছের ভেলা বানিয়ে ভাসতে থাকবে বর্ষা-বিস্ফোরিত খালে?
আচ্ছা, সেসব না হয় অনেক আয়োজনের ব্যাপার! কিন্তু একটু রংধনু কি দেখা যাবে না ঢাকার আকাশে! গগনচুম্বী অট্টালিকার আড়ালে চলে গেছে আকাশ। রংধনু যে দেখব, সেই খোলা দিগন্ত কই?
আমাদের সন্তানেরা জানে, বেনীআসহকলার মানে! কিন্তু তারা কি কোনো দিন হঠাৎ আকাশে তাকিয়ে রংধনু দেখে মনের আনন্দে খিলখিল করে হেসে উঠে হাততালি দিয়ে উঠবে না?
● আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক