মে দিবস

ক্ষমা করুন, গৃহকর্মী বোনেরা

আমার এক প্রিয় অগ্রজ সহকর্মীকে দেখতে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম। ছুটির দিন থাকায় সময় তেমন একটা লাগেনি। বিশাল গেটের কোনায় গার্ডরুমের ছোট্ট জানালা দিয়ে কথা বললাম গার্ডের সঙ্গে। আমার নামধাম এবং কোন ফ্ল্যাটে কার কাছে যাব, তিনি জানতে চাইলেন। গার্ড অনবরত কাশছিলেন। কাশতে কাশতেই কোনার ছোট দরজাটা খুলে দিলেন। তাঁকে খুব অসুস্থ লাগছিল। 

আমি প্রশস্ত রিসেপশনের মাঝখানে অবস্থিত লিফটের বোতামে টিপ দিয়ে দাঁড়ালাম। চারদিকে সুন্দর সুন্দর বাহারি পাতাবাহার আর বেশ অসাধারণ কিছু ক্যাকটাস। একজন বৃদ্ধ মালি সেসব টবের গাছের পরিচর্যা করছিলেন। হঠাৎ লিফটের সুইচের ওপর একটা বিশেষ নোটিশের দিকে দৃষ্টি পড়ল। শ্বেতপাথরের দেয়ালের ওপর লেমিনেট করা কাগজে লেখা, ‘এই লিফটে কাজের লোক, ড্রাইভার ও মালি উঠতে পারবে না—কর্তৃপক্ষ’। আমি অবশ্য খুব অবাক হলাম না। আরও কয়েকটি অ্যাপার্টমেন্টে এ দৃশ্য চোখে পড়েছে।
লিফট এসে পড়েছে। ভেতর থেকে এক ভদ্রমহিলা দুজন বালক সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। একই বয়সের দুই বালকের বেশভূষায় বুঝলাম, পেছনের জন ওই বাসার ‘কাজের ছেলে’। তার কাঁধে বিশাল ভারী একটা ব্যাগ। আমি লিফটে ঢুকে গেলাম তাড়াতাড়ি। কলবেলে চাপ দিলাম নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে। আমার অগ্রজ সহকর্মী এখনো যৌথ পরিবার ধরে রেখেছেন। ছেলে-ছেলের বউ ভালো চাকুরে এবং তাঁদের এক ছেলে। আমার সঙ্গে তাঁদের সবারই কম-বেশি পরিচয় অনেক দিন ধরে। দরজা খুলছে না দেখে আবার বেলে চাপ দিতে না দিতেই হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির গৃহকর্মী দরজা খুলে দিলেন। অপরাধীর ভঙ্গিতে বললেন যে তিনি আমার সহকর্মীর শয্যা পরিষ্কার করছিলেন। আমার সহকর্মী বন্ধু আজ তিন মাস হলো স্ট্রোক হয়ে শয্যাশায়ী। তাঁকে টয়লেট বিছানায় করতে হচ্ছে। বুঝলাম, তাঁর এই নিঃসঙ্গতায় কেউ দেখতে এলে খুব খুশি হন।
তাঁর পাশের একটা চেয়ারে বসতে না বসতেই আবার কলবেল বেজে উঠল। তখন ওই গৃহকর্মী পাশের লাগোয়া বাথরুমে হাত ধুচ্ছিলেন। বেল খুব ঘন ঘন বাজতে লাগল কোনো বিরতি না দিয়েই। আমার সহকর্মীর মুখ বিরক্তিতে ভরে উঠল। যে কারোরই বিরক্তি লাগার কথা। মনে হয় ভবনে ডাকাত পড়েছে। ভেজা হাত নিয়েই দৌড়ে গেলেন সেই গৃহকর্মী। আমি তীক্ষ্ণ গলায় এক মহিলার ভর্ৎসনা শুনতে পাচ্ছিলাম দরজাটা একটু দেরিতে খোলার জন্য। গৃহকর্মীকে গাল-মন্দ করছিলেন উচ্চ স্বরে। হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন, হয়তো ঘরে অতিথি আসার কথা শুনে।
ছেলের বউ এসেছেন বুঝতে পারলাম। ছুটির দিনে কাছের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে ছেলের বউ সাপ্তাহিক বাজার করে ফিরেছেন। আমার সঙ্গে দেখা করে অতি নম্রতার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করলেন। তিনি যে এই একটু আগেই অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছিলেন, তা তাঁর মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। এরই মধ্যে পাশের ঘর থেকে এক কিশোরের চিত্কার শুনতে পেলাম ‘মর্জিনা, মর্জিনা’ বলে। ছেলের বউ অভিযোগের সুরে আমাকে বলতে লাগলেন, মর্জিনা তাঁদের বাবুর্চি। সকাল ১০টা হয়ে গেল, তাঁর ছেলের ঘরে এখনো নাশতাই দেওয়া হয়নি।
‘মর্জিনা, মর্জিনা’ ডাক শুনে ‘সিনড্রেলা’ কার্টুনের দুষ্ট দুই বোনের কণ্ঠের ‘সিনড্রেলা, সিনড্রেলা’ আমার কানে বাজছিল! হঠাৎ আমার বন্ধুর চোখ দিয়ে পানি পড়তে দেখে মনটা খুব ভারী হয়ে গেল। ছেলের বউ সলাজ ভঙ্গিতে আমার পরিবারের সবার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। আমি হুঁ, হ্যাঁ ছাড়া কেন জানি কিছু বলতে পারছিলাম না। সঙ্গে সঙ্গেই মর্জিনার সঙ্গেও দেখা হয়ে গেল। বড় একটা ট্রে নিয়ে তিনি ঘরে ঢুকলেন। আমাকে চা-শিঙাড়া দিয়ে দ্রুত প্রস্থান করছিলেন। বুঝলাম, পাশের ঘরে গরম-গরম নাশতা নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর দিকে ছেলের বউয়ের কটমট চাহনি না দেখে উপায় ছিল না। দরজার কাছে মর্জিনার মাথায় হাত দিয়ে জোরে চাটি মেরে বললেন, ‘বেয়াদব, এত সময় লাগে?’


আমরা সবাই বলি, ‘ঘর থেকেই সব শুরু।’ এটাও সত্য যে মূলত ঘর থেকেই আদর্শ মানুষ হয়। আবার দানবেরাও এই ঘরেরই সৃষ্টি। সন্দেহ নেই; ‘সুশাসন থেকে গণতন্ত্রের’ জন্মও এই ঘর থেকেই। ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’য় অপেক্ষাকৃত প্রত্যেক সুবিধাভোগীর ঘরে ‘সাহায্যকর্মীরা’ সর্বক্ষণ কাজে ব্যস্ত। তাঁদের কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আমরা অনেকেই আন্দোলন করে আসছিলাম তাঁদের ‘শ্রমিক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। প্রায় দেড় বছর হলো সরকার এই সুকর্মটি পাস করেছে। সন্দেহ নেই, বাস্তবে এর প্রয়োগ শুরু হতে আরও সময় লাগবে। তবে ‘শুরু’ যে হয়েছে, এটাই বড় প্রাপ্তি।
স্বাধীনতার পর দেখা গেছে, কম করে হলেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৯৮০ জন গৃহকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। গত দেড় বছরেও এর ধারাবাহিকতা কমেনি। এখনো তাঁরা আধুনিক ক্রীতদাসের মতো এই অঞ্চলে বাস করেন। এখনো নির্যাতনের মাত্রা তেমন কিছুই কমেনি। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য আমাদের মানসিকতা বদলানো খুব জরুরি।
মহান মে দিবসের প্রাক্কালে সব সুবিধাভোগীর পক্ষ থেকে আমি তাঁদের বলতে চাই, ‘আমরা আপনাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী’, সুদিন আপনাদের একদিন আসবেই।

রুবায়ুল মোর্শেদ: স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ।