ট্রাম্পকে পরমাণু চুক্তি মানাতে পারবে ইউরোপ?
সম্প্রতি জার্মানির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, যে যে অঞ্চল থেকে বিশ্বব্যাপী পরমাণু যুদ্ধের দাবানল ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ‘দাহ্য’ হলো ইরান। ইরান থেকে যেকোনো সময় পরমাণু অস্ত্রের আগুন জ্বলে উঠতে পারে। সেই আগুন ঠেকানোর সর্বশেষ সুরক্ষা দেয়াল হলো পরমাণু চুক্তি। ওই কর্মকর্তার ভাষায় হয়তো একটু বাড়াবাড়ি আছে। কিন্তু ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করার মধ্য দিয়ে যে নিরাপত্তা দেয়াল তোলা হয়েছে এবং যার জন্য জার্মান এবং ইউরোপীয়রা গর্ব করে থাকেন, তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো শিগগিরই ভেঙে ফেলতে যাচ্ছেন। এটিই এখন ইউরোপের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইউরোপীয় নেতারা গত জানুয়ারি থেকে চাপে রয়েছেন। ওই মাসে ট্রাম্প তাঁদের ‘ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তির ভয়ানক ত্রুটি চিহ্নিত করার জন্য’ ১২ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। এই সময়ের মধ্যে তা করা না হলে তিনি ইরানের ওপর আবার অবরোধ আরোপ করবেন বলে হুমকি দেন। এই চুক্তির বিষয়ে ট্রাম্পের প্রধান আপত্তিগুলো হলো: মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অসদাচরণ বন্ধ ও দেশটির দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কার্যক্রম ঠেকানোর বিষয় চুক্তিতে উল্লেখ নেই এবং ২০২৫ সালের পর ইরানের পরমাণু কার্যক্রম পুনরায় চালু করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞাও এই চুক্তিতে রাখা হয়নি। অর্থাৎ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ২০২৫ সালের পর ইরান চাইলে আবার পরমাণু কার্যক্রম চালাতে পারবে।
এখন ট্রাম্প জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে জন বোল্টন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মাইক পম্পেওকে নিয়োগ করার মাধ্যমে বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে সামরিক শক্তি প্রয়োগের পক্ষপাতী একটি টিম দাঁড় করিয়েছেন। এটি ইউরোপীয় কূটনীতিকদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করেছে। ট্রাম্পকে শান্ত করার জন্য গত কয়েক মাসে জার্মান, ফরাসি ও ব্রিটিশ সরকার তাড়াহুড়ো করে ইরানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কিছু পদক্ষেপের একটি গুচ্ছ প্রস্তাব তৈরি করেছে। এসব প্রস্তাবের মধ্যে ইরানের অভিজাত ব্যক্তিদের ওপর বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও বলা আছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এবং জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ওয়াশিংটন সফর করে ট্রাম্পকে বুঝিয়েও এসেছেন যে, চুক্তিটি না ভেঙে এটি অব্যাহত রাখাই ঠিক হবে।
ইউরোপীয় নেতারা আশা করছেন, তাঁরা যে শাস্তিমূলক প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটিকে দেখে ট্রাম্প চুক্তিতে থেকেও নিজেকে জয়ী ভাবতে পারবেন। তাঁরা ট্রাম্পকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) থেকে যুক্তরাষ্ট্রের একপক্ষীয়ভাবে বেরিয়ে যাওয়া না-যাওয়ার ওপর উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক উপায়ে সমস্যা সমাধান করার বিষয়টি নির্ভর করেছে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, ইরাক যুদ্ধ শুরুর ১৫তম বার্ষিকীর মধ্যে ইরান ইস্যুটি সামনে এল। ইরাক যুদ্ধ ইউরোপীয়দের কাছে ছিল শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়। ইরাক যুদ্ধ নিয়ে তখন যুক্তরাষ্ট্র যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল, তার ওপর ইউরোপীয় কোনো নেতার হাত ছিল না। তারপরও এই যুদ্ধ সমর্থন বা এর বিরোধিতা করা নিয়ে তাদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছিল। কিন্তু জেসিপিওএ আলাদা বিষয়। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ইউরোপীয় নেতাদের প্রাধান্য ছিল। এটিকে ইউরোপের আধুনিক কালের সবচেয়ে উজ্জ্বল সাফল্যের একটি হিসেবে ধরা হয়। ইরাক যুদ্ধের মতো মধ্যপ্রাচ্যে যাতে আবার কোনো অঘটন না ঘটে, সে জন্য ইউরোপীয় নেতারা নিজেদের স্বার্থেই ২০০৫ সাল থেকে কাজ শুরু করেন। ইরানকে পরমাণু অস্ত্র বানানো থেকে বিরত রাখা এবং আরেকটি যুদ্ধ এড়ানোর জন্য তাঁরা একটি গুচ্ছ প্রস্তাব দেন। সেখানে ইরানকে অর্থনৈতিক প্রণোদনা দিয়ে খুশি করার চেষ্টা করা হয়। একই সঙ্গে ইরানের ওপর শাস্তি আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করার চেষ্টা করা হয়।
ইউরোপীয় কূটনীতিকেরা ইরানকে দুটির যেকোনো একটি বিষয়কে বেছে নিতে বলেন: ইরানকে হয় তার পরমাণু কার্যক্রম স্থগিত করে তার ওপর আরোপিত আন্তর্জাতিক অবরোধ থেকে মুক্ত হতে হবে; নয়তো পরমাণু কার্যক্রম অব্যাহত রেখে নতুন আরও অবরোধ, এমনকি যুদ্ধের মুখে পড়তে হবে। ইউরোপীয়রা চীন ও রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে ঠিক একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে দুটির একটি পথ বেছে নিতে বলেন। তাঁরা বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে নেওয়া ইউরোপের উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রকে হয় শামিল হতে হবে, নয়তো ইরানের বিরুদ্ধে তাকে একাই ব্যবস্থা নিতে হবে; সে ক্ষেত্রে ইউরোপের কেউ তার সঙ্গে থাকবে না।
এখন ইউরোপীয় নেতারা মধ্যপ্রাচ্যে যেসব লক্ষ্য অর্জনে মরিয়া হয়েছেন সেগুলো হলো, এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ইরান ও সৌদি আরবের রশি–টানাটানির মাত্রা কমিয়ে আনা; পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার রোধ, সন্ত্রাস দমন এবং ইউরোপে শরণার্থীদের স্রোত থামিয়ে দেওয়া। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেই লক্ষ্য অর্জনের পথকে দুর্গম করে দিয়েছে। ইয়েমেন, ইরাক, লেবানন ও সিরিয়ায় চলমান লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং ইরানবিরোধী দেশ সৌদি আরব ও ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইরানবিরোধী এই অবস্থান ইউরোপের লক্ষ্য অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করছে। ইইউ সদস্যদেশগুলোর অনেক কূটনীতিকের আশঙ্কা, ট্রাম্পকে শান্ত করতে গিয়ে তাঁদের যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রকারান্তরে মাথা নোয়াতে হবে। এর ফলে ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যে ধরনের সম্পর্ক ছিল, তার পুনরাবৃত্তি হবে। একজন কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, ট্রাম্পের মাথা ঠান্ডা করতে গিয়ে ইইউ যদি এখন ইরানের ওপর নতুন অবরোধ চাপিয়ে দেয়, তাহলে ইরানকে জেসিপিওএ চুক্তির প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল রাখা খুবই কঠিন হবে।
ইইউ সতর্কভাবে দুই কুলই রক্ষা করতে চাইছে। তারা ট্রাম্পেরও মন জয় করতে চাইছে; ইরানকেও চুক্তিতে আবদ্ধ রাখতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে তাকে সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। ইউরোপীয়রা যদি ট্রাম্পকে প্রাপ্যের চেয়ে বেশি দিয়ে ফেলেন, তাহলে তাঁদের কট্টর মার্কিনদের হাতের পুতুল হতে হবে। একই সঙ্গে এতে ইরানের কট্টরপন্থীরাও শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
ইউরোপীয় নেতাদের উচিত হবে ট্রাম্পকে যথাসম্ভব বোঝানো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি তিনি কারও কথা না শোনেন এবং চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে চান, তাহলে ট্রাম্পকে ছাড়াই চুক্তিটি রক্ষা করার পথ খুঁজতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
মার্ক লিওনার্ড ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক
আরও পড়ুন
-
পৃথিবীর কোন দেশে সেন্ট্রাল ব্যাংকে ঢুকতে পারছে অবাধে: ওবায়দুল কাদের
-
পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদীশাসনে হাজার কোটি টাকা বাড়তি চায় চীনা ঠিকাদার
-
রাঙামাটিতে এলোপাতাড়ি গুলিতে ইউপিডিএফের কর্মীসহ দুজন নিহত
-
বিশ্বের সেরা এয়ারলাইনস আট মাসের বেতনের সমান বোনাস দিচ্ছে
-
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সিরিজের ভেন্যুতে ঝড় বয়ে গেছে