Thank you for trying Sticky AMP!!

ঠ্যাং ছেড়ে লাঠি ধরা বাঙালির বৈশিষ্ট্য

গত হপ্তায় সোনাদানাবিষয়ক এক খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরদিন তার প্রতিক্রিয়ায় প্রতি খবর সব মিডিয়ায় আসে। সে সম্পর্কে কোনো মাধ্যম আমার মতামত জানতে চাইলে আমি বলেছিলাম, এসব বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই।

সাংবাদিক জানতে চান দায়ী ব্যক্তিরা ধরা পড়বে কি না এবং ধরা পড়লেও শাস্তি পাবে কি না? আমি বলেছিলাম, ‘অসম্ভব!’ একালে বাংলায় সাধারণত চোর ধরা যায় না। চোরের ঠ্যাং মনে করে ধরা হয় চোরের লাঠি।

একসময় সিঁধেল চুরিটা ছিল বঙ্গের বৈশিষ্ট্য। ঘরের দাওয়ায় সিঁধ কেটে চোর ঘরে ঢুকত। আমাদের ছেলেবেলায় আমরা গ্রামে সেটা খুব দেখেছি। এখন বিত্তশালী বাংলায় প্রায় সব ঘরের দাওয়াই পাকা, খন্তা দিয়ে সিঁধ কাটার জো নেই। যাহোক, সেকালে সিঁধ কেটে চুরি করতে গিয়ে কোনো কোনো হতভাগা চোর ধরাও পড়ত। ঘরের লোক ঘুম থেকে জেগে উঠলে চোর সিঁধ দিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইত। ঘরের লোক চোরের ঠ্যাং ধরতে চাইত। কখনো দেখা যেত চোরের ঠ্যাং ছেড়ে ধরে ফেলেছে তার লাঠি। চোর দ্রুত পালিয়ে যেত। কলিকালে আমাদের রাষ্ট্র প্রায় সব ক্ষেত্রেই চোরের ঠ্যাং ছেড়ে দিয়ে চোরের লাঠি শক্ত করে ধরে।

বড় নেতাদের অন্তর্জ্ঞান অসামান্য। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে বলেছিলেন, সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। সোনা এবং চোর শব্দ দুটি আজ বাংলাদেশে বহু ব্যবহৃত।

বঙ্গবন্ধু দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন একদিন তাঁর প্রিয় দেশে শুধু টাকা এবং ডলার নয়, উত্তম উপায়ে সোনাও উধাও বা চুরি হবে এবং চুরির জন্য এখন আর ঘরে সিঁধ কাটার প্রয়োজন হয় না। এখন ঘরের ভেতরে বসেই অলৌকিকভাবে পছন্দের বস্তু অপহরণ করা সম্ভব।

অন্য কোনো ভাষায় সম্ভবত নেই, শুধু বাংলাতেই প্রবাদ আছে ‘চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি ধরা না পড়ে’। এই বিদ্যায় কোনো কোনো বাঙালির ব্যুৎপত্তি প্রশ্নাতীত। কারও গাছের লিচু বা পাকা আম চুরি দিয়ে শুরু হলেও বাঙালি পুকুরচুরিতেও পাকা। চুরির বস্তু হিসেবে পুকুরও এখন বড় কিছু নয়। খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, বনভূমি, নদী ও পাহাড় পর্যন্ত চুরি হচ্ছে। সোনাদানা তো অতি ছোট বস্তু।

এ যুগে চোরের বিপদ নেই বললেই চলে, চোর যে ধরবে, বিপদ তার। বলা হবে-চোর ধরার তুমি কে হে? এই কারণে চোখের সামনে কাউকে চুরি করতে দেখলেও অনেকে চোখ বন্ধ করে। চুরি করছে তো কী হয়েছে?

সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে ভুতুড়ে কাণ্ড’। ভূতের কাণ্ডই হোক বা মানবীয় কাণ্ডই হোক, একটা ব্যাপার তো বটে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘জমা রাখা হয়েছিল ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের চাকতি ও আংটি, তা হয়ে আছে মিশ্র বা সংকর ধাতু। ছিল ২২ ক্যারেট সোনা, হয়ে গেছে ১৮ ক্যারেট।...দৈবচয়ন ভিত্তিতে নির্বাচন করা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত ৯৬৩ কেজি সোনা পরীক্ষা করে বেশির ভাগের ক্ষেত্রে এ অনিয়ম ধরা পড়ে।’

২০১৫ সালে ব্যাংকে জমা দেওয়ার সময় ছিল ‘বিশুদ্ধ সোনা’, ‘কিন্তু দুই বছর পর পরিদর্শন দল ওই চাকতি ও আংটি পরীক্ষা করে তাতে ৪৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ সোনা পায়। আংটিতে পায় ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ সোনা।’

প্রখ্যাত ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বিষয়টি জেনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অকল্পনীয়। যাঁরা কাস্টডিয়ান, তাঁদের হাতে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে বিস্মিতই হতে হয়।...এসব ক্ষেত্রে দায়িত্বে থাকেন হাতে গোনা কয়েকজন। ঘটনার সময় যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে সব বের হয়ে আসবে।’

অন্যদিকে ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্রকে তাঁর মেইলে লিখিত প্রশ্ন পাঠালে ৯ দিনেও তিনি জবাব দেননি। প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্রের মুখ বন্ধ থাকায় বিষয়টি নিয়ে আরও সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তবে সে সন্দেহ দূর করার প্রচেষ্টা হয় পরদিন। সংবাদ সম্মেলন করে জাতিকে আশ্বস্ত করে বলা হয়, ভল্টে রাখা সোনার পরিমাণে কোনো হেরফের হয়নি। সোনার পরিমাণ একই আছে। বাংলা চার (৪) আর ইংরেজি আট (৪) দেখতে একই রকম বলে লিখতে ভুল হয়েছিল। এটি কারণিক ভুল (ক্ল্যারিকেল মিসটেক)।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, ‘শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের দেওয়া সোনা জমা রাখার সময় সোনা ৪০ শতাংশই ছিল। কিন্তু ইংরেজি বাংলা হেরফেরে সেটা ৮০ শতাংশ লিখে ভুলবশত নথিভুক্ত করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত স্বর্ণকার এই ভুলটি করেছিলেন।’

এ বক্তব্যে সন্দেহ প্রকাশের তিলমাত্র অবকাশ নেই। দোষ দিলে এখন দিতে হয় যাঁরা বাংলা অক্ষর উদ্ভাবন করেছিলেন, তাঁদের। তাঁদের রোমান হরফ দ্বারা প্রভাবিত হওয়া ছিল বড় বোকামি। ব্যাপারটি বিপরীতও হতে পারত। ছিল রোমান ৪০ (আশি), লেখা হলো বাংলা ৪০ (চল্লিশ)। যিনি লিখেছিলেন সেই গরিব কেরানিকে কোরবানি দিলেই সব সমস্যার সমাধান। মানুষ মনে করবে ওই প্রতিষ্ঠানে শুধু ওই কেরানিই রয়েছেন আর কোনো কর্মকর্তা নেই তাঁর ওপরে। থাকলেও তাঁরা সবাই সাধু।

অতীতে রাজকর্মচারীদের অসাধুতা ও দুর্নীতির কারণে বহু রাজত্ব ও সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটেছে। দোষ গিয়ে পড়েছে রাজা ও সম্রাটের ওপর, কিন্তু সর্বনাশ ঘটিয়েছেন রাজন্যবর্গ ও আমলারা।

অনভিজ্ঞ যুবক সিরাজউদ্দৌলার জন্য বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির করতলগত হয়নি। হয়েছিল দুর্নীতিবাদ ও বিশ্বাসঘাতক আমলাদের জন্য।

অদক্ষ ও অবিশ্বস্ত আমলা ও কর্মচারীরা সরকারের যত ক্ষতি করে, সরকারের প্রকাশ্য বিরোধিতাকারীরা তার শতভাগের এক ভাগও করে না। পথেঘাটে ও ময়দানে দাঁড়িয়ে সরকারের সমালোচনা করা এক কথা, আর সরকারের ভেতরে থেকে সবকিছু খেয়ে ঝাঁজরা করে দেওয়া আর এক জিনিস।

তোপখানা রোডে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাস ভরে লোক এনে ‘স্মরণকালের বৃহত্তম’তে বক্তৃতা দিয়েও সরকারের চুলটিও ছিঁড়তে পারেন না কোনো জননেতা; তালা-চাবি ও হাতুড়ি-বাটালি নিয়ে সন্ধ্যার পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রুদ্ধ কক্ষে বসে দেশের বারোটা বাজিয়ে দেওয়া যায়।

বিশ্বস্ত কর্মচারী-কর্মকর্তারা দেশের জন্য জীবন দিতে পারেন, তার প্রমাণ পেয়েছি একাত্তরে। একই সময়ে দেখেছি বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর আলী খানদের। ব্যক্তিস্বার্থে তাদের টিক্কা-নিয়াজি-ফরমানের পা চাটায় অরুচি ছিল না।

শুধু বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফরের অযোগ্যতায় মোগল সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত হয়নি। তা যে হয়নি তা বুঝতে পেরেছি শতাব্দীকাল পর পঁচাত্তরের ১৭ আগস্ট, যেদিন সচিবালয় থেকে একটি অবৈধ প্রশাসনকে আনুগত্য দিতে একজনও অস্বীকার করেননি।

জনগণের কষ্টার্জিত টাকা ও ডলার ব্যাংকগুলোর ভল্ট থেকে কর্পূরের মতো উড়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিন্দুকের সোনা একা একাই রূপান্তরিত হচ্ছে এক অভিনব ধাতুতে। দুনিয়া জাহানে যা ঘটে না, তাই ঘটছে বাংলার মাটিতে। সত্য হোক অথবা ‘পুরো সত্য’ না হোক, কোনো বিষয়ে কোনো রকম অভিযোগ ওঠা মাত্র তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কর্তব্য।

দুর্নীতির স্থান-কাল-পাত্র নেই, তা সত্ত্বেও মানুষ মনে করে ভূমি অফিসে তহশিলদারের দুর্নীতি আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো লোকের দুর্নীতি একই মাপকাঠিতে বিচার্য নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাবমূর্তি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি। পরিমাণ দিয়ে সবকিছু বিচার্য নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিন্দুক থেকে যদি এক তোলা সোনাও এধার-ওধার হয়ে থাকে, তা খুব বড় ঘটনা। দেশের মানুষ বিষয়টির স্পষ্ট ব্যাখ্যা দাবি করে। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা বা মাছ দিয়ে শাক ঢাকা সব ক্ষেত্রে চলে না।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক