Thank you for trying Sticky AMP!!

ডেঙ্গু কি দরজায়, নাকি ঢুকেই পড়েছে?

রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে

গত মার্চ থেকে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সব কলকবজা পুরোদমে করোনামুখী হতে থাকে। গত বছর সব দৃষ্টি ছিল ডেঙ্গুর দিকে। তার আগের বছর মানুষ কেঁপেছে চিকুনগুনিয়ার ভয়ে। আমাদের জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি নানাবিধ চাপের মধ্যে খুবই অসহায় হয়ে যায়, কখনো মাঝেমধ্যে কখনোবা সব সময়। নাগরিক অভ্যাস ও বদ–অভ্যাসের তাল সামলাতে জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা যেমন হিমশিম খায়, তেমনি তাকে পাল্লা দিতে হয় রোগজীবাণুর রূপ বদলানোর ক্ষমতার সঙ্গে।
এযাবৎ ডেঙ্গু ছিল প্রাক্‌বর্ষা আর বর্ষার দুশ্চিন্তা; এ বছরের প্রলম্বিত বর্ষা তাকে হেমন্ত পার করে শীতের আরেক ভোগান্তিতে পরিণত করতে পারে। ইতিমধ্যেই সেসবের আলামত দেখা যাচ্ছে । মশাবাহিত এ রোগের প্রকোপ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস শেষে কমতে শুরু করলেও চলতি বছর নভেম্বর মাসে হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রোগী ভর্তি হচ্ছে কাতারে কাতারে।

করোনার আতঙ্কে যখন মানুষ পারতপক্ষে হাসপাতাল–ক্লিনিকের দরজা মাড়াতে চায় না, তখন কতটা নিরুপায় হলে তারা ডেঙ্গু নিয়ে সেই হাসপাতালের শরণ নিতে পারে! প্রথম দিকে, জ্বর-জারি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে অনীহা থাকা এবং বাসায় বসেই চিকিৎসা নেওয়া উৎসাহিত করায় ভেতরে ভেতরে ডেঙ্গু বিস্তারের ছবিটা স্পষ্ট ছিল না কারও কাছে। সম্প্রতি ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভারে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান একজন চিকিৎসক।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) শাখায় এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাঁচজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার তথ্য পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে একজনের মারা যাওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছে।
শুক্রবার (৬ নভেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের স্বাস্থ্যতথ্য ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সহকারী পরিচালক মো. কামরুল কিবরিয়া স্বাক্ষরিত হিসাব অনুযায়ী ৫ নভেম্বর সকাল ৮টা থেকে ৬ নভেম্বর সকাল ৮টা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ১২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। শুধু রাজধানীতেই সেদিন পর্যন্ত ৪৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন।
বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল থেকে তথ্যের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবমতে চলতি বছরের (২০২০ ) জানুয়ারি মাসে (করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে) দেশে ১৯৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। তবে পরবর্তী সময়ে এ সংখ্যা আরও কমে আসে। ফেব্রুয়ারি মাসে ৪৫ জন, মার্চ মাসে ২৭ জন, এপ্রিল মাসে ২৫ জন, মে মাসে ১০ জন, জুন মাসে ২০ জন, জুলাই মাসে ২৩ জন, আগস্ট মাসে ৬৮ জন, সেপ্টেম্বর মাসে ৪৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও অক্টোবর মাসে এই সংখ্যা বেড়ে যায়। অক্টোবর মাসে ১৬৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দেশের বিভিন্ন স্থানের হাসপাতালে ভর্তি হয়। নভেম্বর মাসে ৮/৯ তারিখের মধ্যে ৭০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা অক্টোবর/নভেম্বর মাসে কখনো সর্বোচ্চ চূড়ায় ছিল না।

এবার অক্টোবরে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়ার একটা বড় কারণ হতে পারে প্রলম্বিত বর্ষা। আবার এমনও হতে পারে যে মানুষ বাড়িতেই ধুঁকেছে। ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে এসে করোনার জালে নিজেকে জড়াতে চায়নি। তাই আমরা এখন অক্টোবর-নভেম্বরে এসে বড় বড় সংখ্যা দেখছি। তবে এসব নিয়ে আমাদের কোনো বিশ্বাসযোগ্য অনুসরণ পদ্ধতি বা ধারাবাহিক গবেষণা না থাকায় ধারণার ওপর ভিত্তি করে উপসংহার টানতে হচ্ছে।

কোনটা শুধুই জ্বর, কোনটা ডেঙ্গু, কোনটা প্রবীণদের জন্য মারাত্মক, সেটা বোঝার একটাই পথ—রক্ত পরীক্ষা করা। প্রবীণ আর শিশুদের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে বেশি।

এসব নিয়ে বর্তমান সময়ের ব্যস্ততম জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলামের (কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য) কাছে মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বছর প্রায় পুরোটা সময় আসলে কোভিড-১৯ নিয়েই সবার চিন্তা ছিল। এটি নিয়ে ভাবতে গিয়ে অন্যান্য রোগের বিষয়ে আসলে তেমন আলোচনা হয়নি। তবে ডেঙ্গু রোগ এখন বাড়ছে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এটা বলা যেতে পারে যে বর্তমান পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু রোগীর শনাক্ত বাড়ছে। কারণ, ডেঙ্গুর পিক টাইমে কিন্তু অনেকেই হাসপাতালে যায়নি কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে।’ তাঁর মত হচ্ছে, হাসপাতালে কত রোগী এল না এল, সেদিকে তাকিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ সারা বছর করে যেতে হবে। সমন্বিতভাবে বিভিন্ন সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যেতে হবে।
বর্তমান জ্বরের চরিত্র এবং তার কারণ নিয়ে ধোঁয়াশায় আছেন ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া গবেষকেরা। বর্ণচোরা এই জীবাণু নিয়ে তাঁরা এখন আর কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে আগে অনেক বেশি জোর দেওয়া হতো উপসর্গের ক্ষেত্রে। কিন্তু প্যারাসিটামল ব্যবহারের পরই এই অসুখ তার চরিত্র পাল্টে ফেলেছে। চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে জ্বরের আলাদা কোনো আলামত ছিল না। সারা গায়ে অসম্ভব ব্যথার সঙ্গে জ্বর অন্যতম উপসর্গ ছিল। তবে এখন অল্প জ্বর ও গিঁটে ব্যথা হলেও চিকুনগুনিয়া হতে পারে। তাঁদের মতে, জ্বর এক দিনের বেশি টিকে গেলেই রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে।

কোনটা শুধুই জ্বর, কোনটা ডেঙ্গু, কোনটা প্রবীণদের জন্য মারাত্মক, সেটা বোঝার একটাই পথ—রক্ত পরীক্ষা করা। প্রবীণ আর শিশুদের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে বেশি।
বাংলাদেশের লাগোয়া ভারতীয় রাজ্য পশ্চিম বাংলাতেও এই হেমন্তে ডেঙ্গু নতুন করে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন শিশু মারা গেছে সেখানে। সেখানকার হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এমন অনেক ডেঙ্গু রোগী আসছেন, যাঁদের খিঁচুনি রয়েছে। রয়েছে মস্তিষ্কের সংক্রমণও। অনেক সময় ডেঙ্গু থেকে মাল্টি অর্গান ফেইলিওরও হচ্ছে। সম্প্রতি কলকাতায় যে শিশুটি মারা গেছে, তার লিভার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ডেঙ্গু সংক্রমণ থেকে।

উৎসাহী পাঠকমাত্রই জানেন, এ বছরের ১৯ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত দুই সিটি করপোরেশনে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জাতীয় ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় চালানো জরিপের ফলাফল অনুযায়ী জানানো হয়েছিল, উত্তর সিটি করপোরেশনের ৯টি এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৬টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর ঝুঁকি আছে। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে উভয় সিটি করপোরেশন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। এখন সেসব কর্মসূচির ফলাফল পর্যালোচনার সময় এসেছে।
মনে রাখতে হবে, জরিপ নিশ্চিত করেছিল যে এ শহরের ক্ষমতাবানেরা এডিস মশার লালনপালন করে। এডিস মশার প্রজননস্থলগুলোর মধ্যে শতকরা হার বহুতল ভবনে ৫১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, নির্মাণাধীন ভবনে ২০ দশমিক ৩২ শতাংশ, একক ভবনে ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং পরিত্যক্ত জমিতে ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ লার্ভা পাওয়া গেছে। আর গরিবের আবাসস্থল বস্তি এলাকায় মাত্র ১২ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
এসব ক্ষমতাবানকে সোজা করা কঠিন, তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সেটাও সম্ভব। দিল্লির ‘মাফলার ম্যান’ কেজরিওয়াল সেটা করে দেখিয়েছেন। এ বছর বাসের অনুপযোগী বলে ঘোষিত দিল্লিতে একজন মানুষও ডেঙ্গুতে মারা যায়নি। ১০ সপ্তাহের এক কর্মসূচি নিয়েছিলেন তিনি। নাম দিয়েছিলেন ‘দশ হপ্তা দশটায় দশ মিনিট’। প্রতি রোববার সকাল ১০টায় ১০ মিনিট সময় নাগরিকেরা দিয়েছেন তাঁদের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, গ্যারেজ, বাগানে জমে থাকা পানি পরিষ্কারের কাজে। এটা ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে। ২০১৫ সালে যে দিল্লিতে মানুষ মরেছে কাতারে কাতারে, সেই দিল্লিতে এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ৪৮৯ জন। কোনো মৃত্যু নেই।
জনগণের সঙ্গে নেতারাও দিল্লিতে নামতেন ছবি তোলার জন্য নয়, কাজ করার জন্য। আমাদের নগরপালেরা ভেবে দেখতে পারেন।


গওহার নঈম ওয়ারা লেখক গবেষক
nayeem5508@gmail.com