সহজিয়া কড়চা

দুর্নীতি, সেক্স ও রাজনীতি

ধরণির এক কোণে পড়ে ছিল বাংলাদেশ। বিশ্ববাসীর কাছে তার নামডাক ছিল না। শতাব্দীর শেষ দিক থেকে তার খ্যাতির শুরু। অন্যান্য জাতিকে হারিয়ে দিয়ে জীবনের কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে হতে শুরু করে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয়। বিশ্বসভায় স্থান করা নিয়ে তার শুরু দুর্নীতি দিয়ে। তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম নয়, এক্কেবারে ফার্স্ট। দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাধ্যমে আমাদের নাম ফাটে। একবার নয়, বারবার।

কয়েক দিন আগে বিলেতের বিখ্যাত পত্রিকা মিরর  জানিয়েছে, জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন গুগলে ‘সেক্স’ শব্দটি অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ২০১৪ খ্রিষ্টীয় অব্দে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এ ক্ষেত্রে প্রথম শ্রীলঙ্কা এবং দ্বিতীয় স্থানে ভারত। গুগলে প্রকাশিত কোনো নির্দিষ্ট শব্দ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে কোনো দেশের অবস্থানবিষয়ক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে।

গুগলের এই জরিপে, দুর্নীতির মতো ‘সেক্স’ শব্দের প্রতি আগ্রহে বাঙালি প্রথম না হওয়ায় কিছুটা হতাশ হয়েছি। বাঙালির জীবনে সেক্সের প্রতি অতি আগ্রহ লক্ষ করা যায় সেই চর্যাপদের সময় থেকে। শুধু গুগল অনুসন্ধানকারীরা নয়। যাদের ঘরে কম্পিউটার নেই, যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে না, তারা সেক্স নিয়ে মাথা ঘামায় না, তা নয়। তারা বরং সরাসরি যৌনকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আড়াই-তিন বছরের কন্যাশিশুকেও খালি বাড়িতে কোনো পুরুষের হেফাজতে রেখে যাওয়া নিরাপদ নয়। গুগলের এই প্রতিবেদন যখন প্রকাশিত হয় তখন বছরের শেষে আমাদের দেশের কোনো কাগজে পড়লাম, শহরতলির এক আহাম্মক যুবক তার অবলা বউকে তার বাপের কাছে রেখে কাজে গিয়েছিল। অল্পক্ষণ পরেই শ্বশুর পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট প্রাণীতে পরিণত হয়। মেয়েটির চিৎকারে পাড়াপড়শি জড়ো হয়, কিন্তু তার আগেই তার সতীত্ব শেষ।

যৌন হয়রানি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন আজ মহামারির আকার ধারণ করেছে। যৌনসম্ভোগের তৃষ্ণা বাঙালি বালক বয়স থেকেই রপ্ত করতে থাকে। বিগত বছরগুলোতে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েছি। প্রত্যন্ত গ্রামের অনেক ইস্কুলের দরজা, জানালা, চৌকাঠ, বেঞ্চি, বেড়া কিছুই বাদ নেই। যৌনসংক্রান্ত কত নোংরা কথা লেখা! বেঞ্চিতে লেখা কোনো মেয়ের উদ্দেশে ক্ষুদ্র প্রেমপত্র। আঞ্চলিক শব্দে যৌন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম লেখা। আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে সেসব শব্দ আজও স্থান পায়নি। ওই সব শব্দ লেখাতেই পুলক। লেখকের বয়স ১০-১১ বছরের বেশি নিশ্চয়ই নয়। কারণ ওটি চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস। কোনো দরজায় বা বেড়ায় পুরুষের প্রত্যঙ্গের ছবি, যা পিকাসোর ছবিকে হার মানায়। এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ হওয়ায় কম্পিউটারে ‘সেক্স’ শব্দ খোঁজার হিড়িক পড়েছে।

শুধু ইন্টারনেটে সেক্স ঘাঁটাঘাঁটি নয়। দৈনন্দিন কথাবার্তায় যৌনতামিশ্রিত শব্দ উচ্চারণে বাঙালি অদ্বিতীয়। হাটবাজার, অফিস-আদালত, বাস-ট্রেনস্টেশন, লঞ্চঘাট যেখানেই যাবেন আপনার কানে এসে বাড়ি মারবে এমন শব্দ, যা শুনলে বহু নারীর কান শুধু নয়—চোখ, নাক, মুখ লাল হয়ে যায়। সুতরাং গুগলের প্রতিবেদন যথার্থ।

বছর শেষে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে জানা গেছে, উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির ৩৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষই রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। ‘স্প্রিং ২০১৪ গ্লোবাল অ্যাটিচিউট সার্ভে’ শিরোনামের জরিপে প্রকাশ পায়, বাংলাদেশের ৬৫ ভাগ মানুষ রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশে সরাসরি কথা বলা হয় ১৮ ঊর্ধ্ব এক হাজার মানুষের সঙ্গে।

পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপের ফলাফলের সঙ্গে আমি একমত নই, কিন্তু তাদের স্পিরিটের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের সুযোগ নেই। ১৮ তো অনেক বেশি বয়স, যাদের কেবল মুখে বোল ফুটেছে তাদের জরিপ করলেও একই ফলাফল পাওয়া যেত। দুগ্ধপোষ্য শিশু ছাড়া রাজনীতিতে নাক গলায় না, এমন বঙ্গসন্তান বিরল।

রাজনীতির সঙ্গে বাঙালির জীবন-মরণ সম্পর্ক। বিশেষ করে জীবনের সম্পর্কের চেয়ে মরণের সম্পর্কই বেশি। তৃতীয় বিশ্বে নির্বাচনী সহিংসতায় বহু লোক মারা যায়। তা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রিয় দলের বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের কথা শুনে হার্টফেল করে মারা যায় শুধু বাংলার মাটিতেই। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মধ্যরাতেই যখন টিভির পর্দায় বেসরকারিভাবে ঘোষিত হয় বিজয়ী দলের নাম, অট্টহাসি দিয়ে লাফ মেরে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে একজন। আরেক জেলায় ‘জয়—’ বলে চিৎকার দিয়ে একজন ভবলীলা সাঙ্গ করে, স্লোগানের শেষ শব্দটি থেকে যায় অনুচ্চারিত। আর একজন উঠানের মধ্যে খুশিতে বন্ধুকে সজোরে জড়িয়ে ধরে। তবে চাপ দিয়ে বন্ধুকে মারেনি, নিজেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বাঙালির কাছে রাজনীতির তুলনায় জীবন তুচ্ছ।

দুর্নীতি, যৌনতা বা রাজনীতিতে শীর্ষস্থান লাভের চেয়ে সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোনো দিন বাঙালি নৈতিকতা ও দক্ষতায় বিশ্বসভায় প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থান অধিকার করে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷