
শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ নভেম্বর-এপ্রিল মাসে আশুলিয়া কিংবা সাভারে যাওয়া-আসার পথে দিগন্তের দিকে তাকালে আপনার মনে হবে যে আকাশে মেঘ জমে কালো হয়ে এই বুঝি বৃষ্টি এল। কিন্তু আরেকটু মনোযোগ দিলে বুঝতে পারবেন, ব্যাপারটা তা নয়। আসলে ইটভাটাগুলোতে ইট পোড়ানোর কালো ধোঁয়া আকাশ আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এখানেই শেষ নয়। পরিবেশদূষণ ছাড়াও ইটভাটাগুলো ফসলি জমি, ভূ–উপরিস্থ মাটি, ভূগর্ভস্থ পানি ও জ্বালানি অপচয় করে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, যত্রতত্র ভাটা স্থাপন ও ভূ–উপরিস্থ মাটি ব্যবহার করে ইট প্রস্তুতের ফলে প্রতিবছর প্রায় ৪২ হাজার হেক্টর আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায়, ইটভাটার আশপাশের জমিগুলোতে জৈব পদার্থের পরিমাণ মাত্র ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ, যেখানে ভাটা থেকে দূরবর্তী জমিতে এর পরিমাণ ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ইটভাটায় ব্যবহৃত ভূ–উপরিস্থ ভূমির পুনরুজ্জীবনের জন্য স্থানভেদে ২০ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
দেশে পর্যাপ্ত কাঠ, পাথর ও লোহা না থাকায় ইট আমাদের অন্যতম প্রধান নির্মাণসামগ্রী। এ খাত সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য–উপাত্ত পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয়ে থাকে, জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন এ খাত থেকে প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের ১ শতাংশ আসে। সেই সঙ্গে প্রায় ২০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়, যাদের একটি বড় অংশই হচ্ছে নারী। দেশে প্রায় ১০ হাজার ইটভাটা থেকে বছরে ১ হাজার ৭০০ কোটি ইট ও ব্রিকেট উৎপাদিত হয়। উন্নয়ন-সংশ্লিষ্ট নির্মাণকাজের বৃদ্ধি ও গ্রামাঞ্চলে টিনের অথবা কাঁচা বাড়ির পরিবর্তে পাকা বাড়ি নির্মাণের প্রবণতার কারণে ইটের চাহিদা বেড়েই চলেছে।
সম্প্রতি, পরিবেশের ওপর ইটভাটার বিরূপ প্রভাবের কথা বিবেচনা করে এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের স্বার্থে নানা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। এখন প্রধানত দুই পদ্ধতিতে ইট উৎপাদন করা হয়ে থাকে: (১) পুড়িয়ে (২) না পুড়িয়ে। এ ছাড়া উভয় পদ্ধতিতে কম কাঁচামাল ব্যবহার করে ফাঁপা ইট প্রস্তুত করা সম্ভব। না পোড়ানো ইটের ক্ষেত্রে বালু, সিমেন্ট, ফ্লাই অ্যাশ, জিপসাম ইত্যাদি মিশ্রিত করে ফোমিং এজেন্টের সাহায্যে জমাট বাঁধিয়ে ইট প্রস্তুত করা হয়। না পোড়ানো ইটের প্রধান সুফলগুলো হলো, এ ক্ষেত্রে মাটি ব্যবহার করা হয় না, দূষণকারী কয়লা বা অন্য কোনো জ্বালানি পোড়ানো হয় না এবং এতে পানির ব্যবহারও পোড়ানো ইটের তুলনায় অনেক কম।
অন্যদিকে পোড়ানো ইটের ক্ষেত্রে নতুনতর ভাটাগুলো হলো টানেল ভাটা, ভার্টিক্যাল শ্যাফট ভাটা, হাইব্রিড হফম্যান ভাটা, জিগজ্যাগ ভাটা। টানেল ও হাইব্রিড হফম্যান ভাটায় আধুনিক মেশিনের (extruder) সাহায্যে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ইট প্রস্তুত করা হয়। এই দুটি ভাটায় প্রতিটি ইট প্রস্তুতের জন্য তুলনামূলক কম কয়লা ব্যবহার প্রয়োজন হয় বিধায় পরিবেশদূষণ কম হয়। এ ছাড়া এই ভাটাগুলোতে ইট প্রস্তুতের জন্য মাটির সঙ্গে বালু মিশ্রিত করা যায় এবং পানির ব্যবহার তুলনামূলক কম হয়। ভার্টিক্যাল শ্যাফট ভাটা কেবল থান ইট পোড়ানোর জন্য উপযুক্ত এবং এই ভাটায় ইট প্রস্তুত করতে সব ধরনের মাটি ব্যবহার করা যায় না। জিগজ্যাগ ভাটার ক্ষেত্রে ইট বসানো এবং এর পোড়ানোর কৌশল পরিবর্তন করে পরিবেশদূষণ হ্রাস করা হয়।
বাংলাদেশে ইট প্রস্তুতের উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাধাগুলো হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতনতা ও গ্রহণযোগ্যতার অভাব, ফাঁপা ও না পোড়ানো ইটের সীমিত চাহিদা, দেশীয় প্রয়োজনে ভাটার ডিজাইন ও অভিযোজনের আবশ্যকতা, ইটভাটার শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের অভাব, উচ্চমাত্রার আর্থিক বিনিয়োগ, নীতিগত, আর্থিক এবং শুল্ক ও করবিষয়ক প্রণোদনার অভাব। এর ফলে আইনগত বিধিবিধান থাকা সত্ত্বেও পরিবেশদূষণকারী ইটভাটাগুলোর আধুনিকায়ন সম্ভব হয়নি।
আধুনিক ও টেকসই ইট প্রস্তুত পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে: (১) জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়া, (২) ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত পরিবেশদূষণ কমানো, (৩) কৃষিজমি, ভূ–উপরিস্থ মাটি ও পানির ব্যবহার কমানো, (৪) ইট প্রস্তুতকারীদের লাভ নিশ্চিত করা এবং (৫) কর্মরত শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের উন্নতি সাধন করা।
উন্নততর ও কম দূষণকারী প্রযুক্তিতে ইট নির্মাণ প্রসারের জন্য বিভিন্ন দেশে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গণচীনে ২০০০ সাল থেকে থান ইটের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং না পোড়ানো ইট ও ফাঁপা ইট প্রস্তুত করার জন্য নানা প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। পোড়ানো ইটের ক্ষেত্রে মাটির সঙ্গে গুঁড়া কয়লা মেশানোও জ্বালানি সাশ্রয়ের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। অন্যদিকে ভিয়েতনামে ২০১০ সালে গৃহীত কর্মসূচির আওতায় ২০১৫ সাল নাগাদ ২০-২৫ শতাংশ এবং ২০২৫ সাল নাগাদ ৩০-৪০ শতাংশ না পোড়ানো পদ্ধতিতে ইট প্রস্তুত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। এ ছাড়া দেশটিতে ২০১১ সালে একটি সার্কুলারের মাধ্যমে না পোড়ানো ইটের কাঁচামাল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে কোনো শুল্ক আরোপ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ইট ভাটাগুলো আধুনিকায়ন করা হলে একটি দূষণমুক্ত পরিবেশ পাওয়া যাবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সনাতনী পন্থার পরিবর্তে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ইট উৎপাদন পদ্ধতির প্রসারের লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী কর্তৃক ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে ১০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব নিঃসন্দেহে একটি সময়োচিত পদক্ষেপ।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় কম পরিবেশদূষণকারী ও টেকসই ইট নির্মাণ পদ্ধতিকে উৎসাহিত করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগকে সফল করতে হলে নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:
১। ইট প্রস্তুতের ক্ষেত্রে কেবল পোড়ানো ইটের ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তাই জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং কম দূষণকারী পোড়ানো ইটের প্রযুক্তির পাশাপাশি না পোড়ানো ইট প্রস্তুত ও এর ব্যবহার প্রসারের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা।
২। না পোড়ানো ও স্বয়ংক্রিয় ইট প্রস্তুত ও ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রস্তুতকারক ও নির্মাণশ্রমিকদের কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
৩। না পোড়ানো ইট ও ফাঁপা ইটের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য বিল্ডিং কোড, গণপূর্ত বিভাগ, স্থানীয় সরকারের প্রকৌশল বিভাগ, রাজউক, ফ্যাসিলিটিজ ডিপার্টমেন্ট প্রভৃতির দর তালিকায় না পোড়ানো ইট ও ফাঁপা ইটের আকার আকৃতি, গুণগত মান ও মূল্য সন্নিবেশ করা।
৪। ইট প্রস্তুতকারক এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, এক স্থানে সব সেবা (one stop service) এবং ইটবিষয়ক নতুন গবেষণার জন্য একটি উপযুক্ত সরকারি সংস্থা Brick Center প্রতিষ্ঠা করা।
৫। ফাঁপা ও থান ইটের ওপর আরোপিত ভ্যাটের বৈষম্য দূর করা (উল্লেখ্য, বর্তমানে ফাঁপা ইটের ওপর বেশি ভ্যাট দিতে হয়)।
৬। না পোড়ানো ও স্বয়ংক্রিয় ইট প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে স্বল্প সুদে ঋণসুবিধা চালু করা এবং
৭। আধুনিক প্রযুক্তিতে পরিবেশবান্ধব ইট প্রস্তুতের প্রয়োজনীয়তা এবং না পোড়ানো ইটের ব্যবহারের প্রসারের লক্ষ্যে প্রচারের ব্যবস্থা করা। ইট প্রস্তুত আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা কয়েক হাজার উদ্যোক্তা এবং এ শিল্পে নিয়োজিত ২০ লক্ষাধিক শ্রমিকের স্বার্থের কথা বিশেষভাবে ভাবতে হবে। স্বল্প বিনিয়োগ, শ্রমঘন ও কম দূষণকারী হওয়ার কারণে জিগজ্যাগ প্রযুক্তি এ ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। জিগজ্যাগ প্রযুক্তির সঙ্গে দূষণ হ্রাসকারী প্রযুক্তি স্থাপন করে একে আরও কার্যকর করা যেতে পারে।
ওপরের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হলে ইটভাটার দূষণমুক্ত পরিবেশের বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর আকাঙ্ক্ষা বাস্তব রূপ পাবে। আশা করি উন্নয়ন সহযোগীরাও সরকারের এই শুভ উদ্যোগে সহায়তা করতে এগিয়ে আসবেন।
এম ফাওজুল কবির খান: সাবেক বিদ্যুৎসচিব ও অর্থনীতির অধ্যাপক।