Thank you for trying Sticky AMP!!

পিইসি ও জেএসসি নয়, খেলার মাঠ চাই

শৈশবের চাঞ্চল্য, দৌড়ঝাঁপ আর খেলাধুলা—এসব কিছু উপভোগ করা একটি শিশুর অধিকার। ছবি: প্রথম আলো

‘পেডাগজি’ বলে ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে, যার মানে হচ্ছে ‘শিক্ষা প্রদান’–বিষয়ক জ্ঞান ও কৌশল। এ বিষয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন সারা বিশ্বে। তাঁরা নিরন্তর গবেষণা করে যাচ্ছেন কীভাবে শিক্ষা প্রদান করলে ছাত্রছাত্রীরা বেশি উপকৃত হবে কিংবা কী উপায়ে তাঁদের মেধা মূল্যায়ন তথা পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করা উচিত ইত্যাদি। ছাত্রছাত্রীদের মনস্তত্ত্ব থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য কিংবা ব্যক্তিত্ব—সবকিছু নিয়েই এখানে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়।

এসব গবেষণার মাধ্যমেই শিক্ষাসংক্রান্ত নতুন নতুন ধারণার উদ্ভব হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে তেমনি একটি পদ্ধতি ‘কিন্ডারগার্টেন’। শিক্ষাক্ষেত্রে জার্মান এই শব্দের মূল ধারণা হচ্ছে ‘খেলার ছলে শেখানো’। অর্থাৎ ফলের নাম, ফুলের নাম শেখাতে চান, বাগানে নিয়ে যান কিংবা পশুপাখির নাম শেখাতে চিড়িয়াখানায়। উন্নত বিশ্বের প্রায় সব দেশেই আজকাল প্রাথমিক স্তরে কোনো প্রথাগত পরীক্ষা হয় না। নেই প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় হওয়ার ইঁদুরদৌড়। যা হয় তা হচ্ছে সার্বিক মূল্যায়ন। শুধু পরীক্ষার নম্বর নয়, তার স্বভাব-চরিত্র, পছন্দ-অপছন্দ, দুর্বলতা-সবলতা, স্বাস্থ্য কিংবা মানসিক পরিপক্বতা—এসব কিছু নিয়ে সামগ্রিক মূল্যায়ন।

অথচ আমাদের দেশ চলছে উল্টো পথে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী গত মেয়াদের শাসনামলে ঘটা করে চালু করলেন পিইসি ও জেএসসি নামের দুটি পরীক্ষা—ঠিক তাদের জন্য, বয়সের সংজ্ঞায় যাদের শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অতঃপর তিনি ঘোষণা দিলেন যে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি এক বৈপ্লবিক কাজ করেছেন। টিভি ফুটেজ ঘেঁটে পাঠকেরা এর সত্যতা যাচাই করে নিতে পারেন। এই পরীক্ষা দুটির প্রস্তুতি তথা ‘জিপিএ-৫’ নিশ্চিত করতে মা-বাবার রাতের ঘুম হারাম। এই দুর্মূল্যের বাজারেও তাই সকাল-বিকেল তাঁর অবুঝ শিশুটিকে কোলে করে দৌড়াচ্ছেন এই কোচিং সেন্টার থেকে ওটাতে। অবশেষে সেই বহুপ্রতীক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ, অর্থাৎ পরীক্ষার দিনে পুরো ঢাকা শহর যানজটে অচল।

কথা হচ্ছে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া হয়েছিল কি? আরও জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে এ দেশে কি শিশুশিক্ষাবিষয়ক কোনো গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বা বিজ্ঞজন নেই? তা-ই যদি হয়, তবে শিক্ষার মূল ভিত্তি এই প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা কার বুদ্ধিতে চলছে? বিশেষজ্ঞের কথা না হয় বাদ দিলাম, একজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষমাত্রই এটি উপলব্ধি করতে সক্ষম যে কোমলমতি শিশুদের ঘাড়ে বইয়ের বোঝা আর পরীক্ষার নিপীড়ন বাড়ানোর নাম শিক্ষার উন্নয়ন নয়। কলকাতার লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় তাঁর কোনো লেখা বা সাক্ষাৎকারে প্রায় দুই যুগ আগে বলেছিলেন যে আজকালকার শিশুরা তাদের ওজনের তুলনায় ভারী বইয়ের ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে হেঁচড়াতে থাকার পর মুখে যে অভিব্যক্তিটি ফুটে ওঠে, তার মর্ম হচ্ছে এই যে, ‘আর পারি না, এবার মরলে বাঁচি!’ আর সাম্প্রতিক সময়ে নাট্যব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূরের ‘ভাইরাল’ হওয়া ভিডিও ক্লিপ জিপিএ-৫-এর সারমর্মও একই। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বরাবরই মজা করতেন আমাদের এই পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে। কথা হচ্ছে মানবিক বোধসম্পন্ন কোনো সভ্য লোকমাত্রই কেন বিষয়টি বরাবরই অপছন্দ করে আসছেন?

বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকথায় না হয় পরে এলাম। চিরন্তন জীবনদর্শন কী বলে? আমরা সম্ভবত প্রায়ই ভুলে যাই যে এই পৃথিবীতে আমাদের অবস্থানটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, যা কিনা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত—শৈশব, কৈশোর, যৌবন আর বার্ধক্য। শৈশব পার হয়ে গেলে এটি আর পাবে না। শৈশবের চাঞ্চল্য, দৌড়ঝাঁপ আর খেলাধুলা—এসব কিছু উপভোগ করা একটি শিশুর অধিকার। আর একটি শিশুর এই অধিকার বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি অবশ্য প্রয়োজন, তা সম্ভবত একটি খেলার মাঠ, কোচিং সেন্টার নয়। খেলার মাঠ ছাড়া স্কুল হয়, আর তাতে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হয়—সারা বিশ্বে এ ধরনের তথাকথিত স্কুলের সংখ্যা বিবেচনায় ঢাকা সম্ভবত আরেকটি রেকর্ড স্থাপন করতে পারে। এই যেমন বাসের অযোগ্য শহর কিংবা বায়ুদূষণে বিশ্বে প্রথম—এ রকম আরকি! এ মাঠ যে একটি শিশুর জন্য শুধুই বিনোদনের স্থান, তা-ই নয়, এখান থেকেই সে হাতেখড়ি নেয় বন্ধুত্ব, সামাজিকতা কিংবা নেতৃত্বের। মাঠহীন এই নগরজীবনে চার দেয়ালে বন্দী শিশু-কিশোরদের একমাত্র বিনোদন ভিডিও গেম আর কম্পিউটার। একাকিত্ব আর বিষণ্নতা তাই ভর করছে অনেককে এ বয়সেই। আসক্ত হচ্ছে নেশায়। আর স্বাস্থ্য—শুনেছি আজকাল বিশ বছর বয়স থেকেই নাকি হার্টের ব্যামো শুরু হচ্ছে!

এত বিসর্জন দিয়ে এই যে জিপিএ-৫, তা উচ্চশিক্ষাতেই-বা কতটা কাজে লাগছে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই—গত কয়েক বছরে, বিশ্বের সবচেয়ে নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি ‘এমআইটি’তে আন্ডারগ্র্যাজুয়েটে যে কয়জন বাংলাদেশি ভর্তি হতে পেরেছেন, তাঁদের বেশ কয়েকজনের জিপিএ-৫ নেই। একইভাবে জিপিএ-৫ নেই সাকিব আল হাসানেরও। সে আলোচনা নয় আরেক দিন করা যাবে।

কথাগুলো যে নতুন তা কিন্তু নয়। হররোজ টিভি টক শো থেকে সেমিনার—সব জায়গায়, সবাই বলছে। শিশুদের ওপর পড়ার এত চাপ দেওয়া ঠিক নয়, খেলার মাঠ আর খোলা জায়গাগুলো রক্ষা করতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু তারপরও কোনো পরিবর্তন নেই। সমস্যাটা কোথায়? এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা আছেন—শিক্ষামন্ত্রী, পরিবেশমন্ত্রী কিংবা মেয়র অনেকেই। এমন নিরুপায় পরিস্থিতিতে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি, শুধু পিইসি ও জেএসসি বন্ধ নয়; ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে শিশুদের জন্য খেলার মাঠের ব্যবস্থা করারও উদ্যোগ নিন। মন্ত্রী-আমলারা না জানলেও আমি নিশ্চিত যে তিনি সুস্পষ্টভাবেই জানেন, একটি সুস্থ-সবল ও প্রকৃত অর্থেই মেধাবী পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এটি কত গুরুত্বপূর্ণ।

ড. মো. সিরাজুল ইসলাম নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার রিসার্চ অ্যান্ড সার্ভিসেসের পরিচালক