Thank you for trying Sticky AMP!!

বলিভিয়ার ইভো মোরালেসের অবাক করা জয়

বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী আর্কে ছিলেন নির্বাসিত প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসের অর্থমন্ত্রী। আর্কের বিজয়কে তাই মোরালেসের বিজয় বলেই দেখা হচ্ছে।

বলিভিয়া জিতেও গেল, বেঁচেও গেল। বলিভিয়ায় সম্ভবত আবারও ইভোনোমিক্স ফিরে আসছে। রোববারের নির্বাচনে বলিভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসের দল মুভমেন্ট ফর সোশ্যালিজমের (মাস) প্রার্থী লুই আর্কে জয়ের পথে আছেন। চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষিত না হলেও লুইস আর্কে ৫২ শতাংশ ভোট পাবেন বলে বুথফেরত জরিপে আভাস মিলেছে।

এটা শুধু লুইস আর্কের একক বিজয় নয়, আর্জেন্টিনায় নির্বাসিত সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসের বিজয়। সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিশ্বমোড়লদের বিরুদ্ধে বলিভিয়ার সম্মিলিত জনতার সাংবিধানিক অভ্যুত্থানও বটে। গত বছরের নভেম্বরে আতঙ্কের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তথাকথিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোরালেসকে শুধু ক্ষমতাচ্যুতই করা হয়নি, দেশ থেকেও বিতাড়িত করা হয়েছিল। ভোট অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই ষড়যন্ত্রের সমুচিত জবাবও দিয়ে দিল বলিভিয়ানরা।

গত বছরের নভেম্বরে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন মোরালেস। তবে ওই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। মোরালেসও বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিলেন না। গণভোটে মোরালেস নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য বিবেচিত হননি। পরে আদালতের নির্দেশ নিয়ে গত বছরের ২০ অক্টোবর মোরালেস টানা চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত হন। তিনিই বলিভিয়ার প্রথম আদিবাসী প্রেসিডেন্ট।

নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে রাজপথে নামেন সাবেক প্রেসিডেন্ট কার্লোস মেসার সমর্থকেরা। এর আগে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে মন্তব্য করে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট রাজপথ উত্তপ্ত করার মঞ্চ প্রস্তুত করে দিয়েছিল। মার্কিন ইশারায় উগ্র ডানপন্থীরা মোরালেসের সমর্থক ও সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হামলা করে। নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও বিরোধীরা রাজপথ ছাড়েনি; বরং এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে বলিভিয়াজুড়ে। কার্লোস মেসার সমর্থকদের সাজানো আন্দোলনের মুখে বলিভিয়ার সামরিক ও পুলিশ বাহিনীও ইভো মোরালেসের পেছন থেকে সরে যায়। এর সঙ্গে বলিভিয়ার সুশীল সমাজও যোগ দিয়েছিল। তবে মার্কিনরা সম্ভবত বলিভিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে হাত করতে পারেনি। এ কারণেই মোরালেসের দলের প্রার্থী আবারও জিতে এলেন।

বলিভিয়ার নির্বাচন মোরালেস ও কার্লোস মেসার জন্য কিছু বার্তা রেখে গেছে। মেসার জন্য বার্তাটি হচ্ছে, জনগণই শেষ পর্যন্ত সর্বময় ক্ষমতার উৎস। জনগণই নির্ধারণ করবে কে ক্ষমতায় থাকবে। বহিঃশক্তির সহায়তায় নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দেওয়া যায়, কিন্তু নির্বাচনে জিতে আসা যায় না।

আর মোরালেসের জন্য বার্তাটি হচ্ছে, কেবল উন্নয়ন ও আঞ্চলিক রাজনীতি করে নিজের অবস্থান সংহত করা যায় না। রাজনীতিতে স্বচ্ছতা অতি দরকারি উপাদান। অন্যথায় দুষ্ট চক্র প্রবেশ করে রাজনীতিকে ব্যাহত করতে পারে। গত বছর মোরালেসবিরোধী বিক্ষোভে যারা নীরব ছিল, তারাই এবার মোরালেস–সমর্থিত প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, একজন শাসকের যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকাকে জনসাধারণ পছন্দ করছে না।

সমসাময়িককালে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে বলিভিয়া নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছিল মোরালেসের নেতৃত্বে। মোরালেস দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম সফল শাসকদের একজন। তিনি সমাজতান্ত্রিক বা শ্রমিকশ্রেণির প্রতিনিধি ছিলেন না; বরং ইভোনোমিক্সের নামে পুঁজিবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের মিশেল ঘটাতে চেয়েছিলেন। মোরালেসের এই নীতিকে অনেকেই সমাজতান্ত্রিক পুঁজিবাদ বলে অভিহিত করেন। তিনি জাতীয়করণের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের প্রসার সমর্থন করতেন, বিশেষ করে কৃষি খাতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করেছিলেন।

মোরালেস প্রবৃদ্ধিকে ৬ শতাংশে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে দেশজ উৎপাদন তিন গুণ বেড়েছিল। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করেছিলেন। দারিদ্র্যের হার ১৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছিলেন। বেকারত্ব কমেছিল। জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছিল। জনগণের আস্থা অর্জন করলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরাগভাজন হয়েছিলেন মোরালেস।

মোরালেসের বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোনো দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। বিশ্ব গণমাধ্যমে মোরালেস মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নেতা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তিনি জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তির পক্ষে ছিলেন। ভেনেজুয়েলার হুগো শ্যাভেজের সঙ্গে জোট বেঁধে দক্ষিণ আমেরিকায় মার্কিনবিরোধী বলয় তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তিনি ফকল্যান্ড দ্বীপের ওপর আর্জেন্টিনার দাবিকে যৌক্তিক বলে মনে করেন।

যুক্তরাষ্ট্র স্বভাবতই উগ্র ডানপন্থীদের বিজয় দেখতে চেয়েছিল; কিন্তু জনসাধারণ বাদ সেধেছে। ভোটাররা তাদের কাজ সম্পন্ন করেছে। এখন মোরালেস ও তাঁর অনুসারী আর্কেকে পরবর্তী কাজ সম্পন্ন করতে হবে। গত বছরের রাজনৈতিক সংকট এখনো সমাধান করা যায়নি। বলিভিয়ার জনসাধারণ এখনো দুভাবে বিভক্ত। এক পক্ষ মনে করে, মোরালেসকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অপর পক্ষ মনে করে, গত বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এই বিভাজন দূর করতে হবে।

মোরালেসের বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোনো দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। বিশ্ব গণমাধ্যমে মোরালেস মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নেতা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তিনি জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তির পক্ষে ছিলেন। ভেনেজুয়েলার হুগো শ্যাভেজের সঙ্গে জোট বেঁধে দক্ষিণ আমেরিকায় মার্কিনবিরোধী বলয় তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তিনি ফকল্যান্ড দ্বীপের ওপর আর্জেন্টিনার দাবিকে যৌক্তিক বলে মনে করেন।

আইনি ও ভোটের লড়াইয়ে বরাবরই মোরালেস জিতে যাচ্ছেন। শ্রমিক রাজনীতি করে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রীয় মঞ্চে চলে আসা মোরালেস বলিভিয়ার খনিজ সম্পদকে জাতীয়করণ করেছিলেন। আদিবাসীদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন বামধারার এই শাসক। তাঁর নীতি ও পদ্ধতি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের পরামর্শ অনুসরণ করেনি। এ কারণেই তাঁকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল।

ঠিক এক বছর পর মোরালেসকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেওয়ার হিসাব কড়ায়–গন্ডায় চুকিয়ে দিয়েছে বলিভিয়ার জনসাধারণ। এবারের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমাদের গণমাধ্যমে খুব বেশি আলাপ শোনা যায়নি। এই নির্বাচনের ফলাফলকে খুব বেশি গুরুত্বও দেয়নি; বরং এড়িয়ে যাওয়ার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। তবে নির্বাচনে উগ্র ডানপন্থীদের ধরাশায়ী হওয়ার আভাস পেয়েই নতুন গল্প ফাঁদতে শুরু করেছে পশ্চিমা গণমাধ্যম। এবারের গল্প হচ্ছে, বলিভিয়ার গণতন্ত্র খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এই গণতন্ত্র টিকবে না বলে সংশয়ও প্রকাশ শুরু হয়েছে।

যে শাসক বলিভিয়ায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এনে দিলেন, নাগরিকের জীবনমানের উন্নয়ন সাধন করলেন; তাঁর দল আবার বিজীয় হওয়ার প্রাক্কালে মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে বিশ্বমোড়লেরা। কারণ, মোরালেসের দল ক্ষমতায় থাকলে আমাজন ও আন্দিজের সম্পদ নির্বিঘেœআহরণ করা যাবে না। বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাগাড়ে পরিণত হবে না বলিভিয়া। ধারণা করা হয়, মোরালেসই আড়াল থেকে বলিভিয়ার রাজনীতি পরিচালনা করবেন। মোরালেসের অর্থমন্ত্রী হিসেবে লুইস আর্কে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই দুজনের বোঝাপড়ায় বলিভিয়া আবারও ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। সম্প্রতি বলিভিয়ার অর্থনীতি খুব ভালো নয়। ২০০১ সালের পর গত বছর সব থেকে কম প্রবৃদ্ধি ছিল, ২ দুই দশমিক ১। অনেকেই আশা করছেন, ক্ষমতায় না থেকেও মোরালেস ঠিকই বলিভিয়াকে এই অবস্থা থেকে বের করে নিয়ে আসবেন।

বলিভিয়ার নির্বাচনের আরেকটি বার্তা হচ্ছে, বাইরের শক্তির সহায়তা নিয়ে দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করা যায়, অরাজকতা সৃষ্টি করা যায় কিন্তু জনসাধারণের মন জয় করা যায় না। জেলে পুরে, নির্বাসনে পাঠিয়ে জনপ্রিয় শাসকদের দৃশ্যপট থেকে আড়াল করা গেলেও ভোটারদের মন থেকে মুছে ফেলা যায় না।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক